দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর ধরে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করে আসছে কেয়া গ্রুপ। গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের কোনাবাড়ির জরুন এলাকায় অবস্থিত কেয়ার কারখানাগুলোতে অন্তত ১৫ হাজার শ্রমিক কাজ করে জীবন নির্বাহ করছেন। এদের মধ্যে অনেক শ্রমিক রয়েছেন বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী। পাঁচ দিন আগে এই গ্রুপের কয়েকটি কারখানা আগামী ২০ মে থেকে স্থায়ীভাবে বন্ধের নোটিশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এর আগে গত ডিসেম্বরেও কেয়া গ্রুপের চারটি গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যায়। গত বছরের ২৩ নভেম্বর বন্ধ হয়ে যায় গাজীপুর-কালিয়াকৈরের নায়াগ্রা টেক্সটাইল করাখানাটি। এতে ২ হাজার ৩০০ পোশাক শ্রমিক কাজ করতেন। প্রতিদিনের মতো সেদিন সকালে কাজে যোগ দিতে গিয়ে শ্রমিকরা জানতে পারেন তাদের চাকরি নেই। অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে কারখানাটি।
বেক্সিমকো শিল্প পার্কের ১৬টি পোশাক কারখানা গত ১৫ ডিসেম্বর অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। ওই কারখানাগুলোতে প্রায় ৪২ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন।
শুধু কেয়া গ্রুপ, নায়াগ্রা টেক্সটাইল ও বেক্সিমকোই নয়, গত প্রায় ছয় মাসে অর্ধশতাধিক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। হঠাৎ কারখানা বন্ধ হওয়ায় কঠিন অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হয়েছেন শ্রমিকরা। শুরু হয় বেকারজীবন। শ্রমিকদের মধ্যে হতাশা থেকে ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে। শ্রমিকদের দাবি, বেঁচে থাকার কঠিন লড়াইয়ে ফুঁসে উঠছেন তারা। নেমেছেন আন্দোলনে। গত মঙ্গলবার বেক্সিমকোর কারখানাগুলো খুলে দেওয়ার দাবিতে গণসমাবেশ করেন তারা। শ্রমিকদের আন্দোলনে প্রায়ই বন্ধ থাকছে সড়ক-মহাসড়ক। ভোগান্তি বাড়ছে সাধারণ মানুষের। আন্দোলনরত শ্রমিকদের সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকেই বিভিন্ন দাবিতে অস্থিরতা চলছে সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুরের শিল্পাঞ্চলে। নির্ধারিত সময়ে বেতন প্রদান, হাজিরা বোনাস বৃদ্ধি, বেতন বাড়ানোসহ বিভিন্ন দাবিতে শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ করেন শ্রমিকেরা। বিক্ষোভের জেরে অনেক সময় কারখানায় ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়।
কারখানার কর্মকর্তাদের মারধরসহ বিভিন্ন বিশৃঙ্খলায় জড়িয়ে পড়েন বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা। আর এ সুযোগে কিছু বহিরাগত কারাখানায় লুটপাট বা অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটায়। এতে কারখানা কর্তৃপক্ষকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়। তাই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ঝামেলা এড়াতে কোনো কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা, আবার কোনো কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণাও করা হয়। এমনও হয়েছে এক দিনে অন্তত ৩০০ পোশাক কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এতে কারখানাগুলোর উৎপাদন কমে দাঁড়ায় শূন্যের কোঠায়। এর পর থেকেই নড়েচড়ে বসে সরকার। শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে কয়েক দফা মালিক-শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তরা। এরপর শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতা কিছুটা কমলেও স্বস্তি আর ফেরেনি। সর্বশেষ গ্রামীণ টেলিকম ট্রাস্টের মালিকানাধীন গ্রামীণ ফেব্রিক্স অ্যান্ড ফ্যাশন লিমিটেডে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
