ঢাকা বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫

এলজিইডি এখনো তাজুল সিন্ডিকেট

মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৩০, ২০২৫, ০১:৩৩ এএম

এলজিইডি এখনো তাজুল সিন্ডিকেট

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকার পদত্যাগের পর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরে (এলজিইডি) চলছে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা। এখনো বহাল রয়েছেন ফ্যাসিস্ট সরকারের মদতপুষ্ট কর্মকর্তারা। এসব কর্মকর্তা বহাল থেকে তুঘলকি কাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

এলজিইডি হেড অফিসের সূত্রমতে, এসবের নেপথ্যে কাজ করছেন শেখ হাসিনার মদতপুষ্ট আবেদ আলী। এই আবেদ আলী কমিশনের মাধ্যমে ২০১৩ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রকৌশলী। তাদের মদত দিচ্ছেন এলজিইডিতে কর্মরত আওয়ামীপন্থি এবং স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের দালাল প্রকৌশলীরা। এই দালাল প্রকৌশলীরাই জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্পের পিডি নিয়োগের ক্ষেত্রে সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলামের সঙ্গে অর্থ লেনদেনের কাজে সরাসরি জড়িত ছিলেন।

অভিযোগে আছে, বিগত ২-১১-২০২৩ তারিখে অনুমোদিত সাবেক প্রধান প্রকৌশলীকে আহ্বায়ক ও মো. আমিরুল ইসলাম খানকে সদস্যসচিব করে ১০১ সদস্যবিশিষ্ট এলজিইডিতে একটি বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের শাখা কমিটি গঠন করা হয়।

ওই কমিটিতে ২০১৩ সালে নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে ১৮ জন সদস্য রয়েছেন। এই ১৮ জনই এলজিইডিতে যত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন। তারা সবাই সাবেক ছাত্রলীগের পদধারী নেতাকর্মী। অভিযোগ আছে, ১৮ জনের মধ্যে কেউ কেউ ইসকনের সদস্য হিসেবে কাজ করছেন। এর মধ্যে তাদের একজনের স্ত্রী অডিট অধিদপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে এলজিইডিতে প্রভাব বিস্তার করে কৌশলে সরকারবিরোধী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে সহায়তা করছেন।  

অন্য একজন কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের প্যানেলে ২০২২ সালে আইইবির নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি একজন পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীর মাধ্যমে এলজিইডি থেকে অবৈধ পথে ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা নিয়েছিলেন, যেটা নিয়ে ওই সময় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। জানা যায়, এসব অপকর্মের সঙ্গে ওই পুলিশ কর্মকর্তার সম্পর্ক রয়েছে এবং এর সঙ্গে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক একজন উচ্চপদস্থ নারী কর্মকর্তাও জড়িত।

তিনি ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পরে এসডি হয়েছেন। অন্য আরও একজন নারী কর্মকর্তা, যার ভাই ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার আমজাদ হোসেন সাবেক ছাত্রলীগের কর্মী, বাড়ি রাজবাড়ী জেলায়। আমজাদ হোসেন আওয়ামী সরকারের সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী কাজী কেরামত আলীর এপিএস ছিলেন।

অভিযোগ আছে, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অধিদপ্তর এলজিইডিতে নিয়োগ হয়েছে কখনো উচ্চ আদালতের আদেশে, কখনো বা করা হয়েছে নামমাত্র পরীক্ষার আয়োজনের মধ্য দিয়ে। এমনই এক ঘটনা ঘটেছে ২০১২ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। ওই বছর সংস্থাটির সহকারী প্রকৌশলীর একটি পদের জন্য পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন মাত্র তিনজন পরীক্ষার্থী।

তথ্য বলছে, সেই পরীক্ষায় ১৫৪টি শূন্য পদের বিপরীতে বৈধ আবেদন ছিল ১ হাজার ৫১৮টি। সেই লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন মাত্র ৩৫২ জন আর উত্তীর্ণ হন ১৬২ জন। অন্যদিকে মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ১২৭ জন এবং ১২৭ জনই কৃতকার্য হয়, অর্থাৎ শূন্য পদের চেয়ে কম পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়। 

পিএসসির সুপারিশ নিয়ে পরের বছর ২০১৩ সালে এ পরীক্ষা থেকে যোগদান করেন ৫২ জন প্রকৌশলী।

