ঢাকা মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি, ২০২৫

মুকুটহীন সম্রাট নাফিজুর রহমান

শাওন সোলায়মান

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২১, ২০২৫, ১০:১০ এএম

মুকুটহীন সম্রাট নাফিজুর রহমান

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

পেশাগত অসদাচরণ, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মাধ্যমে তদবির, সরকারি বাসস্থানে থেকেও বেতনের সাথে বাড়িভাড়া ভাতা ওঠানোসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ সত্ত্বেও বহাল তবিয়তে আছেন হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এইচবিআরআই) প্রিন্সিপাল রিসার্চ অফিসার (পিআরও) নাফিজুর রহমান। 

দফায় দফায় নোটিশ দেওয়া হলেও সরকারি বাসা এখনো ছাড়েননি তিনি। অন্তত নয়বার কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হলেও কখনো বিন্দুমাত্র শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি তাকে। বরং বিভিন্ন কমিটিতে থেকে নিজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন নিজেই। 

এমন প্রভাব বিস্তারের জন্য যেন এইচবিআরআইয়ের মুকুটহীন সম্রাটে পরিণত হয়েছেন নাফিজুর রহমান। আর এসব কর্মকাণ্ডে নাফিজুরকে বটবৃক্ষের মতো প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে এইচবিআরআইয়ের মহাপরিচালক আশরাফুল আলমের বিরুদ্ধে। 

২০০৯ সালে এইচবিআরআইয়ের তৎকালীন ‘রিসার্চ আর্কিটেক্ট’ নাফিজুর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা পর্যবেক্ষণের নামে বরাদ্দ পান ‘ইকো হাউজ আরবান টাইপ ০১’ বাসাটি। ১ হাজার ২০০ বর্গফুটের বাড়িটিতে সপরিবারে বসবাস করছেন তিনি। 

প্রথা অনুযায়ী, এমন বাসার বরাদ্দ দেন মহাপরিচালক। তবে ২০০৯ সালের ৪ অক্টোবর ক্ষমতার দাপটে তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক রেয়াজ উদ্দিন সরকার থেকে বাসাটি বরাদ্দ নেন নাফিজুর। বাসাভাড়া এবং পানির বিল বাবদ ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ১৭ লাখ ৮০ হাজার ৬৫৩ টাকা এইচবিআরআইয়ের বকেয়া রয়েছে নাফিজুরের কাছে। 

অবশ্য সরকারি বাসায় বসবাস করেও বেতনের সাথে নিয়মিত বাসাভাড়া গ্রহণ করতেন তিনি। বকেয়া ভাড়া আদায়ে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ইনস্টিটিউটের তৎকালীন মহাপরিচালক মোহাম্মদ শামীম আখতারের স্বাক্ষরে দ্বিতীয় দফায় চিঠি দেওয়া হয় তাকে। 

সেই চিঠিতে নাফিজুরের এহেন কর্মকাণ্ডকে ‘নৈতিকতার পরিপন্থি এবং সরকারের আর্থিক ক্ষতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। দফায় দফায় চিঠি দেওয়ার পরেও ভাড়া পরিশোধ না করায় নাফিজুরের বিরুদ্ধে অডিট আপত্তি উত্থাপিত হয়। অনুসন্ধান বলছে, এখনো সেই আপত্তির নিষ্পত্তি হয়নি। 

বিগত ১৫ বছরের সরকারি বাসা ছেড়ে দিতে নাফিজুরকে বারবার চিঠি দেওয়া হয়। তবে এখনো সেই বাসার দখল রেখেছেন নাফিজুর। ২০১৯ সালের নভেম্বরে নাফিজুরকে দেওয়া চিঠি অনুযায়ী, সে বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বাড়িটি এইচবিআরআইয়ের তৎকালীন উপসহকারী প্রকৌশলী আল্লামা ইকবালের কাছে হস্তান্তর করতে বলা হয় তাকে। 

চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয় যে, তৎকালীন পিআরও-এর কাছে বাড়িটি হস্তান্তরে নিজের মৌখিক সম্মতি জানিয়েছিলেন নাফিজুর। বাড়ি হস্তান্তরের সেই নির্দেশনা নাফিজুর পালন তো করেনইনি বরং নিজ বেতনের বাড়িভাড়া ভাতার ৪০ শতাংশ ওই বাসার ভাড়া বাবদ কর্তনের সিদ্ধান্ত বাগিয়ে নেন। 

