নানা সমস্যাকে কেন্দ্র করে দীর্ঘ ৮ বছর পর বিচ্ছেদ ঘটল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি সাত কলেজের। অধিভুক্তি থেকে বের হওয়ার পর কলেজগুলোর চলতি শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষাসহ কলেজগুলোর এখন দেখভাল কে করবে তা নিয়ে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন।
খোদ শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদও উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, সাত কলেজ নিয়ে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, তা সমাধানের পথ ভেবে পাচ্ছি না। তার ভাষ্য, সরকারকে না জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি চলতি বছর থেকেই সাত কলেজের বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এই সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে।
যদিও এই সাত কলেজ নিয়ে নতুন করে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বা স্বতন্ত্র কোনো কর্তৃপক্ষ করার চিন্তা রয়েছে সরকারের। তবে সেই প্রক্রিয়া বেশ সময়সাপেক্ষ ও জটিল বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
অন্যদিকে সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করতে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছে কলেজটির শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে সাত কলেজ নিয়ে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের রূপরেখা জানাতে সরকারকে ১৫ দিন সময় বেঁধে দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। সব মিলিয়ে হুট করে সাত কলেজ অধিভুক্তি থেকে বের হয়ে আসায় দেখা দিয়েছে জগাখিচুড়ি অবস্থা।
সংকটের শুরু যেভাবে
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা রাজধানীর সরকারি সাতটি কলেজকে ২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। সেই হিসাবে প্রায় আট বছর ঢাবির অধীনে ভর্তি ও শিক্ষা কার্যক্রম চলে সাত কলেজে।
এই আট বছরে তীব্র সেশনজট, নেগেটিভ মার্ক যুক্ত করা, প্রশাসনিক কাজে হয়রানি, পরীক্ষা ফি বেশি, পড়াশোনার মানোন্নয়ন না হওয়ায় পরের বছর থেকে অধিভুক্তি থেকে বের হয়ে আসার জন্য আন্দোলনে নামে কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা।
তারা ঢাবি থেকে বের হয়ে সাত কলেজ নিয়ে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবি তুলে। সর্বশেষ তাদের দাবির মুখে বিষয়টি কাজ শুরু করে সরকারের গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি । সংকট সমাধানে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় না অন্য প্রক্রিয়ায় তা নিয়ে এখনো চলছে বিশেষজ্ঞ কমিটির চুলচেরা বিশ্লেষণ।
এই প্রক্রিয়া চলমান গত রোববার ভর্তি পরীক্ষায় অযৌক্তিক কোটা পদ্ধতি বাতিলসহ পাঁচ দফা দাবির অগ্রগতি জানতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচনা করতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য অধ্যাপক মামুন আহমেদ সাত কলেজের অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীকে অপমান করেন।
এমন অভিযোগ তুলে ওই রাতেই সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবন ঘেরাও করতে গেলে সংঘর্ষে জড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। রাত সাড়ে ৩টা পর্যন্ত নীলক্ষেত, সায়েন্স ল্যাব, নিউমার্কেটসহ আশপাশের এলাকায় দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে।
এরপর গত সোমবার সাত কলেজের অধ্যক্ষদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের জরুরি বৈঠক শেষে অধিভুক্তি বাতিলের ঘোষণা দেওয়া হয়।
ওই দিন বৈঠকের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা আলোচনার মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের সম্মানজনক পৃথকীকরণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
আমাদের সিদ্ধান্ত ছিলÑ আগামী বছর ২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে সাত কলেজের ভর্তি কার্যক্রম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করবে না। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেই সিদ্ধান্ত আমরা এক বছর এগিয়ে এনেছি। চলতি (২০২৪-২৫) শিক্ষাবর্ষ থেকে সাত কলেজের ভর্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়া হবে না।’
এই অধিভুক্তি বাতিলের পরপরই সাত কলেজ কার অধীনে থাকবে তা নিয়ে দেখা দেয় প্রশ্ন। চলতি শিক্ষা বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা নিয়েও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
সমাধান কোন পথে
সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া এই সাত কলেজ দেখাভালের দায়িত্বে কে থাকবে সেটা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এই কলেজগুলোকে এখন আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি করা যাবে না। করার চেষ্টা করা হলেও শিক্ষার্থীরা তা মানবেন না।
আবার শিক্ষার্থীদের যে দাবি, সাত কলেজ নিয়ে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা সেটাও অনেক সময়সাপেক্ষ। কারণ হুট করেই একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা যায় না। আবার তাদের দেখভালের জন্য আলাদা ইউনিট ও কর্তৃপক্ষ গঠন করাও বেশ জটিল। কারণ সেই ইউনিট বা কর্তৃপক্ষকে আবার তদারকি করবে কে? সব মিলিয়ে পরিস্থিতি অনেক জটিল হয়েছে।
অন্যদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির দুই শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, সাত কলেজকে গুচ্ছ থেকে বের করে আনার জন্য আমরা কাজ করছিলাম। এরই মধ্যে তারা গুচ্ছ থেকে বের হয়ে জটিল সংকট তৈরি করেছে।
