ঢাকা শনিবার, ২৫ জানুয়ারি, ২০২৫

তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা মানবেতর অবস্থা

শাওন সোলায়মান

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৫, ২০২৫, ০১:৩৬ এএম

তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা মানবেতর অবস্থা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের আওতাধীন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি) এবং বাংলাদেশ ডেটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেডের (বিডিসিসিএল) ছয় কর্মকর্তা দাপ্তরিক দায়িত্ব পালনে বিরত আছেন। তদন্ত সাপেক্ষে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা থাকলেও তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দিয়েছে। চাকরিচ্যুত না হলেও ৩ মাস যাবৎ বন্ধ রয়েছে কর্মকর্তাদের সব ধরনের বেতন-ভাতা। আবার নিয়োজিত হতে পারছেন না অন্য কোনো পেশাতেও।

এ অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাদের। অর্থাভাবে কেউ থাকছেন আত্মীয়ের বাড়িতে, আবার কেউ করাতে পারছেন না সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর চিকিৎসা। তদন্ত দ্রুত শেষ করার পাশাপাশি বেতন প্রদানের আদেশ জারি করবেন বলে জানিয়েছেন আইসিটি সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী। 

গত বছরের ২২ আগস্ট বিসিসির দুই এবং বিডিসিসিএলের চার কর্মকর্তাকে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখার নির্দেশনা দিয়ে আদেশ জারি করে আইসিটি বিভাগের প্রশাসন শাখা। তৎকালীন উপসচিব জিল্লুর রহমান ওই আদেশে স্বাক্ষর করেন। তিনি তখন বিভাগের তৎকালীন সচিব সামসুল আরেফিনের একান্ত সচিবেরও দায়িত্বে ছিলেন। সেদিন প্রথম আদেশে সাত কর্মকর্তাকে দায়িত্ব পালনে বিরত রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়। তারা হলেন-বিসিসির ব্যবস্থাপক (টেস্টিং) ও ডেটা সেন্টারের ইনচার্জ সাইফুল আলম খান, এডমিনিস্ট্রেটর (ফায়ারওয়াল ও আইপিএস) রাজন দাশ, বিডিসিসিএলের ব্যবস্থাপক (জেনারেশন সিস্টেম) এ কে এম লতিফুল কবির, ব্যবস্থাপক (লজিস্টিক্স) ইকরামুল হক, ব্যবস্থাপক (ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিং) রনজিত কুমার, ব্যবস্থাপক (নেটওয়ার্ক ও ট্রান্সমিশন) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান এবং নিরাপত্তা কর্মকর্তা রুস্তম আলী। তবে একইদিন আদেশটি ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে আরেকটি আদেশ প্রকাশ করা হয়।

সেই আদেশে বাদ দেওয়া হয় কামরুজ্জামানকে। অথচ কামরুজ্জামানের নিয়োগই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থানসহ সহকর্মীদের সঙ্গে অসদাচরণের মতো গুরুতর অভিযোগ ছিল কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে। কামরুজ্জামানের নাম অন্তর্ভুক্তিকে ‘কারিগরি ত্রুটি’ বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন আদেশে স্বাক্ষরকারী উপসচিব জিল্লুর রহমান।

বাকি ছয়জনের মধ্যে অন্তত তিন কর্মকর্তা সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বিসিসির ব্যবস্থাপক সাইফুল আলম খানকে বিজিডি ই-গভ সার্ট প্রকল্পের পরিচালক হয়েছিলেন পলকের আশীর্বাদে। ইকরামুল হক এবং রনজিত কুমার বিডিসিসিএলে চাকরির পূর্বে যথাক্রমে পলকের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা এবং একান্ত সহকারী সচিব ছিলেন।

কামরুজ্জামান বাদ গেলেও জীবনের অনিশ্চয়তা থেকে বাদ যাননি অন্তত দুই কর্মকর্তা। অক্টোবর মাস থেকে কোনোরকম বেতনভাতা পাচ্ছেন না এই কর্মকর্তারা। অথচ তদন্তের কারণে দায়িত্ব থেকে বিরত থাকলে বেতন পাওয়া যাবে না এমন কোনো বিধান নেই বিডিসিসিএলের কোম্পানি আইনে।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি চাকরি বিধি অনুযায়ী, কোনো কর্মকর্তা বরখাস্ত থাকলেও তিনি মূল বেতনের অর্ধেক পাবেন। এমন বাস্তবতায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। অর্থাভাবে থমকে আছে নিরাপত্তা কর্মকর্তা রুস্তম আলীর নতুন সংসার। রাজধানী ও রাজধানীর বাইরে আত্মীয়স্বজনদের বাসায় বসবাস করছেন তিনি। অন্যদিকে সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর চিকিৎসা ব্যয় বহনে হিমশিম খাচ্ছেন ব্যবস্থাপক লতিফুল কবির। তদন্ত করে তাদের বিষয়টি নিষ্পত্তির আবেদন জানিয়েছেন দুজনেই।

