ঢাকা বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫

ওরাকল ও লেভেল-থ্রি’র চুক্তি বাতিলের সম্ভাবনা

শাওন সোলায়মান

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৯, ২০২৫, ১১:২৯ এএম

ওরাকল ও লেভেল-থ্রি’র চুক্তি বাতিলের সম্ভাবনা

গাজীপুরের কালিয়াকৈরে হাইটেক পার্কে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের আওতাধীন বাংলাদেশ ডেটা সেন্টার কোম্পানির (বিডিসিএল) একটি টিয়ার-ফোর ডেটা সেন্টার রয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে এখানে ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছে লেভেল-থ্রি ক্যারিয়ার লিমিটেড নামের একটি আইআইজি প্রতিষ্ঠান। 

প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায় রয়েছে সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের ছেলে ও কিশোরগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক ওরফে তৌফিক হামিদ। পাশাপাশি ডেটা সেন্টারটিতে ক্লাউড সেবা দিতে দরপত্র ছাড়াই ওরাকলকে দেওয়া হয়েছিল ১ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলারের কাজ। 

তবে বিডিসিএলে ইন্টারনেট সরবরাহে লেভেল-থ্রি এবং ক্লাউড সেবায় ওরাকলের সঙ্গে করা পৃথক চুক্তিগুলো এখন ‘রিভিউ’ করছে আইসিটি বিভাগ। চুক্তিগুলো বাতিল হতে পারে বলে রূপালী বাংলাদেশকে জানিয়েছেন আইসিটি সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী।

২০১৯ সালের জুলাইয়ে বিডিসিএলে ইন্টারনেট সরবরাহে প্রথমবারের মতো কাজ পায় লেভেল-থ্রি। ২০২২ সালে সেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে কোনো ধরনের নতুন দরপত্র ছাড়াই আরও ৩ বছরের জন্য লেভেল-থ্রির সঙ্গে চুক্তি করে বিডিসিএল। 

সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের প্রশাসনে দুই দফা চুক্তির সময় বিডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে ছিলেন আবু সাঈদ চৌধুরী। ২০২২ সালের জুনে করা চুক্তিপত্রের একটি রয়েছে দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের কাছে। 

চুক্তিপত্রটি বিশ্লেষণে দেখা যায়, ‘সি-মি-উই-৪’, ‘সি-মি-উই-৫’ এবং ইন্টারন্যাশনাল টেরিস্ট্রিয়াল কেব্লের (আইটিসি) মাধ্যমে বিডিসিএলে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ দেবে লেভেল-থ্রি। এ জন্য আনুষঙ্গিক ডিভাইস ও সেবাও দেবে প্রতিষ্ঠানটি।

২০২২ সালের ২৬ জুন লেভেল-থ্রিকে আবু সাঈদ চৌধুরী স্বাক্ষরিত ‘নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড’ ইস্যু করে বিডিসিএল। নোটিফিকেশনের বদৌলতে সে বছরের ৩০ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি স্বাক্ষর করে বিডিসিএল এবং লেভেল-থ্রি। 

বিডিসিএলের তৎকালীন এমডি আবু সাঈদ এবং লেভেল-থ্রির এমডি আহমেদ জুনায়েদ নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। ২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত তিন বছরমেয়াদি এই চুক্তিতে লেভেল-থ্রি পাবে ৪১ কোটি চার লাখ টাকা। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, লেভেল-থ্রির একজন অন্যতম শেয়ারহোল্ডার তৌফিক হামিদ। তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের ছেলে। ২০১৩ সালে আব্দুল হামিদ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে শূন্য হয় কিশোরগঞ্জ-৪ আসন। এই আসনের উপনির্বাচনে একই বছর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তৌফিক হামিদ। তখন থেকে গত বছরের ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত সংসদ সদস্য ছিলেন তৌফিক।