অভিযোগ ওঠে, সব নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে প্যানেলের মেয়াদ শেষ হওয়ার সাড়ে তিন বছর পর, অর্থাৎ ২০১৬ সালের ৮ আগস্ট ও ২৭ ডিসেম্বর প্যানেল থেকে আরও ৩১ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। যেখানে নিয়ম রয়েছে পিএসসির সুপারিশের।যার মেয়াদ হবে মাত্র এক বছর। বড় ধরনের এই অনিয়মে পিএসসি এবং এলজিইডি সিন্ডিকেটের যোগসাজশের বিষয়টি এখন ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। তবে আওয়ামী সরকারের সময় যেসব দোসররা এলজিইডি জিম্মি করে রেখেছিল, তারাও এখনো এলজিইডিতে বহাল আছে।

সম্প্রতি রূপালী বাংলাদেশের এক অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৬ সালের একটি বিজ্ঞপ্তিতে ২০১৩ ও ২০১৬ সালের নিয়োগপ্রাপ্তরাও সিনিয়রিটির দাবি জানান ২০০৬ সাল থেকেই। কিন্তু পিএসসির সুপারিশের তারিখ ও নিয়োগের তারিখ ঠিক রেখে দাবি আদায়ে করা হয় একের পর এক মামলা। ফলে নানা জটিলতায় দীর্ঘদিন ধরেই আটকে আছে এলজিইডির প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের পদোন্নতি। একইভাবে তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে প্রকল্পে নিয়োগপ্রাপ্তদের উচ্চ আদালতের নির্দেশে নিয়মিতকরণ হওয়া সত্ত্বেও পদোন্নতি বঞ্চিত করে আওয়ামী লীগ সরকার।

এলজিইডি সূত্রে জানা যায়, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সিনিয়র প্রকৌশলীদের যথা সময়ে পদোন্নতি প্রদান না করায় তাদের মধ্যে মারাত্মক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়, যার বিস্ফোরণ ঘটতে পারে যেকোনো সময়। এতে প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এলজিইডি ও আদালত সূত্র জানায়, তথ্যমতে, ২০১৫ সালে জ্যেষ্ঠতার তালিকা অনুযায়ী ও বিগত ২০১৮ সালের জুন মাসে ৯৮ জন সহকারী প্রকৌশলীকে সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী ও উপজেলা প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতিকে অবৈধ্য দাবি করে ২০১৩ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রকৌশলীদের মধ্য থেকে ৩৪ জন ২০১৯ সালের মার্চ মাসে প্রশাসনিক ট্রাইবুনালে একটি মামলা করে।

ওই মামলা চলাকালীন ২০১৯ সালের জুন মাসে আরও ৮৫ জনকে সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী ও উপজেলা প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হলে ৩৪ জনের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত তার কার্যক্রম সাময়ীকভাবে স্থগীত করে। পরবর্তীতে ২০২২ সালের অক্টোবরে ওই মামলার বাদীদের বিপক্ষে রায় অর্থাৎ খারিজ হলে ৮৫ জনের পদোন্নতি কার্যকর হয়। তারপরে ২০১৫ সালের জ্যেষ্ঠতা মেনে ২০২২-এর অক্টোবরে ও ২০১৩ সালে নিয়োগপ্রাপ্তদেরসহ ৭৯ জনকে ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি গ্রহণ করা হয়।

তারা পদোন্নতি পেয়েই হেরে যাওয়া মামলায় প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করে। বর্তমানে আপিল চলমান রয়েছে। এরপর থেকেই ২০১৩ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রকৌশলীরা একের পর এক আরও মামলা করে এলজিইডিকে প্রায় অচল করে ফেলে, যে কারণে আটকে আছে অনেকের পদোন্নতি।

জানা যায়, ২০২৪ সালে এলজিইডির প্রথম শ্রেণির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের একটি তালিকা প্রণয়ন করে স্থানীয় সরকার বিভাগের ওয়েবসাইটে মতামতের জন্য প্রকাশ করা হয়, মামলার কারণে তা আজও পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি। পরবর্তীতে নির্বাহী প্রকৌশলী (পুর) শূন্য পদ পূরণের লক্ষ্যে প্রধান প্রকৌশলীর কাছে ৪৬.০২.০০০০.০০১.১২.০০৩.২১.১০৮৯৮,১০৮৯৯,১০৮৯৮,১০৯০০; স্মারক নম্বর পড়ে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে। 

