ঢাকা সোমবার, ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

তিতুমীর কলেজ নিয়ে বেকায়দায় সরকার

মেহেদী হাসান খাজা
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২, ২০২৫, ১২:১১ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে গতকাল শনিবার টানা চতুর্থ দিনের মতো আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করেছেন সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। অনশনে বসা অন্তত ১৫ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী ইতিমধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তবুও দাবি আদায়ে অনড় শিক্ষার্থীরা।

এর আগে গতকাল বিকেল ৪টার মধ্যে তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয় গঠনসহ সাত দফা দাবি পূরণ না হলে অনির্দিষ্টকালের জন্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন আওতাধীন এলাকায় ‘ব্যারিকেড’ কর্মসূচি পালন করার কর্মসূচি ঘোষণা করেন শিক্ষার্থীরা। তবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এই পথে চলাচলে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। এই এলাকায় জ্যামে প্রায় ঘণ্টাখানেক আটকে থাকা ডা. আলমগীর অভিযোগ করে বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সব সেক্টরের দাবি দাওয়া উথলে পড়ছে। বর্তমান দেশের এই ক্লান্তিকালে তিতুমীর কলেজ নিয়ে বেকায়দায় পড়েছে সরকার।

সাধারণ মানুষের ভোগান্তির পাশাপাশি অন্যদিকে আন্দোলন নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও বেকায়দায় পড়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সময় বেঁধে দিয়ে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কোনো যৌক্তিকতা নেই।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা নেই: তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের ঘোষণা আদায়ে সময় বেঁধে দিয়ে আন্দোলন করার যৌক্তিকতা নেই বলে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গতকাল বিকেলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। কলেজ শিক্ষার্থীদের টানা অবরোধ ও অনশনের মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই বিবৃতি দেয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে চলমান আন্দোলনের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তথা সরকার অবহিত রয়েছে। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সাতটি কলেজের সমন্বয়ে একটি পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের লক্ষ্যে ইউজিসির চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে গঠিত একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি কাজ করছে। এক্ষেত্রে সরকারি তিতুমীর কলেজের বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

জানা গেছে, ইতিমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই কমিটি তিতুমীর কলেজসহ সাতটি কলেজের শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের সঙ্গে তাদের সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে। এই কলেজগুলোর শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা ও মানোন্নয়নই বর্তমান সরকারের প্রধান লক্ষ্য। এক্ষেত্রে করণীয় সব বিকল্পই সরকারের বিবেচনায় থাকবে। এ অবস্থায় তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের ঘোষণা আদায়ে সময় বেঁধে দিয়ে আন্দোলন করার যৌক্তিকতা নেই। সেজন্য আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধৈর্য্য ধারণ করার অনুরোধ করা হলো। জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি হয় বা কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয় এমন কর্মসূচি থেকে বিরত থাকার জন্য আন্দোলনকারীদের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, সর্বস্তরের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ন্যায়সঙ্গত দাবি-দাওয়ার বিষয়ে সরকার সবসময় সচেতন ও সহানুভূতিশীল রয়েছে।

শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক আন্দোলন: এর আগে গত শুক্রবার রাত ১১টায় জরুরি এক সংবাদ সম্মেলনে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা জানান, গতকাল বিকেল ৪টার মধ্যে আমাদের সাত দফা দাবি মেনে না নিলে এবং তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয়কে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না দেওয়া হলে অনির্দিষ্টকালের জন্য ‘বারাসাত ব্যারিকেড টু নর্থ সিটি’ কর্মসূচি পালন করা হবে। এই কর্মসূচির আওতায় রেল ও সড়কপথ অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

শিক্ষার্থীদের সাত দফা দাবিগুলো হলো- ১. তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয়কে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রকাশ করতে হবে

২. তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গঠন করে ২০২৪-২৫ সেশনের ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে ৩. শতভাগ শিক্ষার্থীর আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ নতুবা অনতিবিলম্বে শতভাগ শিক্ষার্থীর আবাসিক খরচ বহন করতে হবে

৪. ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ন্যূনতম দুটি বিষয় ‘আইন’ এবং ‘জার্নালিজম’ সংযোজন করতে হবে

৫. একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন পিএইচডিধারী শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে ৬. শিক্ষার গুণগতমান শতভাগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে আসন সংখ্যা সীমিত করতে হবে এবং ৭. আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগার বিনির্মাণের লক্ষ্যে জমি ও আর্থিক বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতির দাবিতে গতকাল টানা চতুর্থদিনের মতো অনশন করেছেন তিতুমীর কলেজের একদল শিক্ষার্থী।

সরেজমিনে দেখা গেছে, অনশনে রয়েছেন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। এর আগে গত বুধবার বিকেল থেকে অনশন শুরু করেন ১১ জন শিক্ষার্থী। পরে ৬ জন অসুস্থ হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ ছাড়া গণঅনশনে অংশ নিয়েছেন তিতুমীরের সাবেক ও অন্যান্য শিক্ষার্থীরা। অনেকেই দীর্ঘসময় অনশনে থেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। কলেজের মূল ফটকের সামনে স্যালাইন দেওয়া হয়েছে আন্দোলনরতদের অধিকাংশকে। শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করে গত বুধবার কলেজের দুটি ছাত্রীনিবাসের শতাধিক নারী শিক্ষার্থী মিছিল করেছেন। এ সময় তারা অনতিবিলম্বে তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দেন।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, যৌক্তিক দাবি নিয়ে দ্বিচারিতা করছে সরকার। মন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করলেও দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম নেই। অনশন কর্মসূচি থেকে গতকাল ৪টার মধ্যে স্বীকৃতি না আসলে ঢাকা উত্তর সিটি এলাকায় বারাসাত ব্যারিকেড কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা সড়ক এবং রেলপথ অবরোধ করারও হুমকি দেন।

৫ আগস্টের পর বেগবান আন্দোলন: তিতুমীর কলেজকে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন কলেজটির শিক্ষার্থীরা। তবে ৫ আগস্ট সরকারের পট পরিবর্তনের পর তাদের এই আন্দোলন আরও বেগবান হয়। এ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীরা গণস্বাক্ষর, মিছিল, স্মারকলিপি প্রদান, সড়ক-রেলপথ অবরোধ, ক্লাস বর্জনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাই করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি বিশেষ কমিটিও গঠন করা হয়। তবে এ বিষয়ে ইতিবাচক কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় গত ২৯ জানুয়ারি বিকেল থেকে আমরণ অনশনের ঘোষণা দেয় শিক্ষার্থীরা।

বাঁশের ব্যারিকেড দিয়ে সড়ক অবরোধ: বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে গতকাল ফের সড়ক অবরোধ করেন সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। গতকাল শনিবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে তারা বাঁশ দিয়ে গুলশান-মহাখালী সড়কটি অবরোধ করেন। এতে বন্ধ হয়ে যায় ওই এলাকার যান চলাচল। এ ছাড়া শিক্ষার্থীরা কলেজের ভেতরে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছেন। এদিন কলেজ ফটকে অনশনরত এক শিক্ষার্থী বলেন, আজ (গতকাল) বিকেল ৪টা পর্যন্ত আমরা সময় বেঁধে দিয়েছি, যদি আজকে (গতকাল) বিকেল ৪টার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা না করে তখন শিক্ষার্থীরা কিছু করলে সেটা তাদের বিবেচনা।

আন্দোলনে চরম ভোগান্তিতে মানুষ: দাবি আদায়ে চার দিন ধরে মহাখালী, গুলশান, বনানী ও কলেজের সামনের সড়ক অবরোধ করে গণঅনশন করছেন শিক্ষার্থীরা। এতে ওই সড়ক ও আশপাশের এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। চরম ভোগান্তিতে পড়েন এসব পথে চলাচলরত মানুষ ও যানবাহন। নিরুপায় হয়ে তাঁরা হেঁটