‘ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’ নামে একটি অধ্যাদেশের খসড়া নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ। এই অধ্যাদেশের ওপর অংশীজনসহ সাধারণ মানুষের থেকে মতামত চেয়ে অনুরোধ করেছে ওই বিভাগ। তবে ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সেই অধ্যাদেশের খসড়াটি ভুল বলে জানা গেছে।
আইসিটি বিভাগ বলছে, অংশীজনদের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে তা খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত করে পুনরায় সংশ্লিষ্টদের নিয়ে কর্মশালা অনুষ্ঠিত হবে। অবশ্য প্রকাশিত খসড়ায় নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট সাপেক্ষে ব্যক্তিগত উপাত্ত দেশের বাইরে স্থানান্তরের সুযোগের উপস্থিতি প্রযুক্তি খাত সংশ্লিষ্টদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। যদিও আইসিটি বিভাগ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রুতই সঠিক খসড়া প্রকাশিত হবে।
আওয়ামী লীগের সময়েই ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষায় আইন তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ২০২৩ সালের নভেম্বরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা এই আইনের খসড়া অনুমোদন করেছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ঠিক আগ মুহূর্তে গত বছরের ১৬ জুলাই তৎকালীন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক জানিয়েছিলেন, খসড়াটি ‘ভেটিং’ পর্যায়ে আছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে জনমত গ্রহণের জন্য চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশের লক্ষ্যমাত্রা ছিল বলেও সে সময় জানিয়েছিলেন পলক। এই আইনের প্রতি সবার আগ্রহ থাকলেও তথ্যপ্রযুক্তি এবং সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের ছিল বিশেষ প্রত্যাশা। নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য দেশের অভ্যন্তরেই সংরক্ষণ বা মজুদ করা হবে এবং কোনোভাবেই সেটি দেশের বাইরে স্থানান্তর করা হবে না বলে আশাবাদ ছিল বিশেষজ্ঞদের। এমন পটভূমিতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছেও একইরূপ প্রত্যাশা রাখছেন তারা।
তবে ওয়েবসাইটে প্রকাশিত খসড়ার ৪৬ এবং ৪৭ ধারার প্রস্তাবিত বিধান খাত সংশ্লিষ্টদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। ধারা ৪৬-এ বলা হয়েছে যে, ধারা ৪৭-এর বিধান সাপেক্ষে, বিধি দ্বারা শ্রেণীকৃত ব্যক্তিগত উপাত্ত বাংলাদেশে মজুদ করতে হবে। আবার ৪৭ ধারায় বলা হয়েছে, ধারা ৫-এ বর্ণিত ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষার নীতির আলোকে প্রণীত বিধি অনুসরণক্রমে-ক) ধারা ৪৬-এ বর্ণিত কোনো ব্যক্তিগত উপাত্ত আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বা সরকার কর্তৃক নির্দিষ্টকৃত অন্য কোনো বিষয়ের প্রয়োজনে এই অধ্যাদেশের অধীন বাংলাদেশের বাইরে; এবং খ) দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক বা বহুপক্ষীয় চুক্তি কনভেনশন বা ফোরামের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ পারস্পরিক সমতার নীতির আওতায় যেকোনো সদস্য রাষ্ট্র থেকে কোনো ব্যক্তিগত উপাত্ত বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশ থেকে কোনো ব্যক্তিগত উপাত্ত অন্য কোনো দেশে স্থানান্তর করা যাবে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট এবং শর্তসাপেক্ষে বাংলাদেশি নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য দেশের বাইরে স্থানান্তর করার সুযোগ থাকছে খসড়া অধ্যাদেশে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডাটা বা উপাত্ত ভৌগোলিক সীমানার বাইরে স্থানান্তর করা হলে, গ্রহণকারী সত্তার পক্ষে সেই উপাত্ত সংরক্ষণ করাও সহজ। বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্যের নামে খুব সহজেই ব্যক্তিগত উপাত্ত দেশের বাইরে নেওয়া যাবে। কারণ ইন্টারনেটকেন্দ্রিক যোগাযোগ এবং বাণিজ্য অনেক ক্ষেত্রেই আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিষয়।
