ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০২৫

আতঙ্কে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসীরা

মো. সায়েম ফারুকী

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৩, ২০২৫, ১২:৫৮ এএম

আতঙ্কে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসীরা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন রিপাবলিকান নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প। শপথ নিয়েই বইয়ে দিয়েছেন নির্বাহী আদেশের ঝড়।

এসব আদেশের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সীমানা সম্প্রসারণ, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেওয়া, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেওয়া, জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের বিধান বাতিল, অভিবাসীদের সংখ্যা কমানো ইত্যাদি।

এসব নির্বাহী আদেশের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের বিধান বাতিল ও অভিবাসী সংক্রান্ত আদেশ নিয়ে। এর ফলে এখন থেকে ৩০ দিন পর যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া অবৈধ অভিবাসীদের সন্তানেরা দেশটির নাগরিকত্ব পাবে না। তবে ইতিমধ্যে এই নির্বাহী আদেশের বিরুদ্ধে ২৪টি রাজ্য ও শহরে মামলা হয়েছে। পাশাপাশি আতঙ্কে রয়েছেন নথিপত্রহীন অবৈধ অভিবাসীরা। নথিপত্রহীন বাংলাদেশিরাও একইভাবে রয়েছেন দুশ্চিন্তায়। গত ২০ জানুয়ারি ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের পর থেকে নথিপত্রহীন অভিবাসীদের ধারপাকড়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে অভিযান শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে নিউইয়র্কের ব্রুকলিন বরোর ফুলটন এলাকা থেকে ৪ বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করেছে ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস ইনফোর্সমেন্ট (আইস)। 
ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার দ্বিতীয় দিনেই যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে শুরু হয়েছে ধরপাকড়। নিউইয়র্কের ব্রুকলিনের ফুল্টন এলাকা থেকে নথিবিহীন ৪ বাংলাদেশিকে আটক করার খবর পাওয়া গেছে। সাদা পোশাকের ইমিগ্রশেন পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে যায়। এ ছাড়া প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পরই মেক্সিকো সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপের নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন ট্রাম্প।

পাশাপাশি জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব দেওয়ার বাইডেনের নির্বাহী আদেশ স্থগিত করে দিয়েছেন তিনি। ট্রাম্পের এই অভিবাসননীতির বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেছেন অভিবাসীরা। এই আদেশের আওতায় অভিবাসীদের বৈধতা দেওয়ার একটি প্রকল্পও বন্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত কর্তৃপক্ষ। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অ্যাটর্নি রাজু মহাজন। তিনি বলেন, ট্রাম্পের বেশ কয়েকটি নির্বাহী আদেশে বাংলাদেশিরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। যাঁরা ব্রাজিল, আর্জেন্টিনাসহ দক্ষিণ আমেরিকার পথ ধরে মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে ঢুকতেন, সেই পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। আগে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যকে গুরুত্ব দেওয়া হতো। সে হিসেবে অভিবাসীরা বিভিন্ন জায়গায় চাকরির ব্যাপক সুযোগ পেয়েছেন। এখন থেকে মেধার ভিত্তিতে সেসব নিয়োগ নির্ধারিত হবে। ফলে ছাঁটাই হতে পারেন অসংখ্য বাংলাদেশি।  বাঙালি অধ্যুষিত এলাকার সড়ক ও রেস্তোরাঁয় যেখানে অসংখ্য মানুষের ভিড় দেখা যেত, এখন সেখানে লোকজনের ভিড় নেই বললেই চলে। ইতিমধ্যে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকারে কড়া বিধিনিষেধ আরোপের নির্বাহী আদেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে ডেমোক্র্যাট নিয়ন্ত্রিত ২২টি অঙ্গরাজ্য ও নাগরিক অধিকার সংগঠন। ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে আইনি উপায়ে মোকাবিলা করতে গত মঙ্গলবার আদালতে একাধিক মামলা দায়ের করা হয়।

ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেল আন্দ্রেয়া জয় ক্যাম্পবেল তার কার্যালয় থেকে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলেছেন, অভিবাসনের ওপর ট্রাম্পের কঠোরতা হ্রাস করতে এসব মামলা করা হয়েছে। তার আদেশ বাস্তবায়িত হলে আধুনিক মার্কিন ইতিহাসে প্রথমবার বছরে দেড় লাখ শিশু নাগরিকত্ববঞ্চিত হবে।

ক্যাম্পবেল বলেছেন, কারো সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার অধিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেই।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শপথ অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত অতিক্রম করে লাখ লাখ অনুপ্রবেশকারী নির্দ্বিধায় যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। সীমান্তে প্রবেশ প্রথমেই বন্ধ করা হবে। তারপর বের করে দেওয়া হবে অপরাধীদের। ট্রাম্পের সেই নির্দেশনা অনুযায়ী ইতিমধ্যে মেক্সিকো সীমান্তে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। রাখা হয়েছে নিñিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থা।