একটি পত্রের মাধ্যমে ১০১টি পদে নির্বাহী প্রকৌশলী (পুর) পদে চলতি দায়িত্ব প্রদানের বিষয়ে আইনগত কোনো বাধা আছে কি না, তা জানতে এলজিইডি সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের নিকট মতামত চাওয়া হয়। এতে এলজিইডির তিনজন বিজ্ঞ আইনজীবী বিভিন্ন মামলার সাম্প্রতিক অবস্থা ও ২০২৩ সালের এপ্রিলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ২০১০ ও ২০১১ সালে নিয়োগকৃত ১০১ জন সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলীও উপজেলা প্রকৌশলীকে নির্বাহী প্রকৌশলী (পুর) পদে চলতি দায়িত্ব প্রদানে আইনগত কোনো বাধা নেই বলে মতামত আছে।  ২০১৫ থেকে ২০২৪ সালের জ্যেষ্ঠতার তালিকায় সিনিয়র এবং রাজস্ব খাতে চাকরি ১৫ বছর হলেও এলজিইডির ২০১০ সালের নিয়মিতকৃত কমকর্তাদের গত চার বছর যাবৎ কোনো পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। যার ফলে বৈষম্যের শিকার প্রকৌশলী মানসিকভাবে বিপর্যন্ত হয়ে পড়েছেন।

স্থানীয় সরকার বিভাগের তথ্য অনুয়ারী ২০২৪ সালের অক্টোবরে একটি স্মারক নং পড়ে (৪৬,০৬৭,০০৭,০০,০০,০৬০,২০১৫-৭৯)। সেই স্মারক মোতাবেক স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের ১ম শ্রেণির প্রকোশলীদের জ্যেষ্ঠ তালিকা ২০০৮ থেকে ২০১৫ উভয়ই খসড়া জ্যেষ্ঠতা তালিকা করিলেও ২০০৮ সালের জ্যেষ্ঠতা তালিকা অনুসরণ করে পদোন্নতি দেওয়া হয়। কিন্তু ইতিপূর্বে দুজন (২০১৫ অনুযায়ী জ্যেষ্ঠতাক্রম ৭৬ ও ৭৭) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও ১ জনকে (২০১৫ অনুযায়ী জেষ্ঠতাক্রম ৭৮) প্রধান প্রকৌশলীসহ সকলের পদোন্নতি প্রদান করা হয়। এক কথা এলজিইডি এতো সংকটে পড়ার কারণ হলো দোসররা এখনো বহাল।

এসব বিষয়ে পদোন্নতিবঞ্চিত বেশ কয়েকজন প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক প্রকৌশলীরা রূপালী বাংলাদেশকে জানিয়েছেন, ‘দীর্ঘদিন থেকে পদোন্নতিবঞ্চিত হওয়ায় তাদের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে এবং দ্রুত পদোন্নতি না দিলে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে এবং এলজিইডিতে আরো বিশৃঙ্খলা হতে পারে। তবে এ ব্যাপারে প্রকৌশলীদের দাবি, এই সংকট সমাধানের জন্য এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ একান্তই কাম্য। সেই সাথে বর্তমানে এলজিইডিতে দেড়শ জন নির্বাহী প্রকৌশলীর পদ শূন্য রয়েছে সেগুলো সমাধান হওয়া জরুরি এবং এলজিইডি বৈষম্যমুক্ত হোক। সেই সাথে এলজিইডি নিয়ন্ত্রণ করছে সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলামের দালাল প্রকৌশলীরা। অবিলম্ববে তাদের বিরুদ্ধে আইনি  ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। এসব সংকট সমাধান হলেও এলজিইডির ব্যাপক বিশৃঙ্খলা নিয়স্ত্রণে আসবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) প্রধান প্রকৌশলী (শেষ কর্মদিবস) গোপাল কৃষ্ণ দেবনাথ জানান, আমি যতদিন দায়িত্বরত অবস্থায় এলজিইডিকে সকল ধরনের বৈষম্যমুক্ত রাখতে কাজ করছি। নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক এলজিইডির এক কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে জানান, এলজিইডিতে বিশৃঙ্খলার পিছনে ফ্যাসিস্টের নিয়োগকৃত ১৮ জন প্রকৌশলী থেকে গেছে।  সবাই তাদের চেনেন এবং জানেন। তারা এখনো বহাল রয়েছে কীভাবে সেটা আমাদের বোধগাম্য নয়।

আরবি/জেডআর

Link copied!