রাজধানীর কারওয়ান বাজারের রেলওয়ে এলাকায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ছিনতাইকারী ও মাদক ব্যবসায়ীরা। ৫ আগস্টের পর সেখানে নতুন নতুন মাদক কারবারি এসেছে। পথচারীদের অভিযোগ, ছিনতাইকারী ও মাদকের অভয়ারণ্য হওয়ায় এসব এলাকা দিয়ে অনেকেই চলতে আতঙ্কে থাকেন।
সম্প্রতি টানা তিন-চার দিন কারওয়ান বাজারের রেলওয়ে এলাকায় সরেজমিনে গেলে এসব দৃশ্য ছিল চোখে পড়ার মতো। যার কারণে স্থানীয়রা আতঙ্কে রয়েছেন। অবশ্য এসব বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, কারওয়ান বাজারের রেলওয়ে এলাকায় থানা পুলিশ মাদকের রেড জোন হিসেবে জানে। সম্প্রতি মাদকের কারবার আরও বেড়েছে।
এদিকে অপরাধ বিশ্লেষকেরা বলছেন, মাদক ও ইয়াবার হটস্পট হিসেবে পরিচিত রাজধানীর কারওয়ান বাজারের রেলওয়ে এলাকা। এখানে প্রতিনিয়তই ছিনতাই হয় ও ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়।
যদিও বর্তমান সময়ে পুুলিশের দুর্বলতার কারণে সেখানে তেমন কোনো অভিযান পরিচালনা করতে পারেনি। পুলিশ যদি মাদক নিয়ন্ত্রণে শক্ত অবস্থানে না থাকে তাহলে এই এলাকায় মাদকের ভয়াবহতা আরও বাড়তে থাকবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
কারওয়ান বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, চলছে রমরমা মাদক ব্যবসা। রাস্তার মাঝেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এসব মাদক কেনা-বেচা হচ্ছে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, বছরের পর বছর মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসংখ্য অভিযান সত্ত্বেও ঢাকা মহানগরীর কারওয়ান বাজার রেলওয়ে এলাকা অবৈধ মাদক বিক্রির প্রধান হটস্পট হিসেবেই রয়ে গেছে। এখানে ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধের ঘটনাও অহরহ ঘটছে।
সরেজমিনে জানা যায়, রেললাইনের ধারে, বিশেষ করে পাইকারি মাছের বাজার এলাকায় যুবক, কিশোর, নারী মাদক ব্যবসায়ীরা গোপনে দীর্ঘদিন ধরে মাদক বিক্রি করে আসছে। ঘটনাস্থলে কথা হয় মাদক কারবারি ইমনের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ৫ আগস্টের আগে জেলে ছিলাম। জেল থেকে বের হয়েই টুকিটাকি কাজ করে খাচ্ছি। পরিচিত কিছু কাস্টমার আছে, তারা ফোনে যোগাযোগ করে আসে এবং ‘জিনিস’ নিয়ে যায়। এদিকে রাস্তায় ছোট ছোট করে ডাক ছেড়ে মাদক বিক্রি করছেন কালা শিমুল।
তিনি বলেন, কিছু তো একটা করে খেতে হবে। এটাই আমার ব্যবসা। মাদক কারবারি কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, নানা কৌশলে তাদের কাজ করতে হয়। তা ছাড়া এখানে যারা আসেন সবাই মাল (মাদক) নিতে আসেন।
জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) শিথিল থাকায় এই এলাকাটিতে প্রকাশ্যে ও অবাধে চলছে অবৈধ মাদকের রমরমা ব্যবসা। এখানে শুধু মাদকের ব্যবসা নয়, চলাচলরত সাধারণ অনেক মানুষ ছিনতাইয়ের কবলেও পড়ছেন।
গত সোমবার কারওয়ান বাজার রেললাইনের উপরে কথা হয় তারিকের সঙ্গে। তিনি বলেন, পহেলা জানুয়ারি এখান থেকে রাত ৮টার দিকে আমাকে ছুরি ধরে সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে যায় অপরাধীরা। পরে এ বিষয়টি থানা পুলিশের কাছে জানালেও কোনো প্রতিকার পায়নি। একই স্থানে কথা হয় পথচারী আয়নালের সঙ্গে।