এদিকে পানামা খাল দখল সংক্রান্ত একটি নির্বাহী আদেশে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বাক্ষর করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বরাবর চিঠি দিয়েছেন পানামার প্রেসিডেন্ট জোসে রাউল মুলিনো। চিঠিতে রেফারেন্স হিসেবে জাতিসংঘ সনদের একটি অনুচ্ছেদ উল্লেখ করেছেন মুলিনো। ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের কোনো সদস্য রাষ্ট্র অপর সদস্য রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অখণ্ডতা এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে হুমকি-ধমকি বা বলপ্রয়োগ করতে পারবে না। পাশাপাশি এ বিষয়টি জাতিসংঘের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর অঙ্গসংস্থা নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপনের জন্যও মহাসচিবকে অনুরোধ করা হয়েছে।

এদিকে মধ্যপ্রাচ্য সফরের বিষয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, আমরা মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার কথা ভাবছি। তবে তা এখনই নয়। তিনি আরো বলেন, আমি এখানে না থাকলে, তারা (জিম্মি) কখনোই ফিরে আসত না। তবে হামাসের হাত থেকে মুক্ত ইসরায়েলি বন্দিদের জন্য দুঃখও প্রকাশ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

আরব কূটনীতিকরাও টাইমস অব ইসরায়েলকে বলেছেন, এই চুক্তি চূড়ান্ত করতে ট্রাম্প ও তার মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বিশেষ করে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ওপর চাপ প্রয়োগ করে। এ বিষয়ে ট্রাম্প বলেন, বাইডেন এটি করতে পারেননি। আমি যে সময়সীমা নির্ধারণ করেছিলাম, তার কারণেই এটি সম্পন্ন হয়েছে।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বসবাসরত ১৮ হাজার অবৈধ নাগরিককে শনাক্ত করে দেশে ফিরিয়ে নিতে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করতে ভারত প্রস্তুত বলে জানা গেছে। নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে সহযোগিতা করতে এবং বাণিজ্য যুদ্ধ এড়াতেই নয়াদিল্লির এই পদক্ষেপ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ইতিমধ্যে প্রায় ১৮ হাজার অবৈধ ভারতীয় অভিবাসীকে শনাক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ জন্য ভারত তাদের পরিচয় যাচাই করে শীঘ্রই দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু করবে বলে সংশ্লিষ্টরা এমনটি জানিয়েছেন।

পরিচয় প্রকাশ না করে তারা জানান, যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বসবাসরত ভারতীয়দের সংখ্যা ১৮ হাজারের অনেক বেশি হতে পারে। কারণ এটি স্পষ্ট নয় যে কতজন অবৈধ ভারতীয় অভিবাসী যুক্তরাষ্ট্রে বাস করছেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসীদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পশ্চিম ভারতের, বিশেষ করে পাঞ্জাব ও গুজরাট রাজ্যের।

যুক্তরাষ্ট্রে ‘সংবেদনশীল স্থাপনা’ থেকে অভিবাসীদের আটকের বিষয়ে সব বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করা হয়েছে। মঙ্গলবার (২১ জানুয়ারি) জারি হওয়া এই নির্দেশনার কারণে এখন থেকে শিক্ষাঙ্গন, গির্জা ও হাসপাতাল থেকেও অভিবাসীদের আটক করতে পারবে অভিবাসন কর্তৃপক্ষ। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান এ খবর জানিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের জননিরাপত্তা সংক্রান্ত অধিদপ্তর হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, গ্রেপ্তার এড়াতে অপরাধীরা আর গির্জা ও বিদ্যালয়ে লুকিয়ে থাকার সুযোগ পাবে না। ট্রাম্প প্রশাসন আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাত বেঁধে না রেখে তাদের বিবেকের ওপর আস্থা রাখবে। এক দশকের বেশি সময় ধরে এসব স্থান থেকে কোনো অভিবাসীকে আটক করতে পারত না ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই) এবং কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রটেকশন। হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এ দুটি সংস্থার তত্ত্বাবধানে রয়েছে।

দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম কর্মদিবস শেষে ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ থেকেই চীনা পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবেন। তিনি বলেন, চীন থেকে যেসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আসে, সেসব পণ্যের ওপর আগামী ১ ফেব্রুয়ারি থেকে অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। এর আগে নির্বাচনী প্রচারের সময় ট্রাম্প চীনা পণ্যের ওপর ৬০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে ক্ষমতায় বসার পর তিনি সেই তুলনায় অনেক কম শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিলেন। এমনকি চীনা পণ্যের ওপর ট্রাম্প যে শুল্ক আরোপ করলেন, তা কানাডা ও মেক্সিকোর পণ্যের ওপর জারি করা শুল্কের চেয়েও কম। ওই দুই দেশের পণ্যের ওপর ট্রাম্প ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন।

আরবি/জেডআর

Link copied!