শিল্পাঞ্চল পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত গত প্রায় ৬ মাসে শিল্পাঞ্চলে ৬৮টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এর মধ্যে ৫৮টি স্থায়ী ও ১০টি অস্থায়ী ভিত্তিতে বন্ধ। বন্ধ হওয়া কারখানাগুলোর অধিকাংশই তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের। এই ৬৮টি কারখানা মধ্যে গাজীপুর শিল্পাঞ্চলে ৫১টি এবং সাভার আশুলিয়া ও ধামরাইয়ে ১৭টি। গাজীপুরের ৫১টির মধ্যে ৪১টি কারখানা স্থায়ীভাবে এবং ১০টি অস্থায়ীভাবে বন্ধ ঘোষণা করেছে মারিকপক্ষ। এ ছাড়া নানা সমস্যার কথা জানিয়ে আগামী মে মাস থেকে আরও ৭টি কারখানা বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে কেয়া গ্রুপ। একে একে কারখানগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নিদারুণ অনিশ্চয়তার মধ্যে সপরিবারে মানবেতর দিনযাপন করছেন শ্রমিকরা।
গাজীপুর চন্দ্রা এলাকার বন্ধ হয়ে যাওয়া মাহমুদ জিনস কারখানার নারী শ্রমিক সুলতানা আক্তার জানান, তিনি ৬ বছর ধরে কাজ করেছেন ওই কারখানায়। কারখানা বন্ধ হওয়ার পর পুরুষ শ্রমিকদের অধিকাংশ অন্যত্র চাকরি পেয়েছেন। তবে আমাদের মতো মধ্যবয়সী নারীরা কোথাও চাকরি পাচ্ছি না। এক মাস ধরে ৮-৯টি কারখানায় যোগাযোগ করেছি। তারপরও চাকরি হয়নি। পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি।
গাজীপুর শিল্প পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গাজীপুর শিল্পাঞ্চলে ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ২ হাজার ১৭৬টি নিবন্ধিত কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ১৫৪টি তৈরি পোশাক কারখানা। গত নভেম্বর থেকে কর্মীদের বেতন দিতে পারেনি ৩৫টি কারখানা। ডিসেম্বর থেকে বেতন বকেয়া পড়েছে ৪৫ শতাংশ কারখানায়। বিভিন্ন কারণে গাজীপুরের ৫ শতাংশ কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ বিরাজমান। ৯ শতাংশ কারখানায় ইনক্রিমেন্ট নিয়ে জটিলতা চলছে। এমন বাস্তবতায় ১ হাজার ১৫৪টি তৈরি পোশাক কারখানার মধ্যে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে ৪১টি এবং অস্থায়ীভাবে ১০টি কারখানা বন্ধ রয়েছে।
গত ২০ জানুয়ারি কেয়া গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক/চেয়ারম্যান স্বাক্ষরিত এক নোটিশে বলা হয়েছে, বর্তমান বাজার অস্থিতিশীলতা, ব্যাংকের সঙ্গে হিসাবের অমিল, কাঁচামাল অপর্যাপ্ততা ও কারখানার উৎপাদন কার্যক্রমের অপ্রতুলতার জন্য কারখানাগুলোর সব কার্যক্রম স্থায়ীভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হলো। শ্রমিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বাংলাদেশ শ্রম আইনের বিধি অনুযায়ী সব পাওনা কারখানা বন্ধের পরবর্তী ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে পরিশোধ করা হবে।
কেয়া গ্রুপের মানবসম্পদ বিভাগের ব্যবস্থাপক সাবিনা ইয়াসমিন সাংবাদিকদের বলেন, রাজনৈতিক কারণে বিগত সরকারের সময় থেকে মালিকের বিরুদ্ধে দুদক ৭টি মিথ্যা মামলা করেছে। এর মধ্যে ৫টি থেকে মালিক এর মধ্যে খালাস পেয়েছেন। তা ছাড়া একটি ব্যাংক হিসাব নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করে রপ্তানি বাধাগ্রস্ত করছে। এসব কারণে কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি ধাপে শ্রমিকদের সব পাওনা শ্রম আইন অনুযায়ী পরিশোধ করা হবে।
