জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠেছে ঢাকার বাতাস। বর্তমান বিশ্বে বায়ুদূষণের শীর্ষে রয়েছে ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি শহর। জনস্বার্থে বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় ‘এয়ার পিউরিফায়ার’ কিনতে গতকাল মঙ্গলবার শুল্ক হ্রাস করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
বায়ুদূষণ প্রতিরোধে শুল্ক-কর কমলেও জীবন রক্ষাকারী ওষুধে হ্রাস হচ্ছে না। ফলে ১৩ বছরের শীর্ষে থাকা মূল্যস্ফীতির মধ্যে ওষুধের ব্যয় আরও বাড়বে। উচ্চমূল্যের খাদ্যের ব্যয় সামাল দিতে গিয়ে ভোক্তার ওষুধ কিনতে পড়বে অর্থের টান।
একই সঙ্গে মোবাইল ফোনের গ্রাহকদের ঘাড়ে আরও চেপেছে নতুন শুল্কহার, যার কারণে গ্রাহক ১০০ টাকায় পাচ্ছেন ৫৯ টাকার মোবাইল টকটাইম সেবা, যা আগে ব্যবহারযোগ্য ছিল ৬১ টাকা। নুতন করে আরোপিত শুল্কহারে নাগরিক জীবনের ব্যয় বাড়ছে। একই সঙ্গে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে পড়ছে খাদ্যের টান।
তবে অন্তর্বর্তী সরকার শুল্কহার রিভিউ করার আভাস দিলেও জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ও মোবাইল ফোনের টকটাইমে ভ্যাট প্রত্যাহার হচ্ছে না। কারণ, উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেওয়া শর্ত ভঙ্গ হবে।
যার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এনবিআর কর্তৃপক্ষ চাইলেও আট পণ্যের ভ্যাট প্রত্যাহার করতে পারছে না সরকার। অন্যান্য খাতের শুল্কহার কমালেও জীবন রক্ষাকারী ওষুধসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতের ব্যয় কমাতে ব্যর্থ।
দুই অঙ্কের কোঠায় মূল্যস্ফীতির সময়ে ৯ জানুয়ারি বাড়ানো হয়েছে শুল্কহার। যদিও প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে তিনটি খাতের মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট পূর্বের অবস্থায় আনা হয়েছে।
মোটর ওয়ার্কশপ খাতের ভ্যাট গত সোমবার প্রত্যাহার করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে এনবিআর। রাজস্ব কর্তৃপক্ষ জানায়, ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে এলে রাজস্ব আহরণ কমবে। এতে আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাটির দেওয়া শর্ত ভঙ্গ হবে এবং বাংলাদেশে ঋণ কার্যক্রমও বাধাগ্রস্ত হবে।
তার আগে হোটেল-রেস্তোরাঁর মালিক-কর্মচারীদের আন্দোলনের মুখে পিছু হটে সরকার। একই সঙ্গে তথ্য ও প্রযুক্তিনির্ভর সেবার ই-বুকের স্থানীয় সরবরাহ ও আমদানি পর্যায়ে সমুদয় মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট অব্যাহতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে এনবিআর।
এনবিআর জানায়, গত ৯ জানুয়ারি অধ্যাদেশ জারি করে ওয়ার্কশপ খাতে ভ্যাট বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছিল। ওয়ার্কশপ খাতে ভ্যাট প্রত্যাহার করে আগের অবস্থায় ১০ শতাংশে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
মূসক প্রত্যাহার সম্পর্কে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, ভ্যাট আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ, ওয়ার্কশপে ভ্যাট ১০ শতাংশই থাকছে। এর আগে গত ১৬ জানুয়ারি হোটেল, রেস্তোরাঁ খাতে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে।
নতুন করে গতকাল মঙ্গলবার বায়ুদূষণ প্রতিরোধে এয়ার পিউরিফায়ারের মতো কার্যকর বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের সরঞ্জাম সহজলভ্য করতে আমদানিতে বিদ্যমান কাস্টমস শুল্ক কমানো হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বে বায়ুদূষণের শীর্ষে থাকা শহরের তালিকায় ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি শহরের নাম রয়েছে।
বায়ুদূষণে জনস্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতিসহ জনগণের প্রভূত আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। সেই প্রেক্ষাপটে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের সরঞ্জাম সহজলভ্য করতে এয়ার পিউরিফায়ারের আমদানিতে বিদ্যমান কাস্টমস শুল্ক (সিডি) ২৫ শতাংশ হ্রাস করে ১০ শতাংশ এবং ৩ শতাংশ রেগুলেটরি শুল্ক (আরডি) ও ৫ শতাংশ আগাম কর (এটি) থেকে অব্যাহতি প্রদান করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।
জনস্বার্থে এয়ার পিউরিফায়ার আমদানিতে বিদ্যমান মোট করভার ৫৮ দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ৩১ দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারিত হয়।
এনবিআর জানায়, জারি করা প্রজ্ঞাপনের ফলে প্রতিটি এয়ার পিউরিফায়ারের আমদানি খরচ প্রকারভেদে ১ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত হ্রাস পাবে।
এদিকে, মোবাইল ফোন ব্যবহারের ওপর সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৩ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে এখন থেকে মোবাইল ফোন ব্যবহারের খরচে সম্পূরক শুল্ক, ভ্যাট ও সারচার্জ ৩৯ শতাংশের পরিবর্তে ৪২ দশমিক ৪৫ শতাংশের বেশি দিতে হবে। একই সঙ্গে প্রায় ১০০টি পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।
দুই অঙ্কের কোঠায় অবস্থান নিয়ে চলতি বছরে ১৩ বছরের শীর্ষে রয়েছে মূল্যস্ফীতি। একই সঙ্গে রয়েছে বাণিজ্য ঘাটতি, যদিও জানুয়ারি মাসে সামান্য কমেছে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, আপাতত মূল্যস্ফীতি কমছে না এবং জিডিপির হারও কমে ৪ দশমিক ১ শতাংশে নেমেছে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতিকালে সরকার অবিবেচকভাবে নতুন করারোপ করেছে বলে জানান সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ও শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখে আশ্চর্য হয়েছি, অবিবেচকভাবে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। কর সংগ্রহ করতে হলে ক্রমান্বয়ে প্রত্যক্ষ কর প্রদানকারীর কাছে যেতে হয়। আমরা প্রত্যক্ষ কর আহরণে কোনো পরিকল্পনা দেখি নাই।’
ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে দেবপ্রিয় বলেন, দেশের প্রবৃদ্ধির হার কমে যাচ্ছে। এটা যে পরিবর্তন হবে, তার কোনো সম্ভাবনা নেই। এরই মধ্যে আমরা মধ্যমেয়াদি ফাঁদে আটকা পড়েছি। প্রত্যক্ষ কর না বাড়িয়ে অবিবেচকভাবে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে।
তবে ওষুধ, মোবাইল ফোনের টকটাইমসহ আট পণ্য ও সেবায় নতুন আরোপিত ভ্যাট-কর প্রত্যাহারের কথা ভাবলেও পারছে না সরকার। আইএমএফ বলেছে, ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে এলে রাজস্ব আহরণ কমবে। এতে আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাটির দেওয়া শর্ত ভঙ্গ হবে এবং বাংলাদেশের ঋণ কার্যক্রমও বাধাগ্রস্ত হবে।
আট পণ্য ও সেবার মধ্যে আরও আছে- ইন্টারনেট সার্ভিস প্রভাইডার (আইএসপি) সেবা, ব্র্যান্ড ও নন-ব্র্যান্ডের পোশাক, নন-এসি হোটেল, ফল ও ফলের জুস, এলপি গ্যাস ও মিষ্টি।
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট সামাল দিতে ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি ৪৭০ কোটি (৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন) ডলারের ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফ। সেজন্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নানা সংস্কারের শর্ত বাংলাদেশকে বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে। রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতির মুখে পড়েছে সরকার। অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪২ হাজার কোটি টাকা পিছিয়ে।
খরচ বেড়েছে যেসব পণ্যের: প্রায় ১০০ পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। এছাড়া টিস্যু, আঙুর, আপেল, তরমুজ, তৈরি পোশাক, মিষ্টি, এলপি গ্যাস, হোটেল (নন-এসি) ভাড়া ও চশমার মতো পণ্যের ওপর নতুন ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্কহার কার্যকর করা হয়েছে।
তার সঙ্গে বিস্কুট ও কেক, আচার ও টমেটো সস, কাপড়, দর্জির দোকান, টয়লেট টিস্যু, ন্যাপকিন ও টাওয়েল, মিষ্টি, ড্রাইভিং লাইসেন্স, নন-এসি হোটেল, চশমা, সানগ্লাস ও লুব্রিকেন্ট তেলের ওপর ৫ শতাংশের পরিবর্তে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ভ্যাট দিতে হবে।
এনবিআর জানায়, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, বৈদ্যুতিক খুঁটি, স্টিলের কোল্ড রোল্ড কয়েল, চুনাপাথর ও ডলোমাইটের মতো কয়েকটি শিল্পপণ্যের ভ্যাটও ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বাণিজ্যিক পর্যায়ে ওষুধের ওপর ভ্যাট বাড়ানোর কারণে ওষুধের দামও বাড়ে। এ ক্ষেত্রে ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে।
১০ শতাংশ থেকে ভ্যাট বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার কারণে মুদ্রণ, সিনেমার টিকিট, মেরামত ও সার্ভিসিং এবং পরিচ্ছন্নতা সেবার খরচও বাড়ে। উড়োজাহাজের টিকিটের ওপর আবগারি শুল্ক বাড়ানোয় আকাশপথে যাত্রার খরচও বেড়েছে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ওপর ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করায় ইন্টারনেট বিলও বাড়তে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত বাড়ানো তথ্য আসেনি।
শুল্কহার বৃদ্ধির বিষয়ে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সভাপতি এমদাদুল হক বলেন, ভ্যাট বাড়ায় বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে আমরা কীভাবে টিকে থাকব, তা নিয়ে ভাবছি।
তিনি আরও বলেন, আইএসপি সেবার মান আরও খারাপ হবে। আমরা সরকারকে এ ধরনের পদক্ষেপ পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানাই। কারণ, এতে শুধু ব্যবসার ক্ষতি হবে না, সেবার মান কমবে এবং গ্রাহকদের খরচও বাড়বে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানো নজিরবিহীন। এর আগে এমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, এই বর্ধিত ভ্যাট ও শুল্ক কম প্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর প্রভাব ফেলবে। কিন্তু এর প্রভাব ভোক্তাদের ওপরই পড়বে।
আপনার মতামত লিখুন :