তিনি বলেন, গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর এই লাইন ধরে বাসায় যাওয়ার পথে ছিনতাইকারীরা আমার মানিব্যাগ, মোবাইল ও নগদ টাকা নিয়ে যায়। তিনি বলেন, আপনারা দেখতে পারছেন এখানে মাদক ব্যবসায়ীদের ওপেন ব্যবসা চলছে। কেউ ভয়ে কথা বলতে পারে না। পুলিশও আর আগের মতো তেমন কিছু বলেও না। যার কারণে ছিনতাই চক্র ও মাদক চক্রের আখড়া হয়ে উঠেছে কারওয়ান বাজারের রেললাইন।
একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, কারওয়ান বাজার রেললাইন এলাকায় নিয়মিত ছিনতাই ও মাদকের হাট বসছে। যে কারণে বিভিন্ন অপরাধ ঘটেই চলছে। তাদের দাবি, ছিনতাই চক্র ও মাদক চক্রের আখড়া এটি।
সরেজমিনে দেখা যায়, মাদক কারবারিরা মাদক বিক্রির জন্য ক্রেতার জন্য অপেক্ষা করছে, আর ক্রেতারাও প্রকাশ্যে তাদের কাছ থেকে কিনছেন মাদক। দেখে মনে হচ্ছে, এ যেন মাদকের হাট-বাজার। এ ছাড়া তেজগাঁও রেলক্রসিং পর্যন্ত রেললাইনের বিভিন্ন অংশ একাধিক অপরাধী চক্র নিয়ন্ত্রণ করছে।
এমন অভিযোগও রয়েছে যে, এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে কয়েকটি স্থানীয় ডিএনসি কর্মকর্তাসহ কিছু আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের সুরক্ষা বা মৌন সম্মতি পান, যা এই অবৈধ ব্যবসাকে বন্ধ করার প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করে তুলেছে। সমস্যাটি নিয়ন্ত্রণে বড় আকারের অভিযানসহ নানা প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এলাকায় মাদক ব্যবসা অব্যাহত আছে।
তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের মে মাসে কারওয়ান বাজারের এই এলাকায় মাদক ব্যবসা গুঁড়িয়ে দিতে প্রায় এক হাজার সদস্যের একটি বড় দল নিয়ে অভিযান চালায় পুলিশ। তবে গোপনীয়তার অভাবের জন্য এই অভিযানটি ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছিল।
যে কারণ কর্তৃপক্ষ প্রকাশ্যে আগাম অভিযানের ঘোষণা দেওয়ায় মাদক ব্যবসায়ীদের পালানোর জন্য পর্যাপ্ত সময় পেয়েছিল। যদিও ৪৭ জনকে আটক করা হলেও এর মধ্যে অনেকে দিনমজুর বা রাস্তার বিক্রেতা বলে জানা গেছে।
যাদের মাদক ব্যবসার সঙ্গে কোনো স্পষ্ট সংযোগ নেই। এতে করে নিরপরাধ ব্যক্তিদের অকারণে ক্ষতিগ্রস্ত করার বিষয়টি সামনে আসে। এর পরে ২০২৪ সালের শুরুর দিকে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) আরেকটি অভিযান চালালেও তাতেও সীমিত ফল পাওয়া যায়।
আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তারা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ইয়াবা এবং গাঁজা জব্দ করে। তবে সমালোচকদের দাবি, এই অভিযানগুলোতে মাদক ব্যবসায়ীদের নেটওয়ার্কগুলো ভেঙে ফেলার জন্য ধারাবাহিক পদক্ষেপ বা দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের ঘাটতি রয়েছে। মাঝে মধ্যে শীর্ষ মাদক কারবারিদের গ্রেপ্তার এবং মাদক জব্দ হওয়া সত্ত্বেও এই অঞ্চলে মাদক ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠছে।