এদিকে গত ১৫ ডিসেম্বর শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে বেক্সিমকোর শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রম ও ব্যবসায় পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের কমিটির সভার সিদ্ধান্তের পর বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ১৬টি কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বন্ধের কারণ হিসেবে সরকার বলছে, কারখানাগুলোতে অর্ডার না থাকায় ও ব্যাংকে খেলাপি ঋণ থাকায় কারখানা পরিচালনা সম্ভব হচ্ছে না। বন্ধ ঘোষিত এসব কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে সড়কে নেমে আন্দোলন করছে কাজ হারানো ৪২ হাজার শ্রমিক। গত বুধবার শ্রমিকদের বিক্ষোভের এক পর্যায়ে চন্দ্রা-নবীনগর সড়কে অর্ধশতাধিক যানবাহন ভাঙচুর করা হয়। একটি মালভর্তি ট্রাক ও তিনটি বাসেও অগ্নিসংযোগ করা হয়। তেঁতুইবাড়িতে ‘গ্রামীণ ফেব্রিকস’ নামে একটি কারখানার পাঁচতলা ভবনের নিচতলায় অগ্নিসংযোগ করা হয়।
বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের শ্রমিক হেদায়েত ইসলাম জানান, কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে তারা খুব অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েছেন। প্রায় ৪২ হাজার শ্রমিক এখন খুব সংকটের মধ্যে আছে। তিনি বলেন, আমরা কারখানা খুলে দেওয়ার দাবি জানাই।
জুলহাস নামে আরেক শ্রমিক বলেন, আমাদের পরিবারের সদস্যরা কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। আমরা অন্য কোথাও কাজ পাচ্ছি না। সরকারের কাছে দাবি জানাই, কারখানা খুলে দেওয়া হোক।
কাওছার নামের এক শ্রমিক বলেন, বর্তমানে হাজার হাজার শ্রমিক এখন আমরা বেকার হয়ে পড়েছি।
সরকারের কাছে আবেদন জানাই আমাদের কারখানা খুলে দিন। কারখানার ৪২ হাজার শ্রমিক আমরা সকলেই অত্যন্ত সংকটের মধ্যে আছি।
গাজীপুর শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার এ কে এম জহিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, গাজীপুরে এ পর্যন্ত ৫১টি কারখানা বন্ধ রয়েছে। ব্যাংকিং সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণে কারখানাগুলো বন্ধ হচ্ছে বলে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। আমরা আরো বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের কাজ করছি। তবে মালিক পক্ষ চাইলে এসব কারখানা যে কোনো সময় খুলে দিতে পারে।
জানা গেছে, সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাইয়ে শিল্পকারখানা রয়েছে ১ হাজার ৮৬৩টি। এর মধ্যে তৈরি পোশাক কারখানা ৭৪৫টি। শিল্প পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, তৈরি পোশাকশিল্পের কারখানার মধ্যে গত ৬ মাসে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে ১৭টি। এতে ১০ হাজার ৮১ জন চাকরি হারিয়েছেন।
আশুলিয়ায় বন্ধ হয়ে যাওয়া জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন কারখানার অপারেটর আছিয়া আক্তার জানান, পাঁচ মাস আগে কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। এর পর থেকে চাকরির জন্য অনেক কারখানায় গেছি। কিন্তু চাকরি হয়নি। অসুস্থ স্বামী আর ছোট দুই সন্তান নিয়ে সংসার চালানো কষ্টের, বড় অসহায় হয়ে পড়েছি।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মুকুল কুমার মল্লিক সাংবাদিকদের বলেন, গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন কারখানায় ৭০ লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করেন। একের পর এক কারখানা বন্ধ হওয়ায় বাড়িভাড়াসহ ব্যবসা-বাণিজ্যে নানা বিরূপ প্রভাব পড়েছে। নতুন বিনিয়োগ আনা অথবা বন্ধ কারখানা চালু করা না গেলে সমস্যা আরো তীব্র হতে পারে।
বিগত সরকারের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ব্যক্তিরাই বেশি বিপাকে পড়ছেন বলে মন্তব্য করে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক জোট বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, একের পর এক কারখানা বন্ধ হচ্ছে, শ্রমিক বেকারত্বও বাড়ছে। তবে কারখানা বন্ধের জন্য শ্রমিক আন্দোলনকে দায়ী করা যাবে না। কারণ, বিগত দিনেও শ্রমিকেরা তাদের বকেয়া বেতনভাতা জন্য বিভিন্ন বিষয়ে আন্দোলন করলেও এভাবে কারখানা বন্ধ হয়নি।
আপনার মতামত লিখুন :