দেশের সম্পদ ও সব নাগরিককে বিমার আওতায় আনার পরিকল্পনা করেছে সরকার। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে সহায়ক হবে বলে মতপ্রকাশ করেছেন কর্মকর্তারা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি) সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে (আইডিআরএ) এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে। এ-সংক্রান্ত একটি নথি রূপালী বাংলাদেশের হাতে এসেছে।
প্রাথমিকভাবে, দেশে বিমা কার্যক্রমের বিস্তৃতি বাড়ানোর জন্য আটটি প্রধান ক্ষেত্র নির্ধারণ করা হয়েছে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মেট্রোরেল ও ট্রেনসহ সব ধরনের পরিবহন বিমার আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে। আর বড় বড় শপিং মলগুলোকে অগ্নি বিমার আওতায় আনার পাশাপাশি গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি খাতের জন্য বিমা নীতি প্রবর্তনেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও, তৈরি পোশাক ও অন্যান্য কারখানার সব শ্রমিককে গ্রুপ বিমার আওতায় আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
বৈঠকের সিদ্ধান্তে উল্লেখ করা হয়েছে, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের স্বাস্থ্য বিমার আওতায় আনতে এবং প্রতিটি মোটরযানের জন্য বিমা নীতিমালা চালু করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
এফআইডির অতিরিক্ত সচিব অমল কৃষ্ণ মণ্ডল বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। বিমার প্রিমিয়াম প্রদানের পদ্ধতি সম্পর্কে মতামত চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সঙ্গে পরামর্শের সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০১৪ সালের জাতীয় বিমা নীতির ধারা ২.৩ এর লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সে ধারায় দেশের সব জীবন ও সম্পদ বিমার আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে। এই পদক্ষেপ বিমা খাতের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে অবদান বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে গৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশে বিমার বিস্তৃতি মাত্র ০.৪ শতাংশ। যা বিশ্বের মধ্যে সর্বনিম্নগুলোর একটি।
বৈঠকে আইডিআরএ’র এক নির্বাহী পরিচালক বলেন, সব নাগরিকের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য স্বাস্থ্য বিমা প্রদান করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এ বিমার আওতায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এমন কি বিভিন্ন সড়কের ক্ষতিগ্রস্ত অংশের বিমা করার বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
সার্বিকভাবে তিনি দেশের সব সম্পদকে বাধ্যতামূলক বিমা ব্যবস্থার আওতায় আনার পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব দেন।
এই নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, দেশের সব মানুষকে স্বাস্থ্য বিমার আওতায় আনা সম্ভব। এ ছাড়া, সব সরকারি ও বেসরকারি ভবন, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো বিমার অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এজন্য বিমা সম্পর্কে জনমনে আস্থার সংকট দূর করার বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি বলেন, দেশের সব প্রান্তিক খামারীদের গবাদি পশুবিমা ও পোল্ট্রি বিমার আওতায় আনার বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। এজন্য জনমনে বিমা সম্পর্কে ব্যাপক আস্থা তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রিমিয়াম নির্ধারণ করাসহ তা কীভাবে পরিশোধন করা হবে সে বিষয়টি পর্যালোচনা করা যেতে পারে। তবে বিমার প্রিমিয়াম সরকার কর্তৃক পরিশোধের বিষয়ে তিনি মতামত দেন।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের প্রতিনিধি দেশের সব সম্পদ বিমার আওতায় আনার বিষয়ে যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে সে উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। তবে এসব বিমা চালু করা হলে সেক্ষেত্রে প্রিমিয়াম প্রদান পদ্ধতি নির্ধারণ করার পাশাপাশি কে কতভাগ প্রিমিয়াম দিবে সে বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। এ বিষয়ে প্রয়োজনে সব অংশীজনদের সমন্বয়ে একটি কর্মশালার আয়োজন করারও পরামর্শ দেন।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি বলেন, দেশের সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অর্থাৎ আবাসিক-অনাবাসিক ভবনগুলোকে ফায়ার ইন্স্যুরেন্সের আওতায় আনার উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। বিমার প্রিমিয়াম প্রদানের বিষয়ে অর্থ বিভাগের মতামত গ্রহণ করা যেতে পারে বলেও তিনি বলেন।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি বলেন, কর্তৃপক্ষে যেসব নথি রয়েছে, সে নথিগুলোকে বিমার আওতায় আনা যেতে পারে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধি বলেন, সরকারি ও বেসরকারি ভবন বিমার আওতায় আনার বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। যেকোনো ভবন তৈরির ক্ষেত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ চলাকালীন সময়ের জন্য বিমা করে থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে তা’ আর ধারাবাহিকভাবে করা হয় না। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামের প্রতিনিধি বলেন, বিমা সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতার অভাব রয়েছে। উন্নত দেশের ন্যায় সব নাগরিক ও সম্পদের বিমা চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। সরকারি সম্পত্তির বিমাগুলো আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান সাধারণ বিমা করপোরেশনের মাধ্যমে করা যেতে যারে।
এ ছাড়া, দেশের সব সম্পদ বিমার আওতায় আনা হলে বিমা সেক্টরের ব্যাপক অগ্রগতি হবে। এ ছাড়াও, সম্প্রতি বন্ধ হওয়া মোটর ইন্স্যুরেন্স চালু করার জন্য মতামত দেন তিনি।
বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি বলেন, মেট্রোরেল, ট্রেন বিমা করার বিষয়টি নিশ্চিতকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। এ ছাড়া, দেশের যেসব বৃহৎ শপিংমল রয়েছে তা’ ফায়ার ইন্স্যুরেন্সের আওতায় আনার উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। এজন্য সিটি করপোরেশনকে প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করতে হবে। গ্রুপ ইন্স্যুরেন্স করা যেতে পারে। গার্মেন্টসকর্মীদের ইন্স্যুরেন্সের আওতায় আনা যেতে পারে। দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের স্বাস্থ্যবিমার কাভারেজের মধ্যে আনা যেতে পারে। এতে মোটিভেশনের প্রয়োজন হলে তাও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তবে মোটর ইন্স্যুরেন্স এর মধ্যে থার্ডপার্টি ইন্স্যুরেন্স চালু করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরামর্শ দেন তিনি।
জানা গেছে, সভায় উপস্থিত শিল্প মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি, সাধারণ বিমা করপোরেশন, জীবন বিমা করপোরেশন, বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমির প্রতিনিধিরা সুপারিশের সঙ্গে বাংলাদেশের সব নাগরিক ও সম্পদ বিমার আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে একমত পোষণ করেন।
আপনার মতামত লিখুন :