চলমান মাদক ব্যবসার সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এলাকার বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা। প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি এই অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাহীনতা বাড়াচ্ছে। ফলে কিছু ব্যবসা তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে যায় বা স্থানান্তরিত হয়।
আশপাশের বাবা-মায়েরাও শিশু ও তরুণদের ওপর প্রভাব সম্পর্কে উদ্বিগ্ন, যারা প্রায়ই এই ব্যবসার সংস্পর্শে আসে। কারওয়ান বাজার এলাকার ব্যবসায়ী আমান মিয়া জানান, অবৈধ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে অবৈধ বাণিজ্য অব্যাহত আছে।
রহিম মিয়া নামের আরেক ব্যবসায়ী জানান, অবৈধ মাদক ব্যবসা বন্ধে এবং কারওয়ান বাজার রেলওয়ে এলাকায় শৃঙ্খলা ফেরাতে বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যে আরও ভালো সমন্বয়, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং কমিউনিটির সম্পৃক্ততাসহ ব্যাপক সংস্কার আবশ্যক।
জানা যায়, ঝর্ণা নমের এক মাদক ব্যবসায়ী কারওয়ান বাজারের রেললাইনে নানা ধরনের অপরাধ করছে। তাকে সবাই ‘তামাক ঝর্ণা বলে চেনেন। তাকে পুলিশ খুঁজছে বলে থানা পুলিশের সূত্রে এসব জানা গেছে।
মাদক ব্যবসা কেমন চলছে পুলিশ ধরে না এমন প্রশ্নের জবাবে মাদক ব্যবসায়ী ঝর্ণা বলেন, আমি ওতটা বিক্রি করি না, আমার লোকজন আছে ওরা কর্ম করে খায়। তবে মাঝে মাঝে র্যাব, পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের লোকজন নিয়মিত অভিযান করে কিন্তু আমরা আগে থেকেই জানি এবং স্পটে আসি না।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) মহাপরিচালক খন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মাদক ব্যবসা রোধে ডিএনসির অপারেশনাল টিম ওই এলাকায় ধারাবাহিকভাবে অভিযান চালায়। শুধু অভিযান চালিয়ে অবৈধ মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, বরং চাহিদা কমানো প্রয়োজন।
চাহিদা বাড়লে সরবরাহ বাড়বে এজন্য আমরা কিছু কৌশল নিয়ে কাজ করছি। তিনি বলেন, আমরা মাদকের চাহিদা কমাতে সারা দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা মোটিভেশনাল ক্যাম্পেইন পরিচালনার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে তেজগাঁও থানার ওসি মোবারক হোসেন বলেন, সম্প্রতি এই জায়গা থেকে ৫০-৬০ জন মাদক ব্যবসায়ী ও ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত থাকার অভিযোগে আটক করা হয়। এ ছাড়া গোয়েন্দা পুলিশ নিয়মিত নজরদারি করছে।
তিনি বলেন, আমরা পরিকল্পনা নিয়েছি, মাদকের অবৈধ ব্যবসা রোধে বড় ধরনের অভিযান চালানোর পাশাপাশি সার্বক্ষণিক ভ্রাম্যমাণ দল প্রস্তুত রাখা, যাতে কারওয়ান বাজার এলাকায় অভিযান চালানো যায়।
এ বিষয়ে র্যাব-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি খলিদুল হক হাওলাদার বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য সবার আগে সমাজের সবাইকে সচেতন হতে হবে।
অভিভাবকদের পারিবারিক পর্যায়ে তাদের সন্তানদের সম্পর্কে সচেতন হতে হবে, যাতে তারা (শিশুরা) মাদকাসক্তিতে জড়িয়ে না পড়ে। তা ছাড়া কারওয়ান বাজারে মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে। আমরা সব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সতর্ক আছি।
আপনার মতামত লিখুন :