ফ্যাসিবাদি আওয়ামী লীগের সঙ্গে যারা প্রকৃত অর্থে ঘনিষ্ঠ, যাদের নিয়োগে অনিয়ম আছে, যারা দুর্নীতিগ্রস্ত তারাই নিজেদের আড়াল করতে তদন্তে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন বলেও অভিযোগ তাদের। 
রুস্তম আলী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, গোয়েন্দা প্রতিবেদনের অজুহাতে দীর্ঘদিন আমার নিয়োগ আটকে রাখা হয়েছিল। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে নিয়োগ হয়, আগস্টে সরকারের পতন। এত অল্প সময়ে আমি কী দুর্নীতি করলাম? বরং গাজীপুরের কালিয়াকৈরের ডেটা সেন্টার থেকে যেন স্বেচ্ছায় চলে যাই, এ জন্য আমাকে জীবননাশের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। তারপরেই দায়িত্ব থেকে বিরত থাকার আদেশে আমার নাম দেখি। আমার ধারণা, কোনো পক্ষ নিজেদের আড়াল করতেই আমাকে ফাঁসিয়েছে। আমার নতুন সংসার। আত্মীয়দের বাড়িতে বাড়িতে থাকছি। তদন্তের বিষয়ে রুস্তম আলী বলেন, তদন্ত করে কোনো প্রমাণ পেলে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিক। কিন্তু তদন্তও হচ্ছে না, বেতনও আটকে রেখেছে। এটা আমাদের সঙ্গে অন্যায়। বিষয়টি নিয়ে মানসিক পীড়ায় আছি। আমার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ সেটাও সুনির্দিষ্ট করে জানানো হয়নি। দায়িত্ব থেকে বিরত থাকার আদেশে আমার নাম থাকা ছাড়া তদন্ত বা অভিযোগের বিষয়ে লিখিতভাবে কিছুই জানানো হয়নি। অন্যদিকে ব্যবস্থাপক লতিফুল কবির বলেন, ন্যায় বিচার চেয়ে আইসিটি বিভাগে আবেদন করেছি। আমার বিশ্বাস আমি অপরাধী না। সর্বদা বিডিসিসিএল কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছি। সৎ সাহস আছে এ জন্য আবেদন করেছি। তদন্ত করে অপরাধের প্রমাণ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নিক, না হলে দায়িত্বে পুনঃবহাল করুক। এভাবে ঝুলিয়ে রাখা কাম্য না। এ বিষয়ের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত অন্য কোনো চাকরিও করতে পারছি না। আমার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। বিষয়টি তার জন্যও মানসিক যন্ত্রণার অথচ চিকিৎসক তাকে চাপমুক্ত থাকতে বলেছেন।

কিন্তু এমন অবস্থায় চাপমুক্ত থাকা যায়? আমি বিশ্বাস করি যে, আইসিটি বিভাগ ন্যায় বিচার করবে।

এদিকে তদন্ত কমিটি এখনো অভিযুক্তদের বক্তব্য নেয়নি বলে জানিয়েছেন এই দুই কর্মকর্তাই। রুস্তম আলী বলেন, এখন পর্যন্ত তদন্ত কমিটি আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি, কোনো বক্তব্যও জানতে চায়নি। অভিযুক্ত হলেও আমাদেরও তো বক্তব্য থাকতে পারে।

আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাওয়া আমাদের অধিকার। বিডিসিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তৌফিক আল মাহমুদ জানান, বৃহস্পতিবার প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল তদন্ত কমিটির। তবে সেটি জমা পড়েনি। তদন্তে সময় লাগছে এবং অভিযুক্তদের বক্তব্য না নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে তদন্ত কমিটির প্রধান আইসিটি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন অনুবিভাগ) ইসরাত হোসেন খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, কমিটি গঠনের প্রক্রিয়াই ঠিক হয়নি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং সংস্থার প্রতিনিধি দেওয়া হয়েছে কিন্তু তাদের পাওয়া যায় না। সরকার পতনের পর তাড়াহুড়ো করে কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এটাই ভুল ছিল। সার্ভিস রুল বলে, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকেই কমিটি হবে। এখানে পিএসসি (সরকারি কর্ম কমিশন) এবং জনপ্রশাসনের তো দরকার নাই। পাঁচ মিশালী লোকজন দিয়ে কমিটি করায় সবার সময়ের সমন্বয় হচ্ছে না। এ জন্যই তদন্তে দেরি হচ্ছে।

অভিযুক্তদের বক্তব্য নেওয়ার বিষয়টি বললেন, ‘নলেজে’ নিলাম। তদন্ত এবং কর্মকর্তাদের বেতনের বিষয়ে জানতে চাইলে আইসিটি বিভাগের সচিব এবং বিডিসিসিএলের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান শীষ হায়দার চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, তদন্ত চলমান। দ্রুত শেষ হবে বলে আশা করছি। অভিযুক্তদের মাঝে মাঝে কেউ নিরাপদ থাকতে পারেন।

তদন্তের আগ পর্যন্ত কর্মকর্তাদের বেতন দিতে মৌখিকভাবে আদেশ দিয়েছি। দ্রুতই লিখিত আদেশ প্রকাশিত হবে। ব্যবস্থাপক কামরুজ্জামানকে তদন্তের বাইরে রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে সচিব বলেন, কামরুজ্জামানের বিষয়টি জেনেছি। তার বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ পেয়েছি। তাকে কীভাবে এবং কেন তদন্তের বাইরে রাখা হয়েছে সে বিষয়টি দেখছি। তাকেও তদন্তের মধ্যে আনা হবে।

আরবি/জেডআর

Link copied!