বিগত স্বৈরাচারী সরকারের সময়ও দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দুর্বল ছিল। গত ছয় মাসে অর্থনীতিতে তেমন চাঞ্চল্য ফেরেনি। অন্তর্বর্তী সরকার কর্মসংস্থান বাড়াতে পারেনি। সিপিডি বলেছে, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতা না থাকলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসে না। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ঘোষিত সময়ের মধ্যেই নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা। গতকাল বুধবার রাজধানীর ধানমন্ডির সংস্থাটির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলা হয়।
‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০২৪-২৫, সংকটময় সময় প্রত্যাশা পূরণের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
সিপিডির সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, জুলাই আন্দোলনের মূল কারণ ছিল কর্মসংস্থানের অভাব। বিগত সরকারের বৈষম্যমূলক নীতি বেকারত্ব পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছিল। সমাজে বৈষম্য বেড়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে কর্মসংস্থান বাড়াতে পারেনি। এ সময় অন্যদের মধ্যে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা ফেলো মুনতাসির কামাল, সৈয়দ ইউসুফ সাদাতসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
সংস্থাটি বলছে, জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া কোনো সরকার বেশিদিন থাকতে পারে না। অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন চায় তারা। অনুষ্ঠানে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ডিসেম্বর থেকে পরের বছর জুনের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছে। আমরা চাই, সরকার ঘোষিত রোডম্যাপের মধ্যেই নির্বাচন হোক। যত দ্রুত সম্ভব গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যেতে হবে।’ অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আজ এ প্রসঙ্গে আলোচনা হয়।
এ প্রসঙ্গে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকার এমন সময়ে ভ্যাট বাড়াচ্ছে, যে সময়ে সাধারণ মানুষ মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পিষ্ট। মজুরির চেয়ে মূল্যস্ফীতি দ্বিগুণ। অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সুযোগ এসেছিল প্রত্যক্ষ কর বাড়ানো। কিন্তু সরকার সে পথে হাঁটেনি। তারা পরোক্ষ করের ওপর বেশি জোর দিচ্ছে।
মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, জনগণ যে কর দেয়, সরকার পুরোপুরি পায় না। সরকারের সুযোগ ছিল এসব জায়গায় হাত দেওয়ার, কিন্তু দেয়নি। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বলেনি ভ্যাট বাড়াতে। তারা বলেছে, যেকোনো উপায়ে রাজস্ব বাড়াতে। কিন্তু সরকার প্রত্যক্ষ কর না বাড়িয়ে পরোক্ষ কর বাড়াচ্ছে।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, চলতি অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৩ দশমিক সাত শতাংশ। গত বছর একই সময় তা ছিল ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ। এতে দেখা যাচ্ছে, রাজস্ব আহরণে উল্লেখযোগ্য অবনতি হয়েছে।
রাজস্ব আদায়ের পাশাপাশি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি বাস্তবায়ন, মূল্যস্ফীতি কর্মসংস্থান, বেসরকারি বিনিয়োগে দৃশ্যমান কোনো উন্নতি নেই। অন্তর্বর্তী সরকার বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে, তবে সফলতা এখনো দেখা যায়নি। ফাহমিদা খাতুন বলেন, এ সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, জনসম্মুখে বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি প্রকাশ করবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এসব চুক্তি উন্মুক্ত করা হয়নি। বিগত সরকারের সময়ের ২৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের নথি চেয়ে সম্প্রতি তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেছিল সিপিডি। তবে জাতীয় নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে এই যুক্তি তুলে ধরে ২৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের তথ্য অন্তর্বর্তী সরকার দেয়নি বলে অভিযোগ করেন ফাহমিদা খাতুন।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, জ্বালানি নিয়ে অনেক অনিয়ম হয়েছে। সরকারি অর্থ অপচয় হয়েছে। এজন্য আগের চুক্তি বাতিল করে ‘বিদ্যুৎ নেই, টাকা নেই’ নীতিতে যেতে হবে। পাশাপাশি গ্যাস-জ্বালানির নতুন উৎস বের করতে হবে। কূপ খননে জোরদার পদক্ষেপ নিতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চাঁদাবাজি এখনো চলছে। সে জন্য শুধু সুদ বাড়িয়ে পণ্যের দাম কমানো যাচ্ছে না। এ ছাড়া পণ্য সরবরাহে বেশি হাতবদলের কারণে খরচ বাড়ছে, যা কার্যত ভোক্তাকে বহন করতে হচ্ছে।
পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে ড. ফাহমিদা বলেন, পাচার অর্থ ফেরত আনার কাজ বাংলাদেশই প্রথম করছে না। বিশ্বে আরও অভিজ্ঞতা রয়েছে। সরকার সেপথে আগাতে পারে। এ জন্য বিএফআইইউকে শক্তিশালী করতে হবে। বিশেষ করে রিজার্ভ চুরির বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। সাবেক গভর্নরসহ যারা জড়িত, তাঁদের কাউকে ছাড় দেওয়া যাবে না।
সরকারের রাজস্ব আদায়ের কৌশল নিয়ে তিনি বলেন, কর বাড়াতে হবে। সেজন্য ভ্যাট নয়, সরাসরি করের আওতা বাড়াতে হবে। করের অর্থ ভালোভাবে ব্যয় করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ সহজ করতে হবে। কেননা, রাজস্ব আহরণে প্রবৃদ্ধি ১৭ দশমিক ১৭ শতাংশ থেকে কমে চলতি অর্থবছরে ৩ দশমিক ৭ শতাংশে নেমেছে। সে জন্য কর আদায় বাড়াতে হবে। আবার এডিপির ৮০ শতাংশ অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদে ব্যয় করা উচিত হয়নি। ফলে দেশের উন্নতি বাধাগ্রস্ত হবে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘দেশে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ব্যাংক অনুমোদন পেয়েছে। মূলত রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালিত কিছু ব্যাংক নাজেহাল দশায় রয়েছে। এসব ব্যাংক লাইফ সাপোর্টে, গ্রাহকেরা ঝুঁকিতে। এসব ব্যাংকের অপ্রত্যাশিত ধাক্কা সামলানোর সক্ষমতা নেই। এ জন্য সার্বিক দিক বিবেচনায় লাইফ সাপোর্টে রাখা ব্যাংক বন্ধ করা যেতে পারে।’
তিনি বলেন, ব্যাংক খাতের বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ কমাতে হলে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা যেতে পারে। প্রয়োজনে দেউলিয়া আইন পরিবর্তন করতে হবে। বিকল্প নিষ্পত্তি ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা বাড়াতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :