ঢাকা সোমবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০২৫

ভারপ্রাপ্তের ভারে ন্যুব্জ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

সেলিম আহমেদ

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৭, ২০২৫, ০২:০৬ এএম

ভারপ্রাপ্তের ভারে ন্যুব্জ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

দেশের পুরোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একটি মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাষ্ট্রপতির নিয়োগ দেওয়া ভিসি, প্রোভিসি ও ট্রেজারার। শুধু এই বিশ্ববিদ্যালয় নয়, ঢাকার দ্য পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, রয়েল ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি, সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রামের প্রিমিয়াম ইউনিভার্সিটি, চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুরের জার্মান ইউনিভার্সিটি, মানিকগঞ্জের এনপিআই ইউনিভার্সিটিতেও প্রশাসনিক প্রধানসহ এই তিন পদ ফাঁকা। এই ১০ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও এককভাবে ভিসি নেই ৪০টি, প্রোভিসি নেই ৮৪টি, ভিসি ও প্রোভিসি নেই ২৭টি  আর ট্রেজারার নেই ২৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা বিশ্লেষক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শীর্ষ পদগুলো শূন্য থাকায় অনেকটা অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম ভেঙে পড়ার পাশাপাশি পড়ালেখার মান ও স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। চরম বিপাকে পড়তে হচ্ছে শিক্ষার্থীদেরও। বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের (বিওটি) সদস্যরা নানা অনিয়ম করতে ইচ্ছা করেই এসব পদ শূন্য রাখেন বলে অভিযোগ অনেকের।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে সরকার অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১৫। এর মধ্যে পাঠদান চলমান রয়েছে ১০৫টিতে। বাকি ১০টির মধ্যে ছয়টিতে পাঠদানের অনুমতি নেই। আর চারটিতে নানা জটিলতার কারণে পাঠদান বন্ধ রয়েছে।

ইউজিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ এসব পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য ইউজিসি থেকে বারবার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের (বিওটি) সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজের মতো করে পরিচালনা করার জন্য এসব পদে নিয়োগ দেন না। নিয়োগের কাজ বিলম্বিত করার জন্য নানা কৌশলী ভূমিকাও নেন তারা। আবার ভিসি না থাকার কারণে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরের পর বছর হয় না সমাবর্তন। ফলে শিক্ষার্থীরাও তুলতে পারেন না মূল সনদ। এতে চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয় শিক্ষার্থীদের।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী ভিসি, প্রোভিসি ও ট্রেজারার এই তিন পদে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয় চ্যান্সেলর। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ এই তিন পদে নিয়োগ দিতে একেকটি পদের বিপরীতে তিনজন অধ্যাপকের নাম প্রস্তাব আকারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠান। পরে মন্ত্রণালয় ইউজিসির মাধ্যমে যাচাই করে সরকারের উচ্চপর্যায়ে পাঠায়। সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসেবে রাষ্ট্রপতি একজনকে নিয়োগ দেন। তবে দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ম না মেনে নিজেরাই এসব পদে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে নিয়োগ দিয়ে বছরের পর বছর শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম চালায়।

অভিযোগ রয়েছে, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যোগ্য ব্যক্তিদের প্যানেল সরকারের কাছে না পাঠিয়ে নিজেদের মতো করে একটি প্যানেল পাঠায়। পরে সেটি আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরত আসে। এরপর থমকে যায় এই নিয়োগ প্রক্রিয়া। এই সুযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ড ও মালিকেরা তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে ভারপ্রাপ্তের দায়িত্ব দিয়ে কাজ চালিয়ে নেন। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দের লোক নিয়োগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ লুটপাট করারও অভিযোগ রয়েছে। আবার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিওটির পছন্দের বাইরে নিয়োগ দিলে নানাভাবে হয়রানি করে তাকে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে সেচ্ছ্বায় পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন তারা। 

ভিসি-শূন্য যেসব বিশ্ববিদ্যালয়: ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, সরকারের নিয়োগ করা ভিসি নেই এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪০।

এগুলোতে প্রোভিসি, ভারপ্রাপ্ত ভিসি কিংবা অন্য কোনো শিক্ষককে ভারপ্রাপ্ত দিয়ে চলছে কার্যক্রম। ভিসি পদ শূন্য থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, দ্য পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, মানারাত ইউনিভার্সিটি, সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ, প্রিমিয়াম ইউনিভার্সিটি, স্টেট ইউনিভার্সিটি, প্রাইম ইউনিভার্সিটি, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি, প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি, রয়েল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বরেন্দ্র ইউনিভার্সিটি, হামদার্দ বিশ্ববিদ্যালয়, এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, খাজা ইউনুস আলী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ অ্যান্ড সায়েন্স, রাজশাহী সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি, সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, জার্মান ইউনিভার্সিটি, গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি, সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সৈয়দপুর, নাটোরের কাদিরাবাদ এবং কুমিল্লার বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি, মানিকগঞ্জের এনপিআই ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, খুলনার নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি, বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব স্কিল এনরিচমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজি, খুলনার আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি।

ভিসি ও প্রোভিসি নেই যে ২৭ বিশ্ববিদ্যালয়ে: এর বাইরে বিশ্ববিদ্যলয়ের প্রশাসনিক শীর্ষপদ ভিসি ও প্রোভিসি নেই এমন বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ২৭টি। এগুলো হলোÑ দ্য পিপলস ইউনিভার্সিটি, মানারাত ইউনিভার্সিটি, লিডিং ইউনিভার্সিটি, প্রিমিয়াম ইউনিভার্সিটি, প্রাইম ইউনিভার্সিটি, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি, প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি, রয়েল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, এক্সিম ব্যাংক বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়, খাজা ইউনুস আলী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ অ্যান্ড সায়েন্স, রাজশাহী সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, জার্মান বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি, সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সৈয়দপুর, নাটোরের কাদিরাবাদ এবং কুমিল্লার বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি, মানিকগঞ্জের এনপিআই ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, বান্দারবান বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব স্কিল এনরিচমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজি, খুলনার আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি।

অন্য যেসব পদে রয়েছে সংকট: এর বাইরেও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক, গণ বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, প্রাইম ইউনিভার্সিটি, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি, শান্তা মারিয়াম ইউনিভার্সিটি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, আশা ইউনিভার্সিটির মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও নেই সরকারের নিয়োগ করা প্রোভিসি। 

এছাড়া ট্রেজারার নেই আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি, গ্রিন ইউনিভার্সিটি, দ্য মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটি, ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি, নর্থ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামী ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির মতো আরও ২৮ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন: ভিসি, প্রোভিসি কিংবা ট্রেজারার নেই এমন কয়েক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, ‘আমরা শূন্য পদগুলো পূরণ করার চেষ্টা করছি। অনেকে নিয়োগের জন্য প্যানেল পাঠিয়েছেন বলেও জানিয়েছেন। আবার কেউ কেউ জানিয়েছেন, তারা যোগ্য লোক খুঁজছেন। ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ বলেন, এসব সমস্যা আমরা খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। দ্রুত এসব শূন্যতা পূরণ করার জন্য সরকারের শীর্ষমহল থেকেও তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। আশা করছি খুব শিগগিরই এসব পদে নতুন নিয়োগ দেওয়া হবে।

আরবি/জেডআর

Link copied!