শিক্ষার্থীদের দাবিমতো, বিশ্ববিদ্যালয় করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় বললেই করা যায় না। আবার সাত কলেজের একটি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা আবার নিজেরা বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবি জানাচ্ছেন। তারা দাবি না মানলে ফের রেললাইন অবরোধের হুমকি দিয়েছেন। এত দাবি কি মানা সম্ভব?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সমকক্ষ একটি স্বতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর রূপরেখা প্রণয়নে একটি কমিটি গঠন করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
চার সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান করা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যানকে। চার সদস্যের অন্যরা হলেন- শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ও ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক তানজিমউদ্দিন খান।
জানতে চাইলে কমিটির প্রধান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক তানজিমউদ্দিন খান বলেন, কোনো প্রকার আলাপ-আলোচনা না করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাতটি কলেজের অধিভুক্তি বাতিল করে পরিস্থিতি আরও জটিল করা হলো। সমস্যা সমাধানের বিষয়টি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে।
অধিভুক্তি বাতিলের পর পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে জানতে চাইলে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক এ. কে. এম. ইলিয়াস বলেন, ইতিমধ্যে একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটি যে সুপারিশ করবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আর আমরা চলমান পরীক্ষাগুলো স্থানীয়ভাবে নেব, যাতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন কোনোভাবেই বিঘ্নিত না হয়।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তিতে পরিচালিত হবে কি না জানতে চাইলে কবি নজরুল সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, না, তা হবে না। নতুন কোনো কর্তৃপক্ষের অধীনে।
সরকারের ভাষ্য: শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে ঘোষণা দিয়েছে, এটা আমার সাথে আলোচনা করে তো দেয়নি। তাদেরকে (সাত কলেজে) এ বছর থেকেই ভর্তি করা হবে না, এটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।
সাত কলেজ নিয়ে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, তা সমাধানের পথ ভেবে পাচ্ছেন না জানিয়ে তিনি বলেন, নিজেদের অধীনে সাত কলেজের ভর্তি এ বছরই বন্ধের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তার জন্য সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে।
শিক্ষা উপদেষ্টা আরও বলেন, সাত কলেজ নিয়ে নতুন একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় করা হবে। অন্তর্বর্তী সরকার সাত কলেজকে নিয়ে একটি আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কাঠামো তৈরির মডেল নিয়ে কাজ করছিল। কারণ এই সংকট দীর্ঘদিনের। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেখানে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের ভূমিকা খুবই দুঃখজনক।
সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত হবে তা নিয়ে আলোচনা হবে। অন্যদিকে নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরির নতুন মডেল নিয়ে প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে, তবে বিষয়টি জটিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপরেখা জানাতে ১৫ দিন সময় দিল সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা: সাত কলেজ নিয়ে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের রূপরেখা জানাতে সরকারকে ১৫ দিন সময় বেঁধে দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। তবে সরকারি সাত কলেজের সামনে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস বা কোনো যানবাহন চলাচল করতে না দেওয়া এবং ও নিউমার্কেট থানা ঘেরাওয়ের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন তারা।
গতকাল মঙ্গলবার ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরকারের শীর্ষ মহলের আলোচনা শেষে সাত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের রূপান্তর টিমের ফোকাল পারসন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুর রহমান এ তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, সাত কলেজ নিয়ে কেমন বিশ্ববিদ্যালয় হবে তার একটি রূপরেখা চাচ্ছি। আমাদের যে কমিটি (সাত কলেজকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখা প্রণয়নে কমিটি) তারা জানিয়েছে, তাদের কাজ শেষ। তারা বলছেন, খুব তাড়াতাড়ি দিয়ে দেবেন। তবে আমরা ১৫ দিনের সময় বেঁধে দিয়েছি।
তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরে ৪৮ ঘণ্টা আলটিমেটাম: সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করতে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। তা না হলে বৃহস্পতিবার থেকে মহাখালীর সড়ক ও রেলপথ অবরোধের ঘোষণা দিয়েছেন তারা। গত সোমবার রাতে সভা করে কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম ‘তিতুমীর ঐক্য’ সভা করে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জানতে চাইলে আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফর্মের একজন গণিত বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম বলেন, আমরা ৪৮ ঘণ্টা সময় দিয়েছি সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করতে।
এ সময়ের মধ্যে ভিসি-প্রোভিসি নিয়োগ দিয়ে প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করা না হলে ৩০ জানুয়ারি বা বৃহস্পতিবার বারাসাত টু মহাখালী বেরিকেড বা মহাখালীতে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ কর্মসূচি পালন করব। তিনি আরও বলেন, তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়া পর্যন্ত ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে শাটডাউন তিতুমীর কর্মসূচি পালন চলবে।
আপনার মতামত লিখুন :