ঢাকা বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫

উত্তরায় ফুটপাত থেকে দিনে ২০ লাখ টাকা চাঁদা আদায়

তরিক শিবলী, উত্তরা

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৯, ২০২৫, ১১:৪৮ এএম

উত্তরায় ফুটপাত থেকে দিনে  ২০ লাখ টাকা চাঁদা আদায়

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

রাজধানীর উত্তরার আব্দুল্লাহপুর ফ্লাইওভারের নিচ থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ফুটপাতজুড়ে ছোট-বড় প্রায় ৭১৬২টি অবৈধ দোকান রয়েছে। কখনো ঠেলাগাড়িতে, কখনো ভ্যানে, আবার কখনো স্থায়ীভাবেই দোকান সাজিয়েছে সরকারি জায়গায়। 

প্রতিটি দোকান থেকে প্রতিদিন চাঁদা গুনতে হয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। ৩০০ টাকা হিসাবে প্রায় ২০ লাখ টাকার অধিক চাঁদা উঠছে প্রতিদিন। এককালীন দোকান বসানোর জন্য দিতে হয় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে দাঁড়ায় প্রায় ৯ কোটি টাকা।

এমন অভিযোগের ভিত্তিতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উত্তরা পূর্ব থানার আওতাধীন এলাকা আব্দুল্লাহপুর ফ্লাইওভারের নিচে তিন শতাধিক অবৈধ দোকান। 

ফুটপাত দখল করে অবৈধ দোকানের একজন মালিক নুরুল ইসলাম বলেন, এককালীন ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে এখানে দোকান নিতে হবে পজিশন অনুযায়ী। তারপর প্রতিদিন আড়াইশ টাকা বিএনপির নেতা আইয়ুব আলীকে দিতে হবে। 

ট্রাফিক পুলিশকে তাদের পদ অনুযায়ী কখনো পঞ্চাশ, কখনো ১০০ করে দিতে হয়। আইয়ুব আলী এ জায়গার থানা-পুলিশ সবকিছু মেইনটেইন করেন। তাই আইয়ুব আলী মার্কেটের মালিক হিসেবে পরিচিত।

এ বিষয়ে উত্তরা পূর্ব থানার ওসি মো. মুক্তাদির হাসান বলেন, দুই দিনের মধ্যে বিশেষ অভিযানের মাধ্যমে সব ফুটপাত উচ্ছেদ করে দেওয়া হবে। অবৈধ বলতে কোনো কিছুই থাকবে না। তবে আপনারা রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের সঙ্গে একটু কথা বলেন। 

তাদের জায়গায় আমাদের তেমন কিছু করার থাকে না। উত্তরা পশ্চিম থানা আওতাধীন এলাকা হাউস বিল্ডিং, নর্থ টাওয়ারের পেছনে, রাজলক্ষ্মী এলাকা, বিএনএস সেন্টার সংলগ্নÑ সব জায়গায় রয়েছে অবৈধ দোকান।

ফুটপাতের দোকানদার শাহজাহান বলেন, প্রথমে এখানে একটি ভ্যান বা আপনাকে বসার জন্য টাকা গুনতে হবে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এরপর প্রতিদিন দিতে হবে খরচ বাবদ ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। পুরো এলাকার ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করে বিএনপি নেতা ডালিম শিকদার, রফিক ও স্বাধীন। এই এলাকার ফুটপাতের বাপ-মা তারাই; তারা যা বলবে তা-ই হবে। পুলিশের গাড়ি প্রতিদিনই আসে। ট্রাফিক পুলিশ, থানা পুলিশ প্রতিদিনই আসে, দেখে-শুনে চলে যায়।

এ বিষয় নিয়ে উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি মো. হাফিজুর রহমানের সঙ্গে কথা বললে জানা যায়, অবৈধভাবে ফুটপাতে কোনো দোকান রাখা হবে না। বিশেষ অভিযান চলছে এবং সবই উচ্ছেদ করে দেওয়া হবে। 

উত্তরা তুরাগ থানাধীন এলাকায় বিস্তরভাবে গড়ে উঠেছে অবৈধ ফুটপাত বাণিজ্য, খালপাড় এলাকা, মেট্রোরেল এলাকা, দিয়াবাড়ি- সব জায়গাতেই রয়েছে অবৈধ দোকানের বাণিজ্য। দিয়াবাড়ি মেট্রোরেল সংলগ্ন ৭৫ নাম্বার পিলারের সামনে রাজউকের জায়গা দখল করে একসঙ্গে ২৮টি ফুডকোর্ট পরিচালিত হচ্ছে। খালপাড় এলাকায় অবৈধভাবে ফুটপাতে দোকানের দখল নেওয়ার বাণিজ্যে এসেছে বিএনপি নেতাদের নাম।

খালপাড়ে ব্রিজ দখল করে ব্রিজের ওপরে পুলিশের নাকের ডগায় চলছে অবৈধভাবে ফুটপাত দখলের ব্যবসা। মিন্নাত ও মুরগি সোহেল নামে এই দুই বিএনপি নেতা পুরো এলাকার সব ফুটপাত পরিচালনা করেন। 

ক্ষুদ্র চা দোকান ব্যবসায়ী মোতালেব বলেন, ‘মিন্নাত আর মুরগি সোহেল রে বললে রাজউকের যেকোনো জায়গায় দখল করে আপনার দোকান বানায় দিব। আপনি শুধু টাকা দিলেই হবে। পুলিশের গাড়ি আসলে শুধু বললেই হবে মিন্নাত ভাইয়ের দোকান। প্রত্যেক মাসে মাসে টাকা দিলে তারাই পুলিশের সব ব্যবস্থা করে দিব।’ 

এই বিষয়ে কথিত বিএনপির নেতা মিন্নাতের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, ফুটপাতের দোকানদার মানেই গরিব মানুষ আর গরিব মানুষকে একটু সহযোগিতা করলে অসুবিধা কী? এ বিষয়ে তুরাগ থানার ওসির কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনি কোন জায়গায় ফুটপাত দেখেছেন অবৈধ, আমাকে ইনফরমেশন দেন আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি। 

এয়ারপোর্ট এলাকাতেও চলছে ফুটপাত দখলবাণিজ্য। এয়ারপোর্টে ফুটবল ব্যবসায়ী কামাল বলেন, ‘এখানে জায়গাগুলো হচ্ছে রেলের জায়গা। রেলের আরএমবি প্রতিদিন ৭০০ টাকা করে নিয়ে যায় আমাদের কাছ থেকে। আর এখানে দোকান লাগানোর জন্য রেলকে দিতে হয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। রেল পুলিশ থেকে শুরু করে সবাই ভাগ-বাটোয়ারা করেই খায়। তাই ব্যবসা করতে তেমন একটা সমস্যা হয় না।’ 

এই বিষয় নিয়ে এয়ারপোর্ট রেলস্টেশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে কেউই গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী নন। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলের এক কর্মকর্তা বলেন, ব্যাপারটি আমাদের জানা ছিল না আপনার কাছ থেকে শুনলাম, ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

এ বিষয়ে এয়ারপোর্ট থানার ওসি তাসলিমা আক্তার বলেন, অবৈধ ফুটপাতের বিষয়ে আমার আওতাধীন এলাকায় কোনো ছাড় দেওয়া হয় না। সংবাদ পাওয়া মাত্রই আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করি। 

এয়ারপোর্টের সামনে এক হকারের কাছে থেকে আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত বছর ফজলু কাকা কিছু সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেছিল, পরে একটা সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপরে শুধু ফজলু কাকার দোকানটাই নাই, বাদবাকি সবার দোকান আছে। আমি এসব ভেজালের মধ্যে নাই, কোনো কথা বলতে পারব না। 

উত্তরখান, দক্ষিণখান, রাজউক কলেজের সামনে, মাজার এলাকাÑ পুরো উত্তরাজুড়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব সড়কের ফুটপাত রয়েছে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা দোকানের দখলে। 

এ বিষয়ে উত্তরার প্রভাবশালী বিএনপি নেতা এস এম জাহাঙ্গীরের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিএনপির কোনো নেতাকর্মী এ ধরনের কাজ করতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না। তবে কিছু লোক বিএনপির নাম ব্যবহার করে এ ধরনের কাজ করে বলে আমি ধারণা করছি। এই বিষয়গুলো প্রশাসন শক্তভাবে দেখলেই সমাধান হবে। 

উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরে বসবাসকারী অ্যাডভোকেট শামসুজ্জাহান বলেন, উত্তরায় ফুটপাতের প্রভাবে কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। সারা দিন যেনতেন করে কেটে যায়, সন্ধ্যার পরে তো মনে হয় পুরো উত্তরার ফুটপাতজুড়েই মেলা। 

পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে কথা বললে তাদের শুধু অভিযান চলমান থাকে, কিন্তু আমি এখন পর্যন্ত আমার বাসার সামনে ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, লুবানা হাসপাতাল, বাংলাদেশ মেডিকেল। এখানে অবৈধ একটি দোকানও কমতে দেখিনি বরং বাড়তে দেখেছি। সন্ধ্যার পর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত পুরো উত্তরার ফুটপাত থাকে অবৈধ দোকানের দখলে। 

ডিএনসিসি ৪৭নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা খন্দকার সাজ্জাদ হোসেন বলেন, মেট্রোরেলে উত্তরা পৌঁছতে লাগে ৩০ মিনিট, ফুটপাতের দখলবাণিজ্য আর রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িÑ সব মিলিয়ে আমার বাসা থেকে এক কিলোমিটার যেতে সময় লাগে এক ঘণ্টা।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!