রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মোস্তাফিজুর রহমান সুমন

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৪, ২০২৫, ১১:১৯ এএম

দখলবাজ হাওলাদার অধরা

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৪, ২০২৫, ১১:১৯ এএম

দখলবাজ হাওলাদার অধরা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

জাতীয় পার্টির (জাপা) কো-চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী-এমপি এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার গত দেড় দশকের আওয়ামী লীগের স্বৈরশাসনের অন্যতম সহযোগী। ২০০৮ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে ক্ষমতার কাছাকাছি ছিলেন, জাতীয় পার্টি ছিল সরকারের অংশ। দীর্ঘ ১৫ বছরে প্রভাব খাটিয়ে তিনি ও তার স্ত্রী সাবেক এমপি নাসরিন জাহান রত্না আমিন নামে-বেনামে পটুয়াখালী, কুয়াকাটা, কলাপাড়া, দুমকি, বেতাগীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কেনা ও দখলসূত্রে শত শত একর জমির মালিক হয়েছেন। মন্ত্রী থাকাকালে শত শত কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে জাতীয় পার্টির এই সাবেক মহাসচিবের বিরুদ্ধে। প্রভাব খাটিয়ে বারবার দুদকের অনুসন্ধান বন্ধ করে দেন। ঢাকা ও পটুয়াখালীতে তার অনুসারীরা অবৈধ সম্পদ রক্ষায় সচেষ্ট রয়েছেন। ধর্ষণচেষ্টার আসামি ও শহিদ মুক্তিযোদ্ধা-সরকারি জমি দখলবাজ হাওলাদার এখনো বহাল তবিয়তে থাকায় জেলার বাসিন্দারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

জানা যায়, জুলাই ছাত্র-জনতার আন্দোলনে স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিয়ে হত্যাযজ্ঞকে উৎসকে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে জাপার প্রভাবশালী এই নেতার বিরুদ্ধে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে ৫ আগস্টের পর ফ্যাসিস্ট আ.লীগ সরকারের সুবিধাভোগী এবং ছাত্র-জনতা হত্যাযজ্ঞে সমর্থনকারী এই নেতার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দুদকসহ অন্য কোনো সরকারি সংস্থা বারবার দুর্নীতি ও অপকর্মের মামলা থেকে পার পেয়ে যাওয়া রুহুল আমিন হাওলাদারের বিরুদ্ধে সর্বশেষ কোনো ধরনের অনুসন্ধান বা তদন্ত শুরু করেনি।

অন্যদিকে, রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন রুহুল আমিন হাওলাদার। ভোল পাল্টে নিজে এবং জাতীয় পার্টিকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজপথে ফেরার চেষ্টা করছেন। জমির দখল নিতে রুহুল আমিন হাওলাদার পুলিশ, স্থানীয় সংসদ সদস্য, পৌর মেয়র, নিজস্ব পেটোয়া বাহিনীসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ও রাজনীতিবিদদের ব্যবহার করেছেন। মামলা-চলা জমির মালিকানা দেখিয়ে ব্যাংক লোন নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসেবে বিধবা মানোয়ারা বেগমের নামে ১৯৯৬ সালে বন্দোবস্ত দেওয়া দেড় একর জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে রুহুল আমিন হাওলাদারের বিরুদ্ধে। কলাপাড়া উপজেলার বিপিনপুর গ্রামের শিববাড়িয়া নদীর তীরে দিয়ারাম এলাকায় বাস করতেন মানোয়ারা বেগম। ২০১৭ সালে রুহুল আমিন হাওলাদার তার জমিটি দখল করে নেন। ২০১৯ সালে মারা যাওয়া মানোয়ারা বেগমের জমিটি দখলমুক্ত করতে ২০২১ সালে তার একমাত্র সন্তান মো. ছলেমান হাওলাদার কলাপাড়া প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। কিন্তু জমি দখলমুক্ত করতে পারেননি। এ ছাড়া রুহুল আমিন হাওলাদারের বিরুদ্ধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধিগ্রহণকৃত জমি দখল করতে প্রায় অর্ধশত পরিবারকে উচ্ছেদ করে দেশছাড়া করার অভিযোগ রয়েছে। পটুয়াখালীর পানি উন্নয়ন বোর্ডের জমি দখল করে উল্টো মামলাও দিয়েছেন এই নেতা। কুয়াকাটার তুলাতলীর মহাসড়কের পাশে ১২ একর জমি ক্রয় করে ১৮ একর জমি দখল করে নেন বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ।

প্রভাব খাটান দুদকের অনুসন্ধানেও

২০২২ সালের জানুয়ারিতে রুহুল আমিন হাওলাদার ও তার স্ত্রী সাবেক এমপি নাসরিন রত্নাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সে সময় দুদক জানিয়েছিল, বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে হাওলাদার এবং তার স্ত্রী রত্নার নামে থাকা বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে প্রায় ২০০ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারিতে সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য ধরা পড়লে, বিষয়টি খতিয়ে দেখতে দুদককে অনুরোধ করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অনুসন্ধান পর্যায়ের ’২১ সালে তলব করা হলে তখন হাজির হননি জাপা নেতা ও তার স্ত্রী।

এর আগে, সরকারি সম্পদ আত্মসাতের মাধ্যমে শতকোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে ’১৮ সালের  ১৩ সেপ্টেম্বর রুহুল আমিন হাওলাদারকে প্রথম দফায় তলব করে দুদক। ’১৯ সালের ২৮ মার্চ হাওলাদারকে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হতে বলা হয়। ওই নোটিশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাওলাদার রিট আবেদন করলে আদালত প্রাথমিক শুনানি নিয়ে চার সপ্তাহের জন্য দুদকের তলব স্থগিত করে দিয়েছিলেন। এরপর সে স্থগিতাদেশটি ’১৯ সালের ২৮ এপ্রিল স্থগিত করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ফলে হাওলাদারকে দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে আর কোনো আইনি বাধা না থাকায় তলব করে ফের নোটিশ দেওয়া হয়। ’২২ সালের আগস্টে দুর্নীতির মামলায় হাইকোর্ট রুহুল আমিনকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিলেও স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে বরাবরের মতো সে যাত্রাও রেহাই পান।

জমি দখলের অভিযোগ: ৫ আগস্টের পরও পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় জাতীয় পার্টির নেতা এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারের বিরুদ্ধে জোরপূর্বক জমি দখলের অভিযোগ উঠেছে। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তিনি জোরপূর্বক জমি দখল করে নেওয়ার অভিযোগ করেন কুয়াকাটার বাসিন্দা ভুক্তভোগী মো. ওসমান গনী শেখ নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা। গত ৯ নভেম্বর কুয়াকাটা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন। ওসমান গনি শেখ বলেন, ক্ষমতার দাপটে মামলা-হামলা ও প্রশাসনের মাধ্যমে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে আমাদের রেকর্ডিয় সাড়ে ২৭ শতাংশ জমি দখল করে নেন। আমাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন এলাকায় মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাকে ও আমার পরিবারের সদস্যদের জেলহাজতে পাঠান। আরেক ভুক্তভোগী সোবহান শেখ বলেন, রুহুল আমিন হাওলাদার সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী থাকাকালীন কুয়াকাটায় একাধিক জমি দখল করে নিয়েছেন।

ধর্ষণচেষ্টার মামলা

২০১৯ সালের জুনে সাবেক সংসদ সদস্য এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারের বিরুদ্ধ ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে মামলা হয়। পটুয়াখালী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতে মামলাটি দায়ের করা হয়। মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলা পরিষদের সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নাজনীন আখতার স্বর্ণা বাদী হয়ে এ মামলাটি দায়ের করেছিলেন। বাদীর অভিযোগ, ঘটনার সময় হাওলাদার তার স্পর্শকাতর স্থানে স্পর্শ করে ও ওড়না ছিঁড়ে ফেলে। এ সময় বাদী আত্মরক্ষার চেষ্টা করলে তাকে চর-থাপ্পড় মেরে স্থান ত্যাগ করেন। তাকে প্রাণনাশেরও হুমকি দেওয়া হয়। এ ঘটনায় ১১ জুন মামলা করতে গেলে মহিপুর থানা মামলা নেয়নি। পরবর্তীতে পটুয়াখালী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে মামলা দায়ের করেন।