অভিযোগ উঠেছে, তৌফিক হামিদের প্রভাব খাটিয়েই বিডিসিএলের মতো সরকারি দরপত্র পেয়েছে লেভেল-থ্রি। এ ছাড়া ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে সাবমেরিন কেব্ল সিস্টেম এবং সার্ভিসেসের লাইসেন্স পেয়েছে ‘মেটাকোর সাবকম লিমিটেড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। 

এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের মাঝে আছেন লেভেল-থ্রির এমডি আহমেদ জুনায়েদ, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সাবেক মেয়র আনিসুল হকের ছেলে নাভিদুল হক এবং ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইআইজিএবি’র সভাপতি আমিনুল হাকিম। মেটাকোরের উদ্যোক্তাদের এই লাইসেন্স পাইয়ে দিতেও তৌফিক হামিদের প্রভাব রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

আইসিটি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বিডিসিএলে লেভেল-থ্রির ইন্টারনেট সরবরাহের চুক্তিটি পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে। সম্ভাবনা রয়েছে এই চুক্তি বাতিল হওয়ার। এ বিষয়ে আইসিটি বিভাগের সচিব ও বিডিসিএলের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান শীষ হায়দার চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতির ছেলে ওই প্রতিষ্ঠানে (লেভেল-থ্রি) আছে কি না সেটা জানি না। তবে এই চুক্তিটি মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এটা সত্যি যে দ্বিতীয় দফায় সরাসরি তাদের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। পূর্বের ঠিকাদারের কাজে সন্তুষ্ট হলে এমনটা করা যায়। তবুও পুরো বিষয়টি দেখা যাবে। খুব সম্ভবত লেভেল-থ্রির সঙ্গে চুক্তিটি থাকবে না।

লেভেল-থ্রিতে তৌফিক হামিদের ব্যাবসায়িক অংশীদারত্ব থাকলেও অন্যান্য অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আহমেদ জুনায়েদ। পাশাপাশি বিডিসিএলের সঙ্গে লেভেল-থ্রির চুক্তি বাতিলের বিষয়েও কিছু জানেন না বলে জানান তিনি। আহমেদ জুনায়েদ বলেন, বিডিসিএলের সঙ্গে আমাদের কার্যক্রম স্বাভাবিক আছে। চুক্তি বাতিল হবে বা এ ধরনের কিছু এখনো জানি না। আমাদের কিছু জানানো হয়নি। 

এ ছাড়া মূল্যায়ন করা হচ্ছে ক্লাউড সেবার জন্য ওরাকলকে দেওয়া চুক্তিও। ২০২১ সালে কোনো ধরনের দরপত্র ছাড়াই ১ কোটি ৮০ লাখ ডলার তথা সে সময়ের দর অনুযায়ী ২০৭ কোটি টাকার কাজটি ওরাকলকে দিয়েছিয়েছিলেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। 

২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বর ওরাকলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি স্বাক্ষর করে বিডিসিসিএল। তবে চুক্তি স্বাক্ষরের প্রায় আড়াই বছর পর কার্যক্রম শুরু করে ওরাকলের ক্লাউড। তবে এর মাঝেই কোন রকম দরপত্র এবং চুক্তি ছাড়া সিঙ্গাপুরে স্থাপিত ওরাকলের ক্লাউড সেবা নিতে থাকে বিডিসিএল। 

এ বাবদ এক বছরের সেবার জন্য ওরাকলকে ৪ লাখ ২০ হাজার ডলার বা ৪ কোটি ৮৩ লাখ টাকা (ডলারের দাম ১১৫ টাকা হিসেবে) পরিশোধও করে পলকের তৎকালীন প্রশাসন। তবে চুক্তিটিকে ‘অসম’ উল্লেখ করে মূল্যায়ন করছে আইসিটি বিভাগ। আইসিটি সচিব শীষ হায়দার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ওরাকলের সঙ্গে চুক্তিটি ছিল ‘অসম’। এই চুক্তিও মূল্যায়ন করা হচ্ছে, বাতিল করাও হতে পারে।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!