অর্থাৎ সরকারি বাসায় থেকেও বাড়িভাড়া ভাতার ৬০ শতাংশ থাকছে নাফিজুরের পকেটেই। যে কমিটি ওই সিদ্ধান্ত দেয়, সেই কমিটির সদস্য ছিলেন নাফিজুর নিজেই। এইচবিআরআইয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে জটিলতা ও অসন্তোষ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ওই কমিটি গঠিত হয়। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত কমিটির প্রথম সভাতেই নিজের এই সুবিধা প্রতিষ্ঠিত করেন নাফিজুর। 

অবশ্য ইনস্টিটিউটের নির্বাহী অথবা অন্যান্য কোনো কমিটির এভাবে বাসাভাড়া কমানোর আইনি এখতিয়ার নেই। বিষয়টি চাকরি (বেতন ও ভাতাদি) আদেশ, ২০১৫-এর ধারা ১৬(২) ও (৪)-এর লঙ্ঘন। 

ধারা দুইটি যথাক্রমে বলছে, সরকারি বাসস্থানে বসবাসকারী কর্মচারী বাড়িভাড়া ভাতা পাবেন না এবং ভাড়াবিহীন বাসস্থানে থাকার অধিকারী হলে সেই কর্মচারীকে বাড়িভাড়া দিতে হবে না, তবে তিনি বাড়িভাড়া ভাতাও পাবেন না। অনুসন্ধানে নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, এই অবৈধ সুবিধার মাধ্যমে নাফিজুরের থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র ৬ লাখ ১৫ হাজার ৭১৫ টাকা নেওয়া হয়েছে। অর্থ্যাৎ অডিট আপত্তির বাকি ১১ লাখ ৬৪ লাখ ৯৪৯ টাকা আত্মসাৎ হয়েছে।

সরকারি বাসায় থেকেও বাড়িভাড়া ভাতা নেওয়ার বিষয়টিকে শুধু অনিয়ম না, বরং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বলে জানান জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা। 

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সরকারি বাসায় থেকেও বাড়িভাড়া ভাতা কোনোভাবেই নেওয়া যাবে না। 

ডিসি, ইউএনওরা সরকারি বাসায় যখন থাকেন, তখন কিন্তু আর বাড়িভাড়া ভাতা পান না। তাদের পদায়ন কিন্তু অনেক সময়েই ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে হয়, তবুও বাড়িভাড়া পান না। কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান নিজেদের মতো করে এ রকম কোনো আদেশ পাস করিয়ে নিলে, সেটাও হবে আইনের পরিপন্থি। যেখানে পরিপূর্ণ আইন আছে, সেখানে কোনো সংস্থার নিজস্ব বিধিমালা ওই আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর নাফিজুর রহমানের অপসারণের দাবি জানান এইচবিআরআই কর্মচারী ইউনিয়নের নেতারা। এতে ইনস্টিটিউটের অন্য সাধারণ কর্মচারীরাও এই দাবিতে সমর্থন দিয়েছিলেন বলে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান রূপালী বাংলাদেশকে। 

দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত ১১ আগস্ট অনুষ্ঠিত এইচবিআরআইয়ের ৩৫০তম সভায় নাফিজুরের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্তে ৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠিত হয়। পাশাপাশি নাফিজুর রহমানের বাসার বরাদ্দ বাতিলপূর্বক তিন কর্মকর্তার নামে সাময়িক বরাদ্দের সিদ্ধান্ত হয়। এই সিদ্ধান্তের আলোকে বাসাটি কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দিতে গত ২৯ আগস্ট চিঠি দেওয়া হলেও, এখনো বাসা হস্তান্তর করেননি নাফিজুর।

নাফিজুরের বিরুদ্ধে শুধু সরকারি বাসা দখলই না, বরং অভিযোগ আছে দায়িত্বে অবহেলা এবং প্রতিষ্ঠানের নিয়ম-শৃঙ্খলা ভঙ্গেরও। ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সন্তোষজনক গবেষণা না করা, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতি ছাড়াই কর্মস্থল ত্যাগ করা, কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত কার্যাদি না করা; দাপ্তরিক সময়ে অফিসে অনুপস্থিতি; রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তি দিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে নিজের সুবিধায় তদবির করানো; ইনস্টিটিউট থেকে অবমুক্ত হয়ে দায়িত্ব হস্তান্তর না করেই স্রেডায় যোগদান; ইচ্ছামতো অফিস থেকে উধাও হওয়া; অধস্তন কর্মকর্তাদের অনৈতিক সুবিধা দেওয়া ও তাদের অনৈতিক কাজে সহায়তা করার মতো গুরুতর অভিযোগে অন্তত ৯ বার কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয় নাফিজুরকে। 

ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ও গভর্নিং কাউন্সিলের সাবেক সদস্যসচিব মোহাম্মদ আবু সাদেক এক চিঠিতে উল্লেখ করেন, ‘(ইনস্টিটিউটের হাউজিং বিভাগ) নাফিজুর রহমানের যোগদান ও দায়িত্ব গ্রহণের পর হতে বিভাগটি দুর্নীতি ও বিভিন্ন অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ে এবং সম্পূর্ণরূপে একটি অকার্যকর বিভাগে পরিণত হয়।’ 

২০১৮ সালের ১২ এপ্রিল ইনস্টিটিউটের তৎকালীন গভর্নিং কাউন্সিলের সভাপতি বরাবর চিঠিটি লিখেছিলেন আবু সাদেক। শুধু তাই নয়, ২০১৪ সালের নাফিজুরের বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদনে (এসিআর) প্রতিস্বাক্ষরকারী কর্মকর্তা মন্তব্যের ঘরে লেখেন, ‘(নাফিজুর) কোনোরূপ শৃঙ্খলা মান্য করেন না। ইচ্ছামতো অফিসে আসেন ও ত্যাগ করেন। রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে এবং তদবির করে যাবতীয় অন্যায় কাজ করে থাকেন। অনৈতিক ও নিম্নমানের কর্মকর্তা। চাকরিচ্যুত হওয়া দরকার জনস্বার্থে।’ এই এসিআরে সামগ্রিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে নাফিজুর পেয়েছিলেন মাত্র ৫০ নম্বর।

তবে জনস্বার্থে নাফিজুরের কেন চাকরিচ্যুতি হয়নি তার জবাব মেলে ২০১৯ থেকে ২০২১ সালÑ অর্থাৎ তিন বছরের এসিআরে। ২০১৮ সালের মে থেকে ২০২০ সালের ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ছিলেন শামীম আখতার। তবে ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল তিন বছর নাফিজুরের এসিআরে প্রতিস্বাক্ষরকারী কর্মকর্তা হিসেবে স্বাক্ষর করেন শামীম আখতারের পরবর্তী মহাপরিচালক আশরাফুল আলম। 

২০২১ সালের আগস্টে নাফিজুরের ২০১৯ সালের এসিআর দেন আশরাফুল আলম, যিনি তখন ওই পদেই ছিলেন না। আশরাফুল আলমের ছায়াতলে নাফিজুর হয়ে ওঠেন ‘যুক্তিসংগতভাবে উত্তম’ কর্মকর্তা; সামগ্রিকভাবে পান ৯০ নম্বর। 

২০২০ সালের এসিআরে আরও উন্নতি হয় নাফিজুরের। আশরাফুল আলম তাকে ‘একজন ভদ্র, বিনয়ী ও দক্ষ কর্মকর্তা’ হিসেবে মূল্যায়ন করেন, নম্বর দেন ৯১। ২০২১ সালের এসিআরে নিজের সব রেকর্ড ছাপিয়ে যান নাফিজুর। আশরাফুল আলমের ছায়াতলে নাফিজ তখন ৯২ নম্বরধারী ‘বিচক্ষণ কর্মকর্তা’। এ ছাড়া চিঠি পেয়েও সরকারি বাসা হস্তান্তর না করার পেছনে নাফিজুরকে মহাপরিচালক আশরাফুল সাহস দিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নাফিজুর রহমান। বাসার বিষয়ে রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, এভাবে বাসা বরাদ্দের পাশাপাশি বাড়িভাড়া ভাতা পাচ্ছেন, এমন অনেক কর্মকর্তা আছে। আর যে কমিটির সভায় বাড়িভাড়া ভাতা কর্তন করা হয়, সেই কমিি তে আমি ছাড়াও আরও সদস্য ছিলেন। শুধুমাত্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাসা দেওয়া হয়েছিল। 

কিন্তু লক্ষ্য করবেন, শুধুমাত্র উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে স্রেডাতে কর্মরত অবস্থায় আমার অবর্তমানে অডিট আপত্তি দেওয়া হয়েছে! কোনো প্রমাণ দাখিলের সুযোগ দেওয়া হয়নি তখন। 

নিজের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলোর জন্য নিজের সততাকে কারণ উল্লেখ করে নাফিজুর বলেন, অনেকের অনৈতিক কাজে সায় দেইনি বলেই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। সাবেক কর্মকর্তারা আমার থেকে অনৈতিক সুবিধা না পেয়ে আমাকে হয়রানি করতে কারণ দর্শানোর মতো নোটিশ দিয়েছেন। মহাপরিচালক আশরাফুল আলমও আমার প্রতি ক্ষুব্ধ। 

এসব বিষয়ে মহাপরিচালক আশরাফুল আলমের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। গত বুধবার থেকে কয়েক দফায় তাকে ফোন এবং খুদে বার্তা দেওয়া হলেও কোনো সাড়া দেননি আশরাফুল আলম।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!