হলফনামায় যত সম্পদ

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পটুয়াখালী-১ (সদর, মির্জাগঞ্জ ও দুমকি) আসনে জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থী দলের কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারের ১৫ বছরে সম্পদ বাড়ে ৩৬ গুণ। বর্তমানে সব মিলিয়ে তার সম্পদ রয়েছে ৭৬ কোটি ১৯ লাখ ৮ হাজার ৪৮৭ টাকা। একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় হলফনামায় মোট সম্পদ ছিল ৩৭ কোটি ৬০ লাখ ৩৫ হাজার ৫৬৮ টাকা এবং তবে সে সময়ে তার বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ ছিল ৬২ কোটি ৪৩ লাখ ৬৩ হাজার ৯৩৮ টাকা। এ ছাড়া দশম সংসদ নির্বাচনে ছিল ২৭ কোটি ১৭ লাখ ৭৩ হাজার ৩০০ টাকা ও পৈতৃক সূত্রে ৩০ কাঠা জমি এবং ব্যাংক ঋণ ছিল ৩৬ কোটি ২১ লাখ ৮ হাজার ৯৭৪ টাকা। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে হাওলাদার নিজের এবং তার স্ত্রীর যে সম্পদ দেখিয়েছেন তাতে তার নগদ টাকা ও ব্যাংক জমার স্থিতিসহ ২৬ কোটি ৭৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯৫২ টাকা, তার স্ত্রীর রয়েছে ২৮ লাখ ৫৯ হাজার ৪৬৪ টাকা। তার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত অর্থের পরিমাণ ৭ লাখ ৩৯ হাজার ৯৬৭ টাকা ও তার স্ত্রীর আছে ২২ লাখ ৯৩ হাজার ৮৮১ টাকা।

এদিকে হাওলাদারের স্ত্রী সাবেক এমপি নাসরিন জাহান রত্নার গত ১৫ বছরে স্থাবর, অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ৬ গুণ। হাওলাদারের নিজের নামে কৃষিজমি আছে ৩ কোটি ২৫ লাখ ৫৮ হাজার ৪৪৫ টাকার। অকৃষি জমি আছে ২ কোটি ৭৪ লাখ ৭৩ হাজার ৫৪ টাকার। তার স্ত্রীর নামে অকৃষি জমি রয়েছে ৭৯ লাখ ৭৭ হাজার ৯৪২ টাকার। এ ছাড়া তার (আবাসিক ও বাণিজ্যিক) দালান আছে ৩০ কোটি ৭৫ লাখ ৭০ হাজার ৬৯ টাকার এবং তার স্ত্রীর বাকেরগঞ্জে ১০ লাখ টাকার বসতভিটা ও পৈতৃক সূত্রে ঢাকার গুলশানে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে।

১৯৫৩ সালের ২ মার্চ বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার ভরপাশা গ্রামে জন্মগ্রহণ করা রুহুল আমিন হাওলাদার ’৭৯ সালের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন বাকেরগঞ্জ-১১ আসন থেকে এমপি হন। ’৮১ থেকে ’৮২ সাল পর্যন্ত তিনি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী ছিলেন। হাওলাদার ২০০২ সালে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মনোনীত হন। ১৩ সালের ১০ এপ্রিল তাকে মহাসচিব পদ থেকে অব্যাহতি দেয়। ২০১৬ তাকে পুনরায় মহাসচিব পদে নিয়োগ দেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। পরে দলের কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান রুহুল আমিন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারের ব্যক্তিগত মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে ম্যাসেজ দিয়েও উত্তর পাওয়া যায়নি।
 

আরবি/জেআই

Link copied!