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বেসিসের সাবেক সভাপতি ও টেকসই অর্থনীতির ভিত তৈরিতে গঠিত টাস্কফোর্সের সদস্য ফাহিম মাশরুর রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে উপাত্ত আমাদের দেশের ভেতরে রাখা আসলে চ্যালেঞ্জিং। কারণ বিদেশি টেক জায়ান্টগুলোর বাংলাদেশে সার্ভার নেই। ফেসবুক, গুগল, ইউটিউবের মতো প্রতিষ্ঠানের ভারতেও সার্ভার আছে, কিন্তু বাংলাদেশে নেই। এখন আইন করে উপাত্ত দেশেই রাখার বাধ্যবাধকতা দেওয়া হলে টেক জায়ান্টগুলো তো সেটা মানবে না। তারা হয়তো তখন আমাদের আর সার্ভিস দেবে না। এতে তো আমাদেরই ক্ষতি হবে। ঠিক এমন একটি কারণে দেশে ‘পে-পাল’ (অনলাইন পেমেন্ট সার্ভিস) আসেনি। এতে ক্ষতি কাদের হয়েছে? আমাদের। আমার মনে হয়, যদি ব্যবসায়িক প্রয়োজন থাকে, তাহলে ব্যক্তিগত উপাত্ত বাইরে ‘হোস্ট’ (সংরক্ষণ) করা যেতে পারে।
তবে ব্যক্তিগত উপাত্ত নির্ধারিত নীতিমালা এবং সরকারি তদারকির বাইরে স্থানান্তরিত হলে দেশের নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক ভারসাম্য ঝুঁঁকিতে পড়তে পারে বলে মনে করেন সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এবং ব্যাকডোর প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর হাসান জোহা। রূপালী বাংলাদেশকে জোহা বলেন, সঠিক আইন বা খসড়া যেটাই হোক না কেন, সেখানে ব্যক্তিগত উপাত্ত স্থানান্তর সংক্রান্ত বিধানের আলোকে জাতীয় নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার নির্ধারিত নীতিমালার বাইরে কোনো ব্যক্তিগত উপাত্ত স্থানান্তর, দেশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ভারসাম্যের জন্য ঝুঁঁকিপূর্ণ হতে পারে। বাংলাদেশের সংবিধান এবং প্রাসঙ্গিক আইন অনুযায়ী, দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় সম্পর্কের ভিত্তিতে ব্যক্তিগত উপাত্ত স্থানান্তরের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন আবশ্যক। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিমালা লঙ্ঘন থেকে বিরত থাকতে সব নাগরিকের সতর্ক থাকা প্রয়োজন। সব উপাত্ত স্থানান্তর যেন আইনানুগ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এবং দেশের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রাখে, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কঠোর মনিটরিং নিশ্চিত করতে হবে। ‘সিকিউরিটি অপারেশন্স সেন্টার’ বা ‘সক’ থাকলেই এই মনিটরিং নিশ্চিত করা যায়। ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে ‘সক’ স্থাপনে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালাও রয়েছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, সব ব্যাংক এখনো ‘সক’ স্থাপন করেনি। মোটকথা, নীতিমালা এবং তদারকির মধ্য দিয়ে উপাত্ত স্থানান্তর হলে সমস্যা নেই, তবে এর ব্যত্যয় হলে বিষয়টি ঝুঁকিপূর্ণ।
অবশ্য আইসিটি বিভাগে প্রকাশিত খসড়াটি ভুল বলে রূপালী বাংলাদেশকে জানিয়েছেন আইসিটি বিভাগের পলিসি অ্যাডভাইজার ফায়েজ আহমদ তৈয়ব। তিনি বলেন, ওয়েবসাইটে যে খসড়াটি দেখছেন সেটি ভুল। সেটি আমাদের প্রণীত খসড়া না। এটাতে আমাদের সরকারের মতামত প্রতিফলিত হয়নি। গত বুধবার পর্যন্ত সাইবার নিরাপত্তা অধ্যাদেশের খসড়া চূড়ান্তকরণে কাজ করেছি। এখন এই অধ্যাদেশ নিয়ে কাজ করছি। ওয়েবসাইটে ভুল খসড়া প্রকাশের জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। এটি সরিয়ে ফেলা হবে এবং দ্রুতই সঠিক খসড়া প্রকাশ করা হবে। কয়েকটা দিন সময় দিন। আপনাদের খসড়ায় ব্যক্তিগত উপাত্ত দেশের বাইরে স্থানান্তরের বিষয়ে কী থাকবে এমন প্রশ্নের জবাবে ফায়েজ তৈয়ব বলেন, আমাদের অধ্যাদেশে ব্যক্তিগত উপাত্ত শ্রেণীকরণ করা হবে। এমন অনেক ব্যক্তিগত উপাত্ত আছে, যা বিদেশে সংরক্ষণ করলে সমস্যা নেই। ‘ডাটা ফাইন্যান্স’-এর দিক থেকে বাইরে এগুলোর গুরুত্ব আছে। কোনো উপাত্ত দেশের বাইরে স্থানান্তর করা যাবে না এবং কোনগুলো যাবে; সেগুলো শ্রেণীকরণের মাধ্যমে অধ্যাদেশে রাখা হবে।
আপনার মতামত লিখুন :