বেসরকারি চাকরিজীবী মো. তারেক মনোয়ার। একটি আনার ফল হাতে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলের মূল গেটের ফলের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। অসুস্থ বাবা ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি। ডাক্তার বলেছেন ফল খাওয়াতে, তবেই বাড়বে ইমিউনিটি সিস্টেম। দেশীয় ফলের সঙ্গে পরামর্শ আঙুর, কমলা ও আনার খাওয়ানোর। এ কথা বলতে বলতে চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে তার। বলেন, বাসায় ছয় বছরের ছেলে আছে। তার জন্য গত এক বছরে উচ্চ দামের কারণে ফল কিনতে পারিনি। বাধ্য হয়েই বাবার জন্য এক পিস আনার কিনেছি, যার দাম পড়েছে ১৩০ টাকা। বর্তমান যে দাম, তাতে মধ্যবিত্তের ফল কেনার ক্ষমতা নেই।
প্রচলিত আছে দিনে একটি আপেল ডাক্তার থেকে দূরে রাখবে আপনাকে। চিকিৎসকরা বলেন, আপেলের উচ্চ আঁশ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়, সুস্থ রাখে হৃদযন্ত্র। তবে সেই আপেল এখন সাধ্যের বাইরে বেশির ভাগ মানুষের। তবে সরেজমিনে দেখা যায়, বাজারে প্রতি কেজি আপেল বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৩২০ থেকে ৩৮০ টাকা। শুধু আপেল নয়, সব বিদেশি ফলেরই দাম এখন ৩০০-এর ওপরে।
আঙুর কেজি ৪৮০-৫৪০ টাকা (কালো), আঙুর কেজি ৩৭০-৪২০ টাকা (সাদা), মাল্টা কেজি ২৭০-৩৩০ টাকা, আনার কেজি ৫৩০ - ৬৫০ টাকা। কমলা কেজি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, মাল্টা ২৮০ থেকে ৩৫০ টাকা, নাশপাতি ৪২০ থেকে ৫০০ টাকা।
এক বছরের বেশি সময় ধরেই বাড়তি ফলের দাম। কারণ হিসেবে দেশে ডলার সংকট, এলসি জটিলতা, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিসহ বিলাসী পণ্য দেখিয়ে অতিরিক্ত শুল্কারোপের কথা বলা হয়। এদিকে আইএমএফের চাপে নতুন করে ফলে শুল্ক বাড়িয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। যাতে নতুন বছরের গত ২০ দিনের ব্যবধানে খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি দাম বেড়েছে ৫০ থেকে ১০০ টাকা। যে কারণে মধ্যবিত্তের সাধ্যের বাইরে এখন ফলের বাজার। যারা পরিবারের জন্য ফল কিনতেন, তাদের সে তালিকা থেকে পুষ্টিকর এ পণ্যটি বাদ দিচ্ছেন বাধ্য হয়ে।
আজিমপুর বাজারে ফল কিনতে আসা তন্ময় কুমার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ফল বিলাসী পণ্য নয়। আমার ছেলে-মেয়ের জন্য আগে মাঝে মাঝে কিনলেও গত এক মাস আপেল-আঙুরের পবিবর্তে কিনছি মিষ্টি আলু, শসা-গাজর। বিকল্প এ ছাড়া কোনো উপায় নেই। কত দিন এই শসা-গাজরের দাম কম থাকে সেটাও শক্সকার।
মো. মোতালেব নামের একজন বলেন, রমজানে ফল ছাড়া রোজাদারের ইফতার অসম্পূর্ণ মনে হয়। তবে যে দাম এখন ফলের বাজারে, রোজার সময় আরো বাড়বে। এবার মধ্যবিত্তদের ইফতার ফল ছাড়াই করতে হবে। ইতিমধ্যে খেজুরের দাম ১৫০০/২০০০ টাকার নিচে ভালো কোনো খেজুর নেই।
গত ৯ জানুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তাজা ও শুকনা ফলে সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করেছে। একই সঙ্গে আপেল, আঙুর ও তরমুজের মতো কিছু টাটকা ফলসহ জুসের ওপর শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে।
শান্তিনগর বাজারের ফল ব্যবসায়ী আব্দুল জলিল বলেন, মার্চ থেকে শুরু হবে রমজান। ইফতারের জন্য বাড়বে ফলের চাহিদা। তবে বর্তমান যে অবস্থা দেখছি তাতে করে রমজানে আরো কিছুটা বাড়তে পারে ফলের দাম। দেশীয় ফলের মৌসুম শুরু হবে রোজার পর মূলত মে মাস থেকে। ফলে, রোজার পুরো মাস আমদানি করা ফলের ওপর আরো চাপ বাড়বে। যার প্রভাব এবং ফলের ওপর শুল্ক বাড়ানোয় বাজারে দাম বাড়ছে বলে মনে করেন তিনি।
রাজধানীর সর্ববৃহৎ পাইকারি বাজার বাদামতলীর ফল আড়তের মোর্শেদ হালিম বলেন, ফলে ও শুকনা ফলের ওপর ভ্যাট বাড়িয়েছে। যার ফলে আমদানিকারকরা আমদানি পর্যায় থেকে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এবার সব ফলের সাথে বেড়েছে খেজুরের দাম। এ প্রভাবে আড়তে দাম বাড়ছে। তিনি জানান, ৯ কেজি আঙুরের বাক্স বিক্রি হচ্ছে ৫০০০-৫২০০ টাকা। যা দুই সপ্তাহ আগে ৪৪০০ থেকে ৪৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ১৫ কেজির মাল্টার বাক্স বিক্রি হচ্ছে ৩৮০০ টাকা, যা আগে ছিল ৩১০০ থেকে ৩২০০ টাকা।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাবেক সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ফলকে বিলাসপণ্য দেখিয়ে আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। যার ফলস্বরূপ নতুন করে ফলের দাম বাড়ছে। কিছুদিন পর রোজা শুরু হবে। এই মুহূর্তে ভ্যাট বাড়ানো সঠিক হয়েছে বলে মনে করি না।
দেশি এন্টারপ্রাইজ নামের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের (নাম না প্রকাশের শর্তে) এক কর্মকর্তা জানান, খেজুরের ওপর সরকার শুল্ক কমিয়েছে তার প্রভাব খুব একটা পাবে না জনগণ। যে পরিমাণ খেজুর আমাদের দেশে আমদানি হয়, তা চাহিদার তুলনায় কম। দেশের বাজারে যে দামে খুচরা খেজুর বিক্রি হচ্ছে, রমজানে দাম আরো কিছুটা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শুল্ক কমানোর পরও দাম বাড়তে পারেÑ তার কারণ, এবার সৌদি-মিসরসহ যেসব দেশ থেকে খেজুর আমদানি করা হয়, সেখানে উৎপাদন তুলনামূলক কম। ফলে বাড়তি দামে খেজুর কিনে আমদানি করতে হচ্ছে আমাদের। বর্তমানে ভালো মানের খেজুর আজোয়া কেজি ১৬০০-১৮০০ টাকা। সুককারি কেজি ১০০০-১১০০ টাকা, মরিয়ম ১৬০০-১৭০০ টাকা, মেটজুল ২০০০-২২০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। যা রমজান মাসে আরো বাড়তে পারে। তবে পুরনো খেজুর কিছুটা কম দামে পাওয়া যেতে পারে।
আপনার মতামত লিখুন :