ঢাকা সোমবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০২৫

কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক বাধা

মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৭, ২০২৫, ০২:২০ এএম

কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক বাধা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

৫ আগস্টের পর কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা আরও বেপরোয়া হয়েছে উঠেছে। হঠাৎ সারা দেশে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা নানামুখী অপরাধে যুক্ত হচ্ছে। তারা অনেক সময় ভাড়াটে খুনি হিসেবে কাজ করছে। অপরাধ বিশ্লেষকেরা বলছেন, এখন থেকে সতর্ক না হলে কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন হয়ে উঠেবে।

এটি এখন গলার কাঁটা হয়ে উঠতে শুরু করছে। এই অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য সমাজের সব শ্রেণির মানুষকে সামাজিকভাবে সতর্ক ও এগিয়ে আসতে হবে। তবে অতীতে বারবার কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক বাধা এসেছে। এবারও সেই একই বাধা মোকাবিলা করছে পুলিশ। সূত্র জানায়, এসব গ্যাংয়ে স্কুল-কলেজে পড়ুয়া ছেলেমেয়ে বেশি। তাছাড়া বস্তিকেন্দ্রিক উঠতি বয়সি ছেলেমেয়েরা বেশি যুক্ত বলে জানা যায়।

পুুলিশ জানায়, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, ইমো, টেলিগ্রামসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা সবাই ঔক্যবদ্ধ নানা ধরনের অপরাধ করে চলেছে। এসব অপরাধের সঙ্গে যুক্ত আছে বিভিন্ন রাজনৈতিক চক্র। মূলত তাদের কারণে সারা দেশে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে কিশোর অপরাধীরা। 

গোয়েন্দা তথ্য ও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারা দেশে কিশোর গ্যাং চক্রের সদস্যরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে বিভিন্ন এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে।  এজন্য তারা আব্বা বাহিনী, বাবা বাহিনী, সাদা বাহিনী, কালা বাহিনী, ককটেল বাহিনী, কাটা বাহিনী, ধাওয়া বাহিনীসহ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নাম ধারণ করছে।

গত শনিবার ভাষানটেকে চাঞ্চল্যকর আলাউদ্দিন মন্টু হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি মো. সাইদুলকে বিদেশি পিস্তল ও গুলিসহ গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাকে ধরার পর পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তার হওয়া ওই যুবক কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। তার নেতৃত্বে বিভিন্ন ধরনের কিশোর অপরাধ সংঘটিত হয়ে আসছিল। 

আর রাজধানীর পল্লবীতে চাঞ্চল্যকর মঞ্জুরুল ইসলাম বাবু ওরফে ব্লেড বাবু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলার এজাহারনামীয় আরেক আসামি ইরফান হোসেন তুফানকে (১৯) গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাকে ধরার পর ডিবি জানায়, তুফান আগে থেকেই কিশোর অপরাধে যুক্ত। সে ভাড়াটে খুনি হিসেবে কাজ করছে। 

এছাড়া গত ৬ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর আদাবর ১৬ নম্বর রোডের একটি বাসায় লকার ভেঙে ৪৫ ভরি সোনা লুটের ঘটনায় দুই কিশোরকে আটক করে পুলিশ। তবে এ ঘটনায় জড়িত আরও অনেক কিশোর-তরুণ এখনো আটক হয়নি। এর আগে রাজধানীর আদাবর থানাধীন মেহেদীবাগ এলাকায় এক তরুণীকে উত্ত্যক্ত করে আসছিল কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। একপর্যায়ে মেয়েটিকে প্রকাশ্যে মারধর করে তারা। এমনকি তরুণীর অভিভাবককে হত্যার হুমকি দিয়ে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে। পরিবারের আতঙ্কিত সদস্যরা কিছুদিন এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়। পরে পুলিশের নিরাপত্তার আশ্বাসে তারা ফিরে আসে। এরপর ওই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়।  তবে এখনো কেউ গ্রেপ্তার না হওয়ায় পরিবারটি আতঙ্কে রয়েছে।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, আগেও কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সংঘটিত করত। ৫ আগস্টের পর এটা বহু গুণে বেড়েছে। অনেক স্কুল-কলেজের ছাত্রদের বা উঠতি বয়সি অপরাধী কিশোরদের ধরলে ছাত্র-জনতার তদবি থাকে, এজন্য কিশোর অপরাধ সামাজিকভাবে একটি ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে।

জানা যায়, রাজধানীসহ সারা দেশের অনেক এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের দৌরাত্ম্য রয়েছে, যা এলাকাবাসীকে আতঙ্কের মধ্যে রেখেছে। ঢাকার বাইরে অনেক জেলা, উপজেলা ও প্রত্যন্ত এলাকায়ও এমন কিশোর গ্যাংয়ের উপদ্রবের তথ্য দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।  সম্প্রতি পুলিশের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ঢাকার মধ্যে উত্তরা, মিরপুর, মুগদা, মহাখালী, আদাবর, মোহাম্মদপুর, আমিন বাজার, কেরানীগঞ্জ, টঙ্গীসহ বেশ কিছু এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা সবচেয়ে বেশি।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ঢাকাসহ সারা দেশে ২০ হাজারের বেশি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য রয়েছে। এর মধ্যে আদাবর এলাকার আলিফ হাউজিং, শ্যামলী হাউজিং, শেখেরটেক ও ঢাকা উদ্যান, মিরপুর এলাকার সব ধরনের অপরাধের সঙ্গে তাদের জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে পুলিশ। তাছাড়া অনেক জেলায়ও কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধ বেশি। এ ছাড়া উত্তরা, পুরান ঢাকার বিভিন্ন মহল্লা, ডেমরাসহ রাজধানীর ৫০টি থানা এলাকায় কিশোর-তরুণ গ্যাংয়ের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ৫ আগস্টের পর কয়েক গুণ বেড়েছে।

সূত্রমতে, গত পাঁচ মাসের বেশি দেশের সর্বত্র কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য ব্যাপক বেড়েছে।  হত্যা, ছিনতাই, ডাকাতিসহ রাজনৈতিক মিছিল-মিটিংয়ে অর্থের বিনিময়ে ভাড়াটে অপরাধী হিসেবে তারা কাজ করছে। প্রতিদিনই এদের আটক করা হচ্ছে।

তবে, জামিন নিয়ে ফের তারা একই কাজ করছে বলে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়। পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে, এসব কিশোর-তরুণ পাড়া-মহল্লারই উঠতি বয়সি বখাটে ছেলে। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিজেদের স্বার্থে তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করছেন।

পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম সম্প্রতি বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের নতুন তালিকা করে অভিযান চালাতে সারা দেশে পুলিশের সব ইউনিট-প্রধানকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তরে গত পাঁচ মাসে দফায় দফায় বৈঠক করে তাদের নিয়ন্ত্রণের পথ খোঁজা হয়েছে।  জেলা পুলিশ সুপারদের এ বিষয়ে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সদর দপ্তর সূত্র বলছে, ডিএমপির প্রতিটি থানা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য রয়েছে। ঢাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ৪০ শতাংশই কিশোর। আগের চেয়ে তাদের দলে সদস্যসংখ্যা বেড়েছে। তাদের হাতে এখন পিস্তলসহ আধুনিক ধারালো অস্ত্রও রয়েছে। তারা ভাড়াটে খুনি হয়েও কাজ করছে।

আর পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, শুধু রাজধানীতেই নয়, দেশের প্রতিটি থানা এলাকায় কিশোর-তরুণ গ্যাংয়ের সদস্য আরও বেড়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা গ্রামীণ জনপদেও ছড়িয়ে পড়েছে। পুলিশ বলছে, মাদক, বাড়তি টাকার লোভ, আইনকে তোয়াক্কা না করে নিজেকে বড় ভাবার প্রবণতা, বেকারত্ব, অভিভাবকদের দায়িত্বহীনতাসহ আরও বেশ কয়েকটি কারণে তারা দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে উঠছে।

জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) এনামুল হক সাগর বলেছেন, বর্তমানে সামাজিক অপরাধের মূলে রয়েছে কিশোর-তরুণ গ্যাংয়ের সদস্যরা। এটি নিয়ন্ত্রণে। পুলিশের পাশাপাশি অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এই অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ ও গ্রেপ্তার করতে তৎপর রয়েছেন।

তাছাড়া এটি নিয়ন্ত্রণের জন্য সামাজিকভাবে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তা করতে হবে। অন্যদিকে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, সম্প্রতি কিশোর অপরাধের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় এসব বিষয়ে পুলিশকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।  সেই সঙ্গে এটি নিয়ন্ত্রণের জন্য জনসাধারণকে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় পুলিশ বাহিনীর একার পক্ষে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়ে উঠবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা লক্ষ করছি, জুলাই-আগস্টে সরকারের পতনের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তেমন মাঠে না থাকায় এটি কয়েক গুণ বেড়েছে।’  তিনি বলেন, বর্তমান সময়ে শিশু-কিশোররা সাইবার অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকÑ এসব প্ল্যাটফর্মে কোনো একটি চরিত্র দেখে নিজেকে আসল হিরো সাজাতে চায় অনেক শিশু-কিশোর। বাস্তব জীবনেও সেগুলোর প্রতিফলন ঘটাতে চায়। সে ক্ষেত্রে যখন নিজের মতো আরও অনেককে পেয়ে যায়, তখন তারা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তেমনটাই করছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। তারা দল বেঁধে বিভিন্ন অপরাধে জড়াচ্ছে।

এই অপরাধ বিশ্লেষক মনে করেন, কিশোর অপরাধ দমনে সঠিক পথে ফেরাতে কাজ করতে হবে পারিবারিক, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় সব জায়গা থেকে। যারা নিজেদের স্বার্থে কিশোরদের ব্যবহার করে তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। যারা এসব কিশোর গ্যাং কালচার প্রতিরোধ করবে, তাদেরও দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে। এলাকার রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী সবার অংশগ্রহণ প্রয়োজন। সামাজিকভাবে সবাই মিলে একটি গাইডলাইন তৈরি করলে এটি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। তবে নতুন সরকারের এই সময়ে কিশোর অপরাধ দমনে রাজনৈতিক কিছু বাধা নতুনরূপে তৈরি হয়েছে বলে বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।

আরবি/জেডআর

Link copied!