ঢাকা-৭ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ জানায়, শেখ পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় ঢাকার বিভিন্ন এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতেন মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। দীর্ঘদিন ধরে ছিলেন স্বাস্থ্য খাতের মাফিয়া। শেখ পরিবারের ২ জন ও তাদের একজনের স্ত্রীর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক ও তাদের আশীর্বাদে বেপরোয়া ছিলেন সাবেক এই এমপি। তিনি শেখ ফজলে নূর তাপস, শেখ ফজলে শামস পরশ এবং পরশের স্ত্রী অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা যুথির ছত্রছায়ায়ই আওয়ামী লীগে প্রভাব বিস্তার করতেন।
অভিযোগ আছে, শেখ হাসিনার আমলে গত সাড়ে ১৬ বছরে টাকার কুমির হয়ে ওঠেন। অনেক এমপি ও মন্ত্রীদের থেকে ব্যাপক প্রভাবশালী ছিলেন তিনি।
সূত্র জানায়, ঢাকা-৭ আসনের এমপি হওয়ার সুবাদে মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ঢাকা মহানগর দক্ষিণের বংশালের একাংশ, কোতোয়ালির একাংশ, চকবাজার, লালবাগ, হাজারীবাগ, বেড়িবাঁধ, মোহাম্মদপুর ও ধানমন্ডির একাংশ নাজিরাবাজার, পশ্চিম হাজারীবাগ, উত্তরে পলাশী ও দক্ষিণে কামরাঙ্গীরচর এলাকায় দীর্ঘদিন আধিপত্য বিস্তার করে বিভিন্ন অপকর্মে যুক্ত ছিলেন তিনি। গতকাল সোমবার ভোরে রাজধানীর আদাবর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। এরপর তার অপকর্মের তথ্য উঠে আসে। তাকে ধরার পর পুলিশ আদালতে হস্তান্তর করলে মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবি পুলিশের উচ্চ পযার্য়ের এক কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে জানান, এমপি জালাল মহিউদ্দিন জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের ওপর সন্ত্রাসী লেলিয়ে দিয়ে গুলি চালান। তার নামে বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। তিনি ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা পাচার করেছেন বলে অভিযোগ আছে। তাকে ধরার পর সব কিছু মাথায় রেখে গোয়েন্দারা তদন্ত করছেন। অভিযোগ আছে, বাংলাদেশে চিকিৎসা খাত ধ্বংসের মূল পরিকল্পনায় ছিলের আওয়ামী লীগের এই নেতা।
মহিউদ্দিন চিকিৎসা খাতে নিয়ন্ত্রণ তো করতেনই, এমনকি এ সেক্টরে আধিপত্য বিস্তারেও শীর্ষে ছিলেন।
মহিউদ্দিন আত্মগোপনে থেকেই সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। আওয়ামী লীগের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য তিনি আত্মগোপনে থেকে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র করে আসছিলেন। যার কারণে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট ডিবি পুলিশ।
অভিযোগ আছে, চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) নিজ হাতে ধ্বংস করেছেন এবং এই সেক্টর আজ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পেছনে সরকারের মূল হাতিয়ার হিসেবে যুক্ত ছিলেন জালাল মহিউদ্দিন। তিনি শেখ পরশ ও শেখ তাপসের ছত্রছায়ায় বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তা ছাড়া তিনি নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে জড়ানোর মূল হাতিয়ার ছিলেন। এরপর সব কিছু নিজ আয়ত্তের মধ্যে এনে নিয়ন্ত্রণ করেন।
ব্যাংকক, দুবাই, সিঙ্গাপুর ও ভারতে তার একাধিক সম্পত্তি রয়েছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। ছাত্র-জনতার ওপর হামলার পর আওয়ামী লীগ সরকার ছিটকে পড়লে ৫ আগস্টের পর উধাও হয়ে যান মহিউদ্দিন। করতে থাকেন দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র।
জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে জানান, সাবেক এমপি মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে গতকাল ভোরে আদাবর থানার মনসুরাবাদ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ঘটনায় হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামি ছিলেন। সব কিছু গুরুত্বসহকারে পুলিশ তদন্ত করছে। তা ছাড়া তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে দুপুরে আদালতে তোলা হলে আদালত তাকে রিমান্ড দেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ৫ দিনের রিমান্ডে: রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় ব্যবসায়ী আব্দুল ওয়াদুদ হত্যা মামলায় গতকাল সোমবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জশিতা ইসলাম শুনানি শেষে মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে এই রিমান্ডের আদেশ দেন। বিকেলে তাকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছিল।
মামলা সূত্রে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গত ১৯ জুলাই বিকেলে নিউমার্কেট থানার নীলক্ষেত এলাকায় পুলিশের গুলিতে ব্যবসায়ী আব্দুল ওয়াদুদ মারা যান। এ ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ১৩০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন আব্দুল ওয়াদুদের শ্যালক আব্দুর রহমান।
মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন নিষিদ্ধ ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের ১৯৮১ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত সভাপতি ছিলেন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ঢাকা-৭ থেকে সংসদে নির্বাচিত হন। ২০২২ সাল থেকে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য তিনি।
এখনো তিনি বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। সর্বশেষ তিনি দেশদ্রোহী ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন।
দেশদ্রোহী ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন: এ বিষয়ে ডিএমপির ডিবির যুগ্ম কমিশনার নাসিরুল ইসলাম বলেন, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে হত্যাসহ একাধিক মামলা রয়েছে।
সব মামলা দায়িত্ব নিয়ে পুলিশ তদন্ত করছে। এ বিষয়ে ডিবি পুলিশের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, মোহাম্মদপুরের মনসুরাবাদ হাউজিং এলাকায় একক আধিপত্য ছিল তার। হাউজিং এলাকাও নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। কাউকে ভাগ দিতেন না।
মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন দল সরকারে থাকাকালীন এবং এমপি হওয়ার আগে ও পরে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। অত্র এলাকায় চাঁদাবাজির সিন্ডিকেট একাই নিয়ন্ত্রণ করতেন। ভাগ দিতেন তাপস, পরশ ও পরসের স্ত্রী যুথিকে। তা ছাড়া গণভবনে মহিউদ্দিনের নিজস্ব একটা সেটআপ ছিল। যে কারণে তিনি আরও বেপরোয়া ছিলেন। স্বাস্থ্য খাতের সমগ্র ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো একক আধিপত্য নিয়ন্ত্রণ করতেন সাবেক এই এমপি।
এ বিষয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স) ইনামুল হক সাগর রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, দেশদ্রোহী ও সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র যারাই করবে, পুলিশ ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতিরোধ করবে এবং আইনের আওতায় আনবে। এ ক্ষেত্রে পুলিশ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :