জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হতাহতদের পুনর্বাসনসহ, অভ্যুত্থানের ইতিহাস ও স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ, গবেষণা এবং অভ্যুত্থানের চেতনা সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে গঠন করা হচ্ছে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান অধিদপ্তর’।
অধিদপ্তরটিকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত করতে ‘এলোকেশন অব বিজনেস অ্যাক্ট’ সংশোধনও চূড়ান্তের পথে। অধিদপ্তরটির জনবলকাঠামো অনুমোদনের জন্যও পাঠানো হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। সব প্রক্রিয়া শেষে আগামী মাসেই অধ্যাদেশের মাধ্যমে অধিদপ্তরটি ঘোষণা করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, এই অধিদপ্তর গঠনে সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত কাজ করছে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে অধিদপ্তটির ঘোষণা করা হতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের তালিকা তৈরি এবং তাদের পরিবারকে সহায়তা, আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস ও স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ করতে দায়িত্বশীল কোনো উইং বা দপ্তর না থাকায় হিমশিম খেতে হচ্ছে সরকারকে। পাশাপাশি এই গণঅভ্যুত্থানের আদর্শ এবং চেতনাও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচার করা সম্ভব হচ্ছে না। বিক্ষিপ্তভাবে সরকারের বিভিন্ন উইংয়ের মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থান-সংশ্লিষ্ট এসব কাজ করতে গিয়ে জগাখিচুড়ি অবস্থা হচ্ছে। অন্যদিকে অভ্যুত্থানে হতাহতদের চিকিৎসাসহ পুনর্বাসনের জন্য গঠন করা জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের আচরণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র-জনতার সংগঠন জাতীয় নাগরিক কমিটি। গতকাল এক চিঠিতে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তালাভে বিলম্ব ও দীর্ঘসূত্রতা, সাহায্যলাভের জন্য যে আবেদন করা হয় তার ফলাফল সম্পর্কে স্পষ্টতার অভাব, ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের মধ্যে সহানুভূতি, পেশাদারিত্বপূর্ণ মনোভাবের অভাব এবং চিকিৎসাসেবা সম্পর্কিত অসন্তুষ্টির কথা জানায় জাতীয় নাগরিক কমিটি। এই সংকট দূর করতেই মূলত জুলাই গণঅভ্যুত্থান অধিদপ্তর করতে চায় সরকার।
এই অধিদপ্তর গণঅভ্যুত্থানে শহিদ ও আহত ছাত্র-জনতার চূড়ান্ত তালিকা তৈরি গণঅভ্যুত্থানে শহিদ পরিবার ও আহত ছাত্র-জনতার কল্যাণে কাজ করবে। এরই মধ্যে গণঅভ্যুত্থানে যেসব শহিদের নাম গেজেটভুক্ত হয়েছে, তাদের পরিবারকে পুনর্বাসন ও ভাতা প্রদান করবে। গেজেটের বাইরে আর কোনো নিহত থাকলে তাদেরও গেজেটভুক্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। চূড়ান্ত তালিকা করা হবে আহতদেরও। শুধু হতাহতদের কল্যাণ নয়, গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস ও স্মৃতি সংরক্ষণ এবং গবেষণার কাজও করবে অধিদপ্তর। সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেবে এই গণঅভ্যুত্থানের আদর্শ।
এছাড়া ৫ আগস্টকে জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস হিসেবে ঘোষণা করতে চায় সরকার। এই দিবস ঘোষণা করা হলে দিবসটি পালনে সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে অধিদপ্তরটি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের সংশ্লিষ্ট এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান-সংশ্লিষ্ট সব কাজই এই অধিদপ্তরের মাধ্যমে করতে চায় সরকার। বিচ্ছিন্নভাবে এসব করতে গিয়ে নানা সমস্যা হচ্ছে। এসব সমস্যা দূর করতেই দ্রুতগতিতে অধিদপ্তর তৈরির প্রক্রিয়াগত কাজ চলছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এই অধিদপ্তর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন করার জন্য এলোকেশন অব বিজনেস অ্যাক্ট সংশোধন করা প্রয়োজন। এরই মধ্যে এই অ্যাক্ট সংশোধন করার জন্য প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটির মিটিংয়ে অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। এই অনুমোদনের পর চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে। এরপর আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায়ও অধিদপ্তর গঠনের বিষয়ে অনুমোদন দেওয়া হয়। এছাড়া এই অধিদপ্তরের জনবলকাঠামো অনুমোদন দেওয়ার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
সূত্র জানায়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ৬৩টি জনবলকাঠামো অনুমোদনের জন্য সাংগঠনিক কাঠামোর (অর্গানোগ্রাম) মাধ্যমে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এছাড়া অধিদপ্তর মনিটরিংয়ে ২৭টি জনবল নিয়ে একটি পৃথক ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান অনুবিভাগ’ গঠনের প্রস্তাব পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়। তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কিছুটা কাটছাঁট করছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় জনকাঠামো চূড়ান্ত করলে নথি পাঠানো হবে অর্থ মন্ত্রণালয়ে। এরপর বাকি প্রক্রিয়া শেষ হলে জনবল নিয়োগ দেওয়া হবে। সূত্র জানায়, দুই বিভাগে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯০ জনের বেতন সাড়ে ৩ কোটি টাকা। বাকি ৭ কোটি টাকা অধিদপ্তর ও অনুবিভাগ নির্মাণে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয়ে ব্যয় হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদ পরিবার ও আহতদের ৬৩৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পর্যায়ক্রমে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রত্যেক শহিদ পরিবার ৩০ লাখ করে টাকা পাবে। এর মধ্যে ১০ লাখ টাকা এফডিআর। আগামী অর্থবছরের শুরুতে জুলাই মাসে বাকি ২০ লাখ টাকা দেওয়া হবে। আহতদের সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা দেওয়া হবে। আগামী জুলাই থেকে প্রতি মাসে শহিদ পরিবার ও আহতরা মাসিক ভাতা পাবেন। এর মধ্যে চলতি মাসে ২৩২ কোটি ৬০ লাখ টাকা দেওয়া হবে। বাকি টাকা দেওয়া হবে আগামী অর্থবছরে। আর এসব কর্মকাণ্ড পরিচালিত করবে অধিদপ্তর।
এছাড়া অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার জন্য একটি আইন প্রয়োজন। বর্তমানে সংসদ না থাকায় অধ্যাদেশের মাধ্যমে অধিদপ্তরটি প্রতিষ্ঠান বিষয়ে পক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, সংবিধান অনুযায়ী অধ্যাদেশের মাধ্যমে জুলাই গণঅভ্যুত্থান অধিদপ্তর গঠন করা হতে পারে।
এদিকে ইতিমধ্যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সারা দেশে ৮৩৪ শহিদের নাম উল্লেখ করে গেজেট প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এতে প্রত্যেকের নামের পাশে মেডিকেল কেস আইডি অন্তর্ভুক্ত করে তালিকা করা হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকার যাচাই-বাছাই শেষে শহিদদের নাম প্রকাশ করে প্রথম গেজেট হলো।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা যাচাই-বাছাই করে ৮৩৪ জনের নাম তালিকাভুক্ত করেছি। এর বাইরে আর কেউ নিহত থাকলে তা যাচাই করে তালিকাভুক্ত করবে প্রস্তাবিত জুলাই গণঅভ্যুত্থান অধিদপ্তর। এছাড়া আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকাও চূড়ান্ত করবে এই অধিদপ্তর।
সার্বিক বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান অধিদপ্তর গঠনে কাজ এগিয়ে চলছে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো (অর্গানোগ্রাম) পাঠানো হয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান অনুবিভাগও গঠনের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। আশা করছি দ্রুত অধিদপ্তরটি গঠন করা হবে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সমন্বয়ক এবং বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেছেন, আগামী মাসে প্রতিষ্ঠিত হবে জুলাই গণঅভ্যুত্থান অধিদপ্তর। এই অধিদপ্তর গণঅভ্যুত্থানে আজীবন শহিদ পরিবারকে সহায়তা ও আহতদের পুনর্বাসন করবে।
প্রসঙ্গত, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে এপ্রিলের শেষ দিকে আন্দোলনে নামেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে এই কোটা সংস্কার আন্দোলন জুনের প্রথম সপ্তাহে ছড়িয়ে পড়ে দেশের সব পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং বড় কলেজগুলোতে। আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে নিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী সরকার দমন-নিপীড়ন শুরু করলে তা উল্টো রূপ নেয় অসহযোগ আন্দোলনে। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও নেমে আসে রাজপথে। আন্দোলনের একপর্যায়ে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পলিয়ে যেতে বাধ্য হন। এর তিন দিন পর নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এরপর আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা, হতাহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নেয় সরকার। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনকে জাদুঘর করার উদ্যোগও নেওয়া হয়।
এছাড়া জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হতাহতদের পরিবারকে সহায়তার জন্য গঠন করা হয়েছে জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন। আন্দোলনে নিহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে ফাউন্ডেশন কাজ করছে।
গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি ও কোটা সংস্কার আন্দোলনে শহিদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের যমজ ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধকে সাধারণ সম্পাদক করে সংস্থাটির সাত সদস্যের কার্যনির্বাহী পরিষদ গঠন করা হয়। ২১ অক্টোবর ফাউন্ডেশনের দ্বিতীয় সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলমকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। এত দিন সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসা মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধকে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যদিও গতকাল সারজিস আলম সাধারণ সম্পাদক থেকে পদত্যাগ করেছেন বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
অন্যদিকে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আহত ও শহিদ পরিবারের সঙ্গে জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের আচরণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। গতকাল বুধবার ফাউন্ডেশন বরাবর জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও দপ্তর সেলের সম্পাদক মনিরা শারমিনের পাঠানো এক চিঠিতে এ তথ্য জানানো হয়।
চিঠিতে বলা হয়, মাসের পর মাস অপেক্ষা করেও কোনো আর্থিক সহায়তা পাননি অনেক আবেদনকারী। এই বিলম্ব আহত ও শহিদ পরিবারের জন্য হয়রানি ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে বলে মনে করে জাতীয় নাগরিক কমিটি। ফাউন্ডেশনের হেল্প লাইনে বা অফিসে এসে সরাসরি যোগাযোগের সময় অশোভন ও অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণের অভিযোগও পাওয়া গেছে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, অনেক আহত ব্যক্তি জানিয়েছেন, তারা এমআইএস ভেরিফিকেশন তালিকায় নেই। ফলে তাদের সহায়তা পাওয়ার যোগ্যতা নিয়ে বিভ্রান্তি, দীর্ঘসূত্রতা ও উদ্বেগ সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া, আর্থিক সংকটের কারণে অনেকে হাসপাতালে যেতে কিংবা ওষুধ কিনতে পারছেন না বলেও জানা গেছে। এ বৈষম্য কী কারণে ঘটছে এবং কীভাবে এগুলো সমাধান করা হবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রার্থনা করছি।
আপনার মতামত লিখুন :