ঢাকা মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি, ২০২৫

রং বদলে ইমেজ সংকট দূর হবে!

শহিদুল ইসলাম রাজী

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২১, ২০২৫, ১২:৫০ এএম

রং বদলে ইমেজ সংকট দূর হবে!

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

জুলাই-আগস্টে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি ও গণহত্যায় চরম ইমেজ সংকটে পড়ে পুলিশ ও র‌্যাব। গণঅভ্যুত্থানের পর জনরোষের মুখে পড়ে পুলিশ।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় জনসাধারণের সবচেয়ে কাছাকাছি নিয়োজিত বৃহত্তর বাহিনীটি পড়ে নজিরবিহীন প্রতিরোধ ও বিপর্যয়ের মুখে। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ বাহিনী সংস্কারের দাবি ওঠে। বলা হয় পুলিশ, র‌্যাব ও আনসারের পোশাক পরিবর্তন কথা। গঠন করা হয় পুলিশ কমিশন। তারই ধারাবাহিকতায় পুলিশ, র‌্যাব ও আনসার বাহিনীর পোশাক পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কালো প্যান্টের সঙ্গে আয়রন রঙের শার্ট পরবে পুলিশ। সম্পূর্ণ কালো রঙের পরিবর্তে ‘গ্রিন অলিভ’ রঙের পোশাক পাচ্ছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। আনসার বাহিনীর নতুন পোশাক হবে গোল্ডেন হুইট (সোনালি গম) রঙের। এই রঙের শার্ট ও প্যান্টের সঙ্গে লাল রঙের বেল্ট পরবেন তারা।

তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই বাহ্যিক পোশাক পরিবর্তনে পুলিশের ভাবমূর্তি উদ্ধার এবং পুলিশের মনমানসিকতার পরিবর্তন সম্ভব কি না, সে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কেবল পোশাকে পরিবর্তন নয়, সবার আগে পরিবর্তন আনতে হবে বাহিনীর মানসিকতায়। সাধারণ মানুষের প্রতি পুলিশের আচরণ বদলাতে হবে। না হলে বাহ্যিক পরিবর্তনে শুধু অর্থের অপচয় হবে।

এদিকে পুলিশ, র‌্যাব ও আনসারের পোশাক পরিবর্তন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়ে নিজের অবস্থান জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। গতকাল বিকেলে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এ বিষয়ে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন তিনি। সেখানে তিনি লেখেন, ‘স্বভাব, চরিত্র, খাসলত পরিবর্তন না করে পোশাক পরিবর্তনে কোনো লাভ নাই। সমস্যা পোশাকে না, পুরো সিস্টেমে।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, গত সাড়ে ১৫ বছরে পুলিশের ভেতরে নগ্নভাবে দলীয়করণ করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর পরিবর্তে দলীয় ক্যাডারের ভূমিকায় ছিল পুলিশ। কোনো কোনো কর্মকর্তা রাজনীতিকের ভাষায় প্রকাশ্যে মিডিয়ার সামনে বক্তব্য দিয়েছেন। তাদের মুখের ভাষার পাশাপাশি শারীরিক ভাষাও ছিল মাস্তানের মতো। কথায় কথায় হুংকার দিয়েছেন সরকারবিরোধী রাজনীতিবিদদের উদ্দেশে। তিনটি নির্বাচনেই পুলিশ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য হেন অপকর্ম নেই, যা করেনি। দম্ভের সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তাদের বলতে শোনা গেছে, ‘এ সরকার কি জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আছে? আমরাই তো রেখেছি।’ সরকারের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে বিরোধী দল নির্মূলে ভয়ংকর ও বেপরোয়া রূপ নিয়েছিল পুলিশ, র‌্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনী। যখন-তখন যাকে-তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে অনির্দিষ্টকাল আটকে রাখা হয়েছে।

খুন, গুম হয়ে উঠেছিল ডালভাত। গত ৫ আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর পাল্টে যায় দৃশ্যপাট। ঢাকাসহ দেশের অন্তত ৪৫০টি থানায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। বিশেষ করে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর পুলিশ সদর দপ্তর, বিভিন্ন জেলা পুলিশের কার্যালয়, ট্রাফিক পুলিশ বক্সসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর হয়। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় অনেক থানা ভবনে। লুট করা হয় অস্ত্র, গোলাবারুদ ও সরঞ্জাম। আত্মগোপনে চলে যায় পুলিশ।

থানাগুলো ছিল সুনসান নীরব, বিরান। রাস্তায় কোনো ট্রাফিক পুলিশ না থাকায় শিক্ষার্থীরা ট্রাফিকের কাজ করে। অবিস্মরণীয় গণঅভ্যুত্থানোত্তর বাংলাদেশে পুলিশের পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়তায় বেশ কয়টা দিন কেটেছে ওই সময়। যা দেশের ৫৩ বছরে সম্ভবত প্রথম দেখা গেল ‘পুলিশবিহীন রাষ্ট্র’।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পুলিশ বাহিনী সংস্কারের দাবি ওঠে। সেখানে অন্যতম একটি বিষয় ছিল পুলিশের পোশাক পরিবর্তনের দাবি। পরে পুলিশের সঙ্গে যুক্ত হয় র‌্যাব ও আনসারের পোশাক পরিবর্তনের বিষয়টি।

গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে র‌্যাব, পুলিশ ও আনসারের পোশাক নির্ধারণ করা হয়। বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আজকে বৈঠকে আমরা নতুন পোশাক নির্ধারণ করেছি। পর্যায়ক্রমে বাহিনীগুলোর সদস্যদের এ পোশাক দেওয়া হবে।’

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘পোশাকের সাথে মনমানসিকতা সব কিছু পরিবর্তন হতে হবে। দুর্নীতি বন্ধে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পুলিশের পোশাক-লোগো সব পরিবর্তন করা হবে। অনেকের মন ভেঙে গেছে, এই ইউনিফর্ম পরে পুলিশ আর কাজ করতে চাইছে না। খুব দ্রুতই তা পরিবর্তন করা হবে।’ ‘গত ১৫ বছর তাদের যে ট্রেনিং ছিল, সেই ট্রেনিংও পরিবর্তন করতে হবে, তাদের মানবিক হতে হবে।’

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট ড. শাহদীন মালিক বলেন, জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যতগুলো মামলা হয়েছে, তার প্রত্যেকটি মামলায় একশ’ থেকে দেড়শ’ জনের নাম উল্লেখ করে আর দুইশ’ থেকে চারশ’ পর্যন্ত অজ্ঞাতনামা আসামি করে দেশের বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে। এই মামলাগুলোর কোনোটারই তদন্ত ও বিচার শেষ হবে না। এই হত্যাযজ্ঞের জন্য কেউ না কেউ দায়ী? প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, পুলিশের এখন নজর দেওয়া উচিত এসব দিকে। পুলিশের দক্ষতা ও যোগ্যতার সঙ্গে এসব মামলার অনুসন্ধান করে দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করা। এইগুলো বাদ দিয়ে তারা যদি পোশাক-আশাকের দিকে নজর দেয়, তাহলে মামলাগুলো সুষ্ঠু তদন্ত করে বিচার নিশ্চিত করা থেকে দৃষ্টি সরে যাবে। এ জন্যই এখন পুলিশের পোশাক পরিবর্তন খুবই সময়-অনোপযোগী। সবচেয়ে অনুপযুক্ত সময়। পোশাক পরিবর্তন হলেই যে পুলিশের আচরণ পরিবর্তন হয়ে যাবে, চরিত্রের বিবর্তন ঘটবে, জনবান্ধব হয়ে উঠবে তা মনে করার কোনো কারণ নেই।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, এটা আসলে বাহ্যিক একটা পরিবর্তন। এর সঙ্গে যদি আচরণগত পরিবর্তন না হয়, সেবাধর্মী মনোভাবের পরিবর্তন না হয়, তাহলে পোশাকের পরিবর্তন দিয়ে কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করে বলে কোথাও দেখিনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে পোশাক পরিবর্তন দরকার নয়, যেটা আছে যথেষ্ট আছে। এখন দরকার পুলিশের আচার-আচরণ জনগণ অরিয়েন্টেড হবে, সেবামূলক হবে এবং মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন হতে হবে। সাধারণ নাগরিকের জীবনও যে পুলিশের জীবনের মতোই মূল্যবান, তা অনুধাবনের মতো মানসিকতা তৈরি করতে হবে। এখন পরিবর্তনটা দরকার মনে-মগজে। তবেই সফল ও সার্থক হবে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগ।

মূল জায়গায় পরিবর্তন না করে শুধু পোশাকের বাহ্যিক পরিবর্তন করে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় বড় বাজেটের প্রকল্পের চেয়ে সেবামূলক পরিবর্তনে জোর দেওয়ার পরামর্শ তার। তবে তিনি র‌্যাবের বিষয়ে বলেন, র‌্যাবের পোশাক পরিবর্তন করা দরকার, কারণ কোনো বাহিনীর এমন কালো পোশাক, যা দূর থেকে মানুষ অন্যভাবে দেখে, এই জায়গা থেকে র‌্যাবের পোশাক পরিবর্তন হতে পারে। অন্য বাহিনীর সব পোশাক ঠিক আছে। এ ক্ষেত্রে লগোতে পরিবর্তন আনা দরকার।

একই প্রসঙ্গে পুলিশের সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান বলেন, ব্যাটালিয়ন পুলিশ, জেলা পুলিশ ও মেট্রোপলিটন পুলিশ তিনটা আইন দ্বারা পরিচালিত, যদি এক করে ফেলা হয় তাহলে মানুষ তো বিভ্রান্ত হবে। 

রাস্তায় পুলিশ দেখলে ভাববে যে তার হয়তো দরকার ব্যাটালিয়ন পুলিশের, সে ভেবে ফেলতে পারে এটা জেলা পুলিশ। সে জন্য পুলিশের সব ব্রাঞ্চকে বিশেষ করে তিনটা ব্রাঞ্চের সবাইকে একই পোশাকে নিয়ে এলে পরে বোধ হয় এ নিয়ে বিভ্রান্তি বাড়তে পারে।

সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সবার আগে পরিবর্তন আনতে হবে বাহিনীর মানসিকতায়। সাধারণ মানুষের প্রতি বদলাতে হবে পুলিশের আচরণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, পোশাক পরিবর্তন করলে পুলিশের সবাই যে ভালো হয়ে যাবে এর কোনো নিশ্চয়তা নাই। সুতরাং যে জায়গা থেকে প্রত্যাশিত পুলিশিং ব্যবস্থার সৃষ্টি হতে পারে সেটি প্রশিক্ষণ, তাকে আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে আসা, তার কর্মকাণ্ডের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা উচিত।

আরবি/জেডআর

Link copied!