ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) নানা সমস্যায় জর্জরিত। সমস্যা সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সংগঠনগুলো কাজ করার কথা থাকলেও রাজনৈতিক দলের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে দেখা গেছে তাদের। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর বদলে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র।
সম্প্রতি ঘোষণা করা হয়েছে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত ঢাবি শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের নতুন কমিটি। কমিটির আহ্বায়ক হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান।
তিনি জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির কেন্দ্রীয় গণশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ও মিডিয়া সেলের সদস্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়, একাডেমিক মানোন্নয়নসহ নানা বিষয় নিয়ে রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি এম এইচ সিনদিদ
রূপালী বাংলাদেশ: কেমন আছেন? সম্প্রতি আপনি বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত ঢাবি শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের আহ্বায়ক হয়েছেন। আপনার অনুভূতি কেমন?
অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান: ভালো আছি। ফ্যাসিস্টমুক্ত দেশে নির্ভয়ে শিক্ষকের পবিত্র দায়িত্ব পালন করতে পারছি। এই অনুভূতি অতুলনীয়। আমার সশ্রদ্ধ সালাম সব ছাত্রজনতাকে যারা জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন। সন্তানতুল্য ছাত্র-ছাত্রীরা অসাধ্য সাধন করেছে।
সংগ্রামে নিহতরা আমাদের স্মৃতিতে অম্লান থাকবে। আহতদের চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনে আমরা সচেষ্ট থাকব। এই পদে আমার পরিচিতি হবে রাজনৈতিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়নে সচেষ্ট শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে, যেখানে বৈষম্যের কোনো স্থান হবে না।
ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মীয় মূল্যবোধে অনুপ্রাণিত হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাদা দলের আহ্বায়ক হিসেবে আমি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষায় সব বিভেদ এবং বিদ্বেষ ভুলে কাজ করব।
রূপালী বাংলাদেশ: যতটুকু জানি, শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কলাম লেখার কারণে আপনাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। ৫ আগস্টের পর আপনি আবার চাকরি ফিরে পেয়েছেন। এ বিষয়ে কিছু বলুন।
অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান: আমর ওপর যে অন্যায় হয়েছে তা মতপ্রকাশে বাধা প্রদান এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দলীয় লেজুড়বৃত্তির অন্যতম উদাহরণ। দীর্ঘ তিন বছরের আইনি লড়াই শেষে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট সরকার পতন এবং সরকারপ্রধানের পলায়নের পর আমি আবার আমার প্রাণের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ফিরে পাই।
এখানে একটু সংশোধন করে দেই যে, আমার লেখা কলামটি ছিল শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে নিয়ে। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের অবমাননা এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়েছিল।
রূপালী বাংলাদেশ: জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আধুনিক ও মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে আপনাদের ভূমিকা কি হবে?
অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান: এক সময়ের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সরকার, শিক্ষক, প্রশাসন, ছাত্র সবারই সহায়তা এবং আন্তরিকতা প্রয়োজন।
আমরা শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে উপাচার্য (ভিসি) এবং ডিন নির্বাচনে যোগ্যতাকে একমাত্র মানদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করব। সিনেট এবং সিন্ডিকেট নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে আনব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যের কোনো স্থান হবে না।
রূপালী বাংলাদেশ: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি দীর্ঘ সময়ের প্রত্যাশা একটি স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো- এটিকে আপনারা কীভাবে দেখেন?
অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান: এই দাবি যৌক্তিক এবং আমাদের সমর্থন আছে। এর সঙ্গে বলতে হয় স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত এবং বাস্তবায়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মন্ত্রণালয় এবং সরকারের বিভিন্ন বিভাগের সমন্বয় প্রয়োজন।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, মন্ত্রণালয়, বর্তমানের অন্তর্বর্তী সরকার এবং পরবর্তীতে নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে এই দাবি আদায়ে জন্য আমরা কাজ করব।
রূপালী বাংলাদেশ: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণার পরিবেশ ও উচ্চতর গবেষণার ফান্ডিং নিয়ে অনেকের মধ্যে ক্ষোভ এবং হতাশা রয়েছে। এ বিষয়ে আপনারা কি মনে করেন।
অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান: গবেষণায় আমাদের বরাদ্দ অপ্রতুল, এটা আমাদের স্বীকার করতে হবে। গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধির চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে মৌলিক এবং যোগ্য গবেষণাগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া দরকার।
আমরা বেসরকারি উৎস থেকে গবেষণায় বরাদ্দ আনতে চেষ্টা করব। আমাদের শিক্ষকদের দেশে এবং বিদেশে বিস্তৃত যোগাযোগ রয়েছে। শুধু অভ্যন্তরীণ উৎসের ওপর নির্ভরশীল না থেকে আমরা সম্ভাব্য সব উৎস থেকে বরাদ্দ আনতে চেষ্টা করব।
রূপালী বাংলাদেশ: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আবাসন সমস্যা দূরীকরণে ভবিষ্যৎ করণীয় কি হতে পারে? শিক্ষকদের বিভিন্ন যৌক্তিক দাবিতে আপনার ভূমিকা কি হবে?
অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান: এই সমস্যা প্রকট এবং সমাধনে দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ প্রয়োজন। আমরা যদি এখন কিছু সঠিক উদ্যোগ নিতে পরি, ভবিষ্যতে এর সুফল পাওয়া যাবে। এর সঙ্গে আমাদের কাছে যে আবাসন রয়েছে তার সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
রূপালী বাংলাদেশ: শিক্ষার্থী-শিক্ষক পারস্পরিক সম্পর্কোন্নয়ন ও আস্থা বিনির্মাণে কি ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন?
অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান: শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উভয়কেই তাদের ভূমিকা এবং একে অপরের কাছে প্রত্যাশার ব্যাপারে সচেতন এবং শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। একটা বড় সময় ধরে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের অভিভাবক রূপে দেখতে পায়নি, বিশেষ করে আবাসিক হলে ছাত্রলীগের নির্যাতনের বিরুদ্ধে খুব কম শিক্ষক বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পেরেছিলেন। শিক্ষকদের তাদের সম্মান অর্জন করতে হবে।
রূপালী বাংলাদেশ: অতীতে আমরা দেখেছি, নীল দল মানেই আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের অনেক বিতর্কিত কাজেও তারা সমর্থন দিয়েছে। সাদা দলের ক্ষেত্রেও কি এ ধরনের ঘটনা ঘটবে?
অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান: আমি বলেছি, রাজনৈতিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়নে শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে সচেষ্ট থাকব এবং বৈষম্যের কোনো স্থান দিব না। জুলাই-’২৪ পরবর্তী বাংলাদেশে দলীয় সংকীর্ণতার কোনো স্থান নেই।
রূপালী বাংলাদেশ: বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা সাদা বা নীল দল করেন তারা রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও অনেকে ক্লাসে নিয়মিত নন। তাদের ব্যাপারে কি বলবেন। আপনিও বিষয়টি সমর্থন করেন কি না।
অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান: আমি একদমই সমর্থন করি না। আমি আগেই বলেছি, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উভয়কেই তাদের ভূমিকা এবং একে অপরের কাছে প্রত্যাশার ব্যাপারে সচেতন এবং শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সরকার, শিক্ষক, প্রশাসন, ছাত্র সবারই সহায়তা এবং আন্তরিকতা প্রয়োজন।
রূপালী বাংলাদেশ: জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর শিক্ষার্থীদের চাপে যেসব শিক্ষক একাডেমিক কাজে অংশ নিতে পারেনি তাদের একাডেমিক কাজে ফেরানোর ক্ষেত্রে সাদা দলের কোনো ভাবনা আছে কি না?
অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান: এ বিষয়ে আমরা ছাত্রদের অনুভূতিকে সম্মান দেখিয়ে তাদের মতামত জানতে চাইব এবং তাদের বোঝাতে চাইব। এ বিষয়ে তাদের ওপর আমরা জোর করে কিছু চাপিয়ে দিব না। শিক্ষকতা সম্মানের জায়গা। কৃতকর্মের জন্য যারা এ সম্মান হারিয়েছেন, তাদের নিজেদেরও মূল্যায়ন এবং বিবেচনা করা প্রয়োজন।
রূপালী বাংলাদেশ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষ অতিক্রম করলেও এখনো আবাসিক সংকট রয়েছে। সাদা দল এক্ষেত্রে কোনো অবদান রাখতে পারে কি না।
অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান: অবশ্যই পারে এবং করব। আমাদের শিক্ষকরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে। মন্ত্রণালয় এবং সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগের মাধ্যমে এর সমাধান সম্ভব। উপরন্তু আমরা এখনকার আবাসিক হলগুলোর সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করব।
রূপালী বাংলাদেশ: অধিকাংশ সময় শিক্ষক নিয়োগে মেধার চেয়ে রাজনৈতিক মতাদর্শকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে আপনাদের ভূমিকা কী হবে?
অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান: দেশের জনগণ মেধার পক্ষে রায় দিয়েছে এবং অধিকার আদায় করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আন্দোলনের সূতিকাগার। আমরা বিপ্লবের আদর্শ ধারণ করি।
রূপালী বাংলাদেশ: সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাদা দল দুইভাবে বিভক্ত হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে ওই পক্ষ আপনাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলেছেন। এসব কারণে সাদা দল সাধারণ শিক্ষক সমাজে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে এমন মন্তব্যও করেছেন। এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?
অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান: আমরা সব সমালোচনাকে স্বাগত জানাই। বর্তমান নতুন কমিটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত। এরপরও কারো অভিযোগ থাকলে আমরা তাদের ওপর শ্রদ্ধাশীল। আমরা আশা করি, কমিটি তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে সবার আস্থা অর্জনে সফল হবে।
রূপালী বাংলাদেশ: ঢাবি ক্যাম্পাসের শৃঙ্খলা ফেরাতে ডাকসু নির্বাচন কতটা জরুরি? ডাকসু নির্বাচন যেন দ্রুত হয় এ ক্ষেত্রে আপনারা কোনো পদক্ষেপ নেবেন কি না?
অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের গণতন্ত্র চর্চার পীঠস্থান। এখানে নিয়মিত ডাকসু নির্বাচন না হওয়া রীতিমতো লজ্জার। জুলাই পরবর্তী প্রেক্ষাপটে আমারা বেশকিছু সংস্কার আনার চেষ্টা করছি যাতে গণতন্ত্র টেকসই হয়। যদি সব স্টেকহোল্ডার এখনই ডাকসু নির্বাচনে সমর্থন জানায় তাহলে আমরা তা স্বাগত জানাব।
আপনার মতামত লিখুন :