ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনে গণঅভ্যুত্থানের মুখে বিগত ৫ আগস্ট শোচনীয় পতন হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের। এর তিন দিনের মাথায় গঠিত হয় নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরপর আলোচনায় আসে পরবর্তী সংসদ বা জাতীয় নির্বাচনের বিষয়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল এ নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর ক্রমাগত চাপ বাড়াচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সবার জিজ্ঞাসা কবে ঘোষণা হবে নির্বাচনের রোডম্যাপ (রূপরেখা), কবে হতে যাচ্ছে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন। তবে এ নির্বাচনকে সামনে রেখে জোর প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তারা ভোট গ্রহণের সার্বিক প্রস্তুতি শেষ করবে ডিসেম্বরের মধ্যে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছরের জানুয়ারি মাসে বহুল প্রত্যাশিত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এর সিডিউল বা তপশিল ঘোষণা করা হবে চলতি বছরের নভেম্বর মাসের দিকে। অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষ পর্র্যায় থেকে নির্বাচনের রোডম্যাপ মার্চ মাসে দিতে পারে। ইতোমধ্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম শুরু করেছে কমিশন। নির্বাচনসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এমনটাই দাবি করেছে।
সূত্রগুলো বলছে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের গত সাড়ে ১৫ বছরের আমলে নির্বাচন, প্রশাসন, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থাসহ রাষ্ট্রের নানা প্রতিষ্ঠান-ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। তাই রাষ্ট্র মেরামতের লক্ষ্যে সংস্কার প্রস্তাব তৈরির জন্য অন্তর্বর্তী সরকার দুই ধাপে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এর মধ্যে চারটি কমিশন প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। বাকি সাত কমিটিও ফেব্রুয়ারি মাসে জমা দেবে। এ-সংস্কার প্রস্তাবের প্রতিবেদনগুলো নিয়ে ফেব্রুয়ারির শেষার্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসবে সরকার। প্রাথমিক সমঝোতার পর আগামী মার্চ মাসে ঘোষণা দেওয়া হতে পারে সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ।
এদিকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য সরকারের ওপর ক্রমাগত চাপ বাড়াচ্ছে বিএনপি ও কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)সহ অংশীজনের বেশির ভাগ। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ আগামী ৫ আগস্ট নির্বাচনের জন্য দাবি করেছেন। এর আগে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা বারবার বলছি, নির্বাচিত সরকারের কোনো বিকল্প নেই। এটা গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা সরকার, নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এই বছরের মাঝামাঝি সময়ের (জুলাই-আগস্ট) মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবস্থা নিতে পারি।
সংস্কার যেহেতু চলমান প্রক্রিয়া, তাই সংস্কার ও নির্বাচন দুটোর কাজই একসঙ্গে চলতে পারে। সবশেষ গতকাল বিএনপি মহাসচিব বলেন, এখনই নির্বাচন নয়, ন্যূনতম সংস্কার করেই নির্বাচন। তবে আমরা বিশ্বাস করি, যেকোনো নির্বাচিত সরকার কিন্তু অনির্বাচিত সরকারের চেয়ে ভালো। আমার অ্যাকসেস থাকে, আমি যেতে পারি, কথা বলতে পারি... এখন আমার সেই জায়গাটা নেই।’
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চায়, সেটি ঠিক আছে। তবে সরকার যাতে বেশি দেরি না করে, এ জন্য এটি দলটির রাজনৈতিক কৌশল হতে পারে। লক্ষ্যণীয় বিষয় বিএনপির শীর্ষমহলের বক্তব্যে এত তড়িঘড়ি করার কথা শোনা যায়নি। গতকাল দলটির মহাসচিবও সুর কিছুটা পাল্টিয়েছেন। বলেছেন, তারাও প্রথমে সংস্কার চান। এ ছাড়া আরেক বড় অংশীজন জামায়াতে ইসলামীর নেতারাও দ্রুত নির্বাচনের চেয়ে সংস্কার ও গণহত্যাকারী-লুটেরাদের বিচারের দাবি করছে। একই অবস্থান ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্রনেতাদের।
অপরদিকে নির্বাচন আয়োজনকারী সংস্থা নির্বাচন কমিশন বলছে, প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত প্রাথমিক রোডম্যাপ ধরেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা।
নির্বাচন কমিশনার তাহমিদা আহমদ বলেন, আমরা আগামী ডিসেম্বর বা ২০২৬ সালের জানুয়ারি মাসে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছি। এর আগে আমাদের পক্ষে নির্বাচন করা সম্ভব নয়। একটা ভালো নির্বাচনের জন্য আমাদের সময় দিতে হবে। কিছু আইন পরিবর্তনেরও বিষয় আছে। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের সময় দিতে হবে। আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এটাই গোটা কমিশনের অভিমত।
তিনি বলেন, ২০ জানুয়ারি তথা সোমবার থেকে ভোটার তালিকা হালনাগাদ বা সংশোধনের কাজ শুরু হয়েছে। আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি এ তথ্য সংগ্রহের কাজ চলবে। ২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি বা তার আগে যাদের জন্ম এমন নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহ করবেন তথ্য সংগ্রহকারীরা। তথ্য সংগ্রহের কাজ শেষ হলে ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু ছবি তুলে নিবন্ধন সম্পন্ন করার কাজ। ১১ এপ্রিল পর্যন্ত নিবন্ধন কার্যক্রম চলবে।
নির্বাচন কমিশন ও সরকারি সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, দিন যতই যাচ্ছে, দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি বিদেশি প্রভাবশালী দেশগুলোর পক্ষ থেকেও দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের চাপ রয়েছে। বিশেষ করে গত পাঁচ মাসেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক উন্নতি না হওয়া, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, প্রশাসনে অস্থিরতা ও পরাজিত শক্তির বিভিন্ন অপকৌশলসহ নানা কারণে সরকারের ওপর নির্বাচন বিষয়ে চাপ আরও বেড়েছে। এমন বাস্তবতায় ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত সময়সীমার মধ্যে তথা আগামী বছরের জানুয়ারি ঘিরেই পরিকল্পনা সাজাচ্ছে সরকার ও নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে কারিগরি সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বাংলাদেশে কাজ শুরু করছে। এ নিয়ে ইউএনডিপির প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গত সপ্তাহে বৈঠক করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নির্বাচন কমিশনের এক কর্মকর্তা জানান, পববর্তী জানুয়ারি মাসে নির্বাচন সম্পন্ন করতে নভেম্বর মাসেই তপশিল ঘোষণা হবে। এটি ঘোষণার ৪৫ দিনের মধ্যে নির্বাচন শেষ করার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেক্ষেত্রে মার্চ মাসেই চূড়ান্ত রোডম্যাপ দেওয়া হবে। এর আগে সংস্কার প্রস্তাবের প্রতিবেদনগুলোর বিষয়ে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসবে সরকার। কারণ প্রস্তাবনাগুলো পরবর্তী সরকারের সংসদে পাস না করলে ঝুলে যাবে।
এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী নেওয়াজ বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত সময় ধরে ভোটের প্রস্তুতি চলছে। আমাদের মূল ফোকাস হচ্ছে জাতীয় নির্বাচন। কমিশন সে পথেই এগোচ্ছে। এর বাইরে এখনই সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা যাবে না।
অন্যদিকে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. তোফায়েল আহমেদ কিছুদিন আগে জানান, মাঠপর্যায়ের বেশির ভাগ মানুষ চান আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হোক। তবে সিদ্ধান্ত সরকার ও নির্বাচন কমিশনের। এরপর এ নিয়ে শুরু হয় আলোচনা।
এ প্রসঙ্গে কমিশনের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, এই মুহূর্তে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে ভাবছে না নির্বাচন কমিশন। আমাদের প্রধান লক্ষ্য ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন, সেই লক্ষ্যেই কাজ করছে কমিশন। পরে নির্বাচিত সরকারের আমলে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এর আগে গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে এসে আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি সম্পর্কে ধারণা দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেদিন তিনি বলেন, ‘ভোট কবে হবে তা নির্ভর করবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে কতটা সংস্কার করে নির্বাচনে যাওয়া হবে, তার ওপর। মোটাদাগে এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে হতে পারে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন।’ পরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ২০২৬ সালের জুলাইয়ের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলে প্রেস সচিব তার বক্তব্য পরিষ্কার করেন।
তার আগে গত ২৪ সেপ্টেম্বর বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ওয়েবসাইটে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার প্রতিবেদন আকারে প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সম্পন্ন করে ১৮ মাস বা দেড় বছরের মধ্যে নির্বাচনের লক্ষ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারকে যেকোনো পরিস্থিতিতে পূর্ণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন সেনাপ্রধান।
সংশ্লিষ্ট দলগুলোর নেতারা জানিয়েছেন, তারা মূলত নির্বাচনি রোডম্যাপের প্রতিই গুরুত্ব দিয়েছেন। নির্বাচন এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার ইস্যুতে লিখিতভাবে প্রস্তাবনা দিতে পারে কোনো কোনো দল। দ্রুত প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ বাদে প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দল অতি প্রয়োজনীয় সংস্কার করেই ভোটের তারিখ নিশ্চিত করতে বলছে। বর্তমানে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি চায় চলতি বছরেই নির্বাচন হোক। দলটি বলছে, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকলে জবাবদিহি বেশি থাকে। কাজেই দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে।
তবে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে তড়িঘড়ি করার পক্ষে নয় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। আবার, চলতি বছরের জুলাই-আগস্টের মধ্যে নির্বাচনের যে দাবি বিএনপি জানিয়েছে, তা নিয়েও জোর আপত্তি নেই দলটির। তবে, জামায়াতে ইসলামী মনে করে, নির্বাচন নিয়ে বেশি তাড়াহুড়ো করলে সংস্কার বিলম্বিত হতে পারে। সংস্কার কমিশনের দেওয়া প্রস্তাবনা পর্যালোচনা করে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নিয়ে প্রস্তাব দেবে জামায়াত।
দলটির সহকারী সেক্রেটারি হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, নির্বাচন নিয়ে তাড়াহুড়ো না করে প্রয়োজনীয় সংস্কার করার পক্ষে জামায়াত। নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে দলীয় কোনো সিদ্ধান্ত না হলেও, সংস্কার কমিশনের দেওয়া প্রস্তাব পর্যালোচনা করে এই বিষয়ে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত জানানো হবে। আর জামায়াতের নায়েবে আমির আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের মনে করেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে নির্বাচন জরুরি।
তিনি বলেন, সংস্কারের জন্য যৌক্তিক সময় দিলেও, অন্তর্বর্তী সরকার যেন কোনোভাবেই অযথা সময়ক্ষেপণ না করে সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :