বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের কৃচ্ছ্রসাধনের একটি আদেশের ফলে গত জুলাই থেকে ইপিজেডগুলোর আয়ের উৎস থমকে আছে। বর্তমান সরকার আয় বাড়ানোর নানা উদ্যোগ নিলেও ইপিজেডগুলো থেকে নিশ্চিত আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে আছে।
এতে সরকার অতিরিক্ত রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মূলত অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি আদেশেই বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষের (বেপজা) ভবন নির্মাণ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তাই ওই আদেশ বাতিল চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়েরই দ্বারস্থ হয়েছে বেপজা।
দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বেপজার আওতাধীন ইপিজেডগুলোর কারখান ভবন নির্মাণ ও ভবন সম্প্রসারণ বেপজার নিজস্ব অর্থায়নে করা হয় এবং এসব নির্মিত কারখানা ভবন বিনিয়োগকারীরা ভাড়া নিয়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে থাকেন। এই ভাড়া আদায়ের মাধ্যমে বেপজা পরিচালিত হয়ে থাকে, যা সাত বছরের মধ্যে মূল বিনিয়োগ ফেরত আসে এবং সেবা চার্জের মাধ্যমে সরকারের অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় হয়ে থাকে।
দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্যবিমোচনের উদ্দেশ্যে শিল্প খাতের দ্রুত বিকাশের লক্ষ্যে বেপজা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইপিজেড স্থাপন করে, যেখানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ এনে বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও রপ্তানি বৃদ্ধির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। কিন্তু ভবন সম্প্রসারণ এবং নতুন ভবন নির্মাণ করতে না পারায় তা ব্যাহত হচ্ছে।
তাই সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির স্বার্থে অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারি করা ৪ জুলাইয়ের পরিপত্রের আওতা থেকে বেপজাকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের চিঠি দিয়েছে বেপজা কর্তৃপক্ষ। বেপজার পরিচালক-১ মোহাম্মদ ফিজনুর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এই অনুরোধ জানানো হয়েছে, যা রূপালী বাংলাদেশের হাতে রয়েছে।
বেপজা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অনন্য ভূমিকা পালন করে। বেপজা একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা; নিজস্ব তহবিল থেকে বেপজার আওতায় আটটি ইপিজেডে কারখানা ভবনসহ অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
বেপজার অধীনে নির্মিত কারখানা ভবন, বিনিয়োগকারীদের ক্লাব বিনিয়োগকারীদের জন্য ভাড়া দেওয়ার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এই ভবনগুলোর মধ্যে কারখানা ভবনের নির্মাণ ব্যয় মাত্র সাত বছরের মধ্যে ফেরত আসে এবং সেবা চার্জের মাধ্যমে সরকারের অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় হয়।
এছাড়া নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে নিয়োগকারীদের অবস্থানের জন্য ছোট পরিসরে ক্লাব নির্মাণ করা হয়। এই ক্লাবের রুমগুলো বিনিয়োগকারীদের কাছে ভাড়ায় বরাদ্দ দেওয়া হয়। মূলত এই কার্যক্রম বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং রপ্তানি বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামোকে শক্তিশালী করে।
জানা গেছে, মোংলা ইপিজেডের একটি দোতলা ক্লাব দীর্ঘদিন ধরে বিনিয়োগকারীদের এবং তাদের কর্মকর্তাদের থাকার জন্য ব্যবহৃত হতো। সম্প্রতি একটি চীনা কোম্পানি ২৬টি প্লট বরাদ্দ নেওয়ার সময় এই ক্লাব প্লটের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এখন এখানে নির্মাণকাজ শুরু হবে। ফলে ক্লাব ভবন ভেঙে নতুন ক্লাব ভবন নির্মাণ করতে হবে। তাই অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র বেপজার জন্য স্থগিত না করলে সবকিছুই থমকে থাকবে।
এরই মধ্যে চায়না কোম্পানি থাকার জন্য ক্লাব ভবনের মূল্য পরিশোধ করেছে এবং সেখানে নির্মাণকাজ শুরু করেছে। ফলে ক্লাব ভবনটি ভেঙে ফেলা হবে, যা নতুন ক্লাব ভবন নির্মাণকে অত্যন্ত জরুরি করে তুলেছে।
এছাড়া চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে অবস্থিত বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়নকাজ চলমান। সেখানে ইতিমধ্যে ৪১টি প্রতিষ্ঠান শিল্প স্থাপনের লক্ষ্যে বেপজার সঙ্গে চুক্তি করেছে। এ ছাড়া যশোর, পটুয়াখালী ও গাইবান্ধা জেলায় তিনটি নতুন ইপিজেড স্থাপনের কাজ চলছে, যা ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ বিনিয়োগের জন্য প্রস্তুত করা হবে।
বেপজা কর্তৃপক্ষ বলছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে কৃচ্ছ্রসাধনের উদ্দেশ্যে নতুন ভবন নির্মাণ বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হলেও বেপজা যেহেতু সরকারি তহবিল ব্যবহার না করে নিজস্ব তহবিল থেকে এই কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং সরাসরি আয় ও রাজস্ব সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে, তাই বেপজাকে এই পরিপত্রের আওতামুক্ত রাখা এবং নতুন কারখানা ভবন, বিনিয়োগকারীদের ক্লাব ও ভবন সম্প্রসারণের অনুমতি দেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন বলে চিঠিতে বলা হয়েছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, এক্ষেত্রে বেপজার বিশেষ অবস্থান বিবেচনা করে এবং সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির স্বার্থে অর্থ মন্ত্রণালয়ের উক্ত পরিপত্রের আওতা থেকে বেপজাকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে বিশেষ অনুরোধ জানানো হয়েছে। কর্তৃপক্ষ আশা করছে, অর্থ বিভাগ জরুরি ভিত্তিতে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবে।
জানা গেছে, দেশের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকাগুলোয় (ইপিজেড) চীনা বিনিয়োগকারীরা এ পর্যন্ত ১০৭টি শিল্পকারখানা স্থাপন করেছে। এসব কারখানা স্থাপনে তারা মোট বিনিয়োগ করেছে ১৬০ কোটি মার্কিন ডলার। আর কারখানাগুলোয় কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৩৩ হাজার বাংলাদেশি নাগরিকের।
ইপিজেডগুলোয় চীনসহ বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে বেপজা। কারণ বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত। এর ফলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাজারে সহজে প্রবেশাধিকার পাওয়া যায়। এই সুযোগই কাজে লাগাতে চাইছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি আদেশ তার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বেপজা কর্তৃপক্ষ বলছে, বাংলাদেশে বিনিয়োগের মূল আকর্ষণ হলো সস্তা ও সহজে প্রশিক্ষণযোগ্য শ্রমশক্তি। এখানে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম। অন্যদিকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের বিনিয়োগ নীতিগুলো ক্রমাগত উদার করা হচ্ছে।
এ ছাড়া বেপজায় এক দরজায় সেবার (ওএসএস) মাধ্যমে ইপিজেডগুলোয় বিনিয়োগকারীদের জন্য শিল্প স্থাপন ও সেগুলো পরিচালনা সহজ করা হয়েছে। ফলে বিনিয়োগকারীরা এসব সুবিধা নিয়ে তাদের ব্যবসাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেন।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের কতিপয় ব্যয় স্থগিত বা হ্রাসকরণ ও বিদেশভ্রমণ সীমিতকরণ বিষয়ে অর্থ বিভাগের পরিপত্রে যা বলা হয়েছে, বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের লক্ষ্যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সব মন্ত্রণালয়/বিভাগ/অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এবং আওতাধীন অধিদপ্তর/পরিদপ্তর/দপ্তর/স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, পাবলিক সেক্টর করপোরেশন এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানিসমূহের পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটে কতিপয় খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ে সরকার নিম্নোক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
এর মধ্যে সব ধরনের থোক বরাদ্দ ব্যয় বন্ধ থাকবে; পেট্রোল, অয়েল ও লুব্রিকেন্ট এবং গ্যাস ও জ্বালানি খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ ব্যয় করা যাবে। পরিচালন বাজেটের আওতায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট স্থাপনা ব্যতীত নতুন আবাসিক/অনাবাসিক/অন্যান্য ভবন স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ থাকবে। তবে চলমান নির্মাণকাজ ন্যূনতম ৭০ শতাংশ সম্পন্ন হয়ে থাকলে অর্থ বিভাগের অনুমোদনক্রমে ব্যয় নির্বাহ করা যাবে।
সব ধরনের যানবাহন ক্রয় মোটরযান, জলযান, আকাশযান খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় বন্ধ থাকবে। তবে, ১০ বছরের অধিক পুরোনো টিওঅ্যান্ডইভুক্ত যানবাহন প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের অনুমোদনক্রমে ব্যয় নির্বাহ করা যাবে। ভূমি অধিগ্রহণ খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় বন্ধ থাকবে।
আপনার মতামত লিখুন :