অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদের ছয় মাসের মাথায় ফেরুয়ারিতে রাজপথে নামছে দেশের সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা দল বিএনপি। জনসম্পৃক্ত কর্মসূচির আদলে তাদের মূল দাবি থাকবে দ্রুত নির্বাচন।
দুই ধাপের এই কর্মসূচির মধ্যে রমজানকে সামনে রেখে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে প্রথমে হবে বিক্ষোভ সভা-সমাবেশ। পরে দেশে গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে দ্রুততম সময়ে সুষ্ঠু সংসদ নির্বাচনের দাবিতে হবে দ্বিতীয় কর্মসূচি।
এদিকে গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতা হারানোর ছয় মাসের মাথায় অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে বড় ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের ‘অপশাসন-নির্যাতনের প্রতিবাদে তাদের পদত্যাগের দাবিতে আগামী ১৬ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি হরতাল-অবরোধের ডাক দিয়েছে দলটি। গত মঙ্গলবার রাতে দলটির ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ থেকে এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
যাতে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের পদত্যাগের দাবিতে এবং হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি বাস্তবায়নে পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকেই মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছে দলটি। যদিও অস্তিত্ব সংকটে থাকা দলটির কর্মীরা এখনো আত্মগোপন থেকে ফিরতে পারেনি। ৫ আগস্টের পর মামলা-হামলার ভয়ে ঘরছাড়া কর্মীরা সবাই এলাকাছাড়া।
হাতেগোনা কয়েকজন ফিরেছেন, তারাও প্রকাশ্যে আসতে চাচ্ছেন না। এ অবস্থায় দলটি কীভাবে হরতাল-অবরোধের মতো রাজপথের কর্মসূচি পালন করবে এবং সেক্ষেত্রে তারা কতটুকু সফল হবে- সেটি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এদিকে আওয়ামী লীগ হরতাল-অবরোধ পালনের চেষ্টা করলে সেটি প্রতিহত করা হবে বলে জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। তবে রাতের আঁধারে দু-এক জেলায় পোস্টার লাগালেও এখনই হরতাল-অবরোধ করার সক্ষমতা তাদের রয়েছে কি নাÑ তা নিয়ে সন্দিহান অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারা।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ তকমা পাওয়া ১৪ দল শরিকরাও রয়েছে অস্তিত্ব সংকটে। বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও অনেকেই সাড়া দেননি।
তবে দুই-একজন নেতা জানান, কর্মসূচি সমর্থন কিংবা প্রত্যাখ্যান কোনোটা নিয়েই ভাবছেন না তারা। দেশজুড়ে হরতাল-অবরোধসহ আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ঘোষণা বিষয়ে অনেকটাই ধোঁয়াশায় ১৪ দলের শরিকরা। তারা বলছে, জোটের কোনো দলের সঙ্গে আলোচনা করে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়নি। এটা আওয়ামী লীগের একার কর্মসূচি।
গত সোমবার বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ফেব্রুয়ারিতে রাজপথে আন্দোলনে নামার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে বিএনপি সূত্রে জানা গেছে। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচনের জন্য বিএনপি যে দাবি জানিয়ে আসছে, সে লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে রাখতে দ্বিতীয় কর্মসূচি পালন করবে বলেও জানিয়েছে বিএনপির একটি সূত্র।
দুই ইস্যুতে রমজানের আগেই ঢাকাসহ সারা দেশে সমাবেশ করবে বিএনপি। দিনক্ষণ চূড়ান্ত না হলেও দ্রুত সময়ে বিভাগীয় সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠক করে তারিখ চূড়ান্ত করা হবে বলে জানা গেছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আওয়ামী লীগ হরতালের ডাক দিল আর মানুষ লাফ দিয়ে পড়বে- বিষয়টি এমন নয়। বরং মানুষ তাদের শাস্তির জন্য অপেক্ষা করছে। অনির্বাচিত সরকার যত বিলম্ব করবে নির্বাচন দিতে ততই সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে পতিত স্বৈরাচার এবং তাদের দোসররা। বিএনপি আওয়ামী লীগের হরতাল-অবরোধ প্রতিরোধ করবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে রিজভী বলেন, বিএনপির প্রতিরোধ করার প্রয়োজন হবে না। দেশের জনগণ প্রতিরোধ করবে ফ্যাসিবাদ এবং তাদের দোসরদের।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বছরের মাঝখানে ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়িয়ে সরকার মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে দিচ্ছে তার প্রতিবাদ করতেই আমাদের কর্মসূচি আসছে। আর নির্বাচন তো মানুষের দাবি, মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনার আন্দোলন আমরা করে আসছি গত ১৬ বছর ধরেই।
এ ছাড়া দুস্থদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে বিএনপি, আর আন্দোলনে আহতদের পুনর্বাসন এবং মহানগর থেকে ওয়ার্ড পর্যায়ে রাষ্ট্র মেরামতে ৩১ দফা কর্মসূচি পালন করে চলছে দলটি।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরামের নেতা মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, গত ১৬ বছর গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকার পতনের জন্য আন্দোলন করেছি আমরা। ছাত্রদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকারের পতন হয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্র এখনো ফিরে পায়নি জনগণ।
আমরা মনে করি, অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করতে পারলে এই সরকার কেন আগামী ৬ মাসের মধ্যে পারবে না? সরকারের ইচ্ছা থাকলে জুলাই-আগস্টের মধ্যে নির্বাচন দেওয়া সম্ভব। আমরা নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করব। অত্যন্ত দক্ষ এই সরকার, আশা করি, তারা জনগণের আকাক্সক্ষা বুঝতে সক্ষম হবে এবং দ্রুত নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্রের পথ প্রশস্ত করবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, গত কয়েক মাস ধরে ন্যূনতম সংস্কার করে একটি যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচনমুখি প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে বিএনপি।
দলটি মনে করে, চলতি বছরের জুলাই-আগস্টের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব এবং এ বিষয়ে তাদের অবস্থানও ইতিমধ্যে তুলে ধরেছে। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে যেকোনো সময় সংসদ নির্বাচন হতে পারে। তবে বিএনপি ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত সময়কে নির্বাচনের জন্য ‘খুবই অতিরিক্ত সময়’ বলে মনে করছে।
বিএনপি নেতারা বলেন, ন্যূনতম সংস্কার করে একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য জুলাই-আগস্টেই সম্ভব। অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ৯০ দিনে করতে পারলে অন্তর্বর্তী সরকার কেন পারবে না? সংস্কারের পর নির্বাচন নিয়ে যারা নানারকম ব্যাখ্যা দিচ্ছে তা শুধু নির্বাচন পেছানোর পাঁয়তারা বলে মনে করেন বিএনপি নেতারা। যা জনগণ মেনে নেবে না, বিএনপিও তা মেনে নেবে না বলে জানান দলটির নেতারা।
আপনার মতামত লিখুন :