ঢাকা বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫

৭ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাতের শঙ্কা

মাইনুল হক ভূঁইয়া

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৯, ২০২৫, ১১:৫৪ এএম

৭ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাতের শঙ্কা

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে ধেয়ে আসছে বড় ধরনের শক্তিশালী ভূমিকম্প। রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার এই ভূমিকম্প যেকোনো সময় আঘাত হানতে পারে। একটির উৎপত্তিস্থল টাঙ্গাইলের মধুপুর, অপরটি সিলেটের ডাউকি। 

এমন আভাস দিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী। গত সোমবার রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, সাধারণত কোনো চ্যুতি রেখার মেয়াদ এক-দেড়শ বছর পার হয়ে গেলে শক্তিশালী ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়। সে হিসাবে মধুপুর ও সিলেটের চ্যুতি রেখা প্রায় ১২৫ বছর অতিক্রম করেছে। 

বলতে গেলে দুটিই পরিপক্ব হয়ে গেছে। সবকিছু আল্লাহপাকের হাতে। তবু গণনা বলে, যেকোনো সময় যেকোনো একটি চ্যুতি রেখা থেকে বড় ধরনের ভূমিকম্পের উৎপত্তি হতে পারে, রিখটার স্কেলে যার মাত্রা হবে ৭। 

এদিকে রাজউকের আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, মধুপুরে উৎপত্তি হওয়া সম্ভাব্য বড় ভূমিকম্পের ফলে রাজধানী ঢাকার কম করে হলেও ৮ লাখ ৬৪ হাজার ৬১৯ থেকে ১৩ লাখ ৯১ হাজার ৬৮৫টি ভবন ধসে বা ভেঙে পড়বে। 

উৎপত্তিস্থল সিলেটের ডাউকি হলে ৪০ হাজার ৯৩৫টি থেকে ১৪ হাজার ৭৪২টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর মধুপুরের ভূমিকম্প যদি দিনের বেলায় আঘাত হানে, তাহলে কমবেশি ২ লাখ ১০ হাজার মানুষ মারা যাবে, আহত হবে ২ লাখ ২৯ হাজার। 

কারণ হিসেবে এই প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, দিনের বেলায় অফিস-আদালত ও কলকারখানায় জনসমাগমের আধিক্য থাকায় এই বিপুল পরিমাণ মানুষের মৃত্যু হতে পারে। রাজউকের ওই সমীক্ষায় মত প্রকাশ করা হয়েছে, সম্ভাব্য এই ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ভবন মেরামত ও পুনর্নির্মাণে ব্যয় হবে প্রায় ৪ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা।

এক সপ্তাহের ব্যবধানে ২ ও ৩ জানুয়ারি ঢাকাসহ সারা দেশে দুটি ছোট আকারের ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ায় বড় ধরনের শক্তিশালী ভূমিকম্পের সম্ভাবনাটি সামনে চলে এসেছে। দুই দিনের ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৫ ও ৫ দশমিক ১। 

উৎপত্তিস্থল ছিল মিয়ানমার সীমান্ত। উৎপত্তিস্থল ঢাকা থেকে ৪৮৯ কিলোমিটার দূরে হওয়ায় দেশে কম কম্পন অনুভূত হয়েছে। এছাড়া একই এলাকায় ৩৬টি ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় ছোট ছোট ভূমিকম্প কখনো মঙ্গলজনক, আবার কখনো বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দেয় বলে মত প্রকাশ করা হয়েছে। 

গবেষণায় দেখা যায়, ভারত-মিয়ানমার সীমান্তের পার্বত্য চট্টগ্রাম অংশে গত ১০ বছরে বিভিন্ন মাত্রার ৫ হাজার ২৩৬টি ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে রিখটার স্কেলে ৫ মাত্রার ওপরে ছিল তিনটি। 

১৭৬২ সালে কক্সবাজারে এবং ১৮৫৭ সালে আসামের দিকে দুটি শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়েছিল। সেই হিসাবে সহজেই গণনা করে বলা যায়, একটি বড় ধরনের শক্তিশালী ভূমিকম্প ধেয়ে আসছে।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) চার বছরব্যাপী একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে। আরবান রেজিলেন্স নামের প্রকল্পটি ২০১৮ সালে হাতে নেয় এই সংস্থা। চার বছরব্যাপী এই সমীক্ষার মেয়াদ ছিল ২০২২ সাল পর্যন্ত। ব্যয় ৫৩৬ কোটি টাকা। আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ হেলালীকে নিয়োগ দেওয়া হয় প্রকল্প পরিচালক হিসেবে। 

ঢাকা মহানগরীর ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে সমীক্ষাটি পরিচালিত হয়। ২০২২ সালের ৩০ জুন দীর্ঘ এই সমীক্ষা প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে। ভূমিকম্প নিয়ে বড় ধরনের সমীক্ষা এটিই প্রথম।  

সেখানকার বিশেষজ্ঞ সভার কার্যপত্রে বলা হয়, ২০২১ সালে সিলেটে পরপর সাতবার এবং চট্টগ্রামে তিনবার ভূকম্পন অনুভূত হয়। গত বছর এবং এ বছরের শুরুতে সিলেট, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে বেশ কয়েকবার মাঝারি ধরনের ভূমিকম্প প্রত্যক্ষ করা গেছে।

এসব ছোট ও মাঝারি ভূমিকম্প ভবিষ্যতে বড় মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পের আভাস দেয়। ঢাকায় রাজউকের নিবন্ধিত ভবন রয়েছে প্রায় ২১ লাখ ৪৭ হাজার ২১৯টি। এর মধ্যে চারতলা ভবন ৬ লাখ। সাড়ে ৩ হাজার হাসপাতাল ও ভবন ধরে সমীক্ষাটি চালানো হয়েছে। 

রাজউকের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বলছেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে। এর আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো বাংলাদেশের অবস্থান দুইটি বিপজ্জনক চ্যুতি রেখার ওপর। একটি টাঙ্গাইলের মধুপুর, অন্যটি সিলেটের ডাউকি চ্যুতি রেখা। 

দুইজন বিশেষজ্ঞের মতে, ঢাকায় ভূমিকম্প ঝুঁকির প্রধান কারণ জলাশয় ভরাট করে ভবন নির্মাণ। এসব ভবন ভূমিকম্প সহনীয় করে নির্মাণ করা হয়নি। অনেকেই আবার নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে ভবন নির্মাণ করেছেন। অপরদিকে ১৫ বছর আগের ভবন নির্মাণ বিধিমালা অনুসরণ করা হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনুসৃত হচ্ছে ১৯৯৬ সালের বিধিমালা। ফলে ভবন নির্মাণে যথাযথ নিয়ম-রীতি রক্ষিত হচ্ছে না।

এমনকি ইটের তৈরি দেয়াল ভবনের ভূমিকম্প ঝুঁকি বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয় বলে অভিমত ব্যক্ত করে তারা বলেন, ‘আমরা যদি ভূমিকম্প সহনীয় কংক্রিট ব্লকের বেশি বেশি ব্যবহার করতে পারি, তাহলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নিঃসন্দেহে কমে আসবে।’ 

রাজউকের সুপারিশ
ভূমিকম্প ও দুর্যোগ সহনশীল নগর নির্মাণে সুনির্দিষ্টভাবে কাজ করতে একটি স্বতন্ত্র ইনস্টিটিউট গঠনের সুপারিশ করেছে রাজউক। এর নাম হবে ‘বাংলাদেশ স্ট্রাকচারাল রিস্ক অ্যান্ড রেজিলেন্স ইনস্টিটিউট (বিএমআরআরআই)। 

সুপারিশমালায় বলা হয়, ইনস্টিটিউটের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হবে ভূমিকম্প ও দুর্যোগ সহনশীল নগর নির্মাণে গবেষণা করা এবং দুর্যোগ-পরবর্তী কার্যক্রমে প্রকৌশল সহায়তা দেওয়া। এর পরিচালনা পর্ষদ হবে ১২ সদস্যের। গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব হবেন পর্ষদের চেয়ারপারসন। 

প্রস্তুতিতে প্রকল্প
ভূমিকম্পসহ বিভিন্ন দুর্যোগ মোকাবিলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ছয় বছরব্যাপী একটি পৃথক প্রকল্প গ্রহণ করে ২০২১ সালে। এটির সম্প্রসারিত মেয়াদ ২০২৭ সাল পর্যন্ত। ব্যয় বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। 

যুগ্ম সচিব কাজী শফিকুল ইসলাম প্রকল্পটির পরিচালক। উপরোক্ত তথ্য জানিয়ে তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, দুর্যোগ-পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ঢাকা, সিলেট, রংপুর ও টাঙ্গাইলে ৭৮ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। 

তাছাড়া প্রয়োজনীয় বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থার কাছে যেসব যন্ত্রপাতি রয়েছে, এর একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। পরবর্তীতে যেখানে যে যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হবে, সেখানে তা পাঠানো হবে।

এজন্য এরই মধ্যে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, পুলিশ, আনসার, র‌্যাব এবং নৌবাহিনীকে এই প্রকল্পের আওতায় প্রয়োজনীয় পরামর্শসহ কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করা হয়েছেÑ যোগ করেন কাজী শফিকুল ইসলাম। 

এদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ভূমিকম্প মোকাবিলায় সরকার ‘ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড’ প্রণয়ন করেছে। এই কোড মেনে ভবন নির্মাণে উৎসাহিত করা হলে ভবনগুলো নিঃসন্দেহে ভূমিকম্প সহনীয় হয়ে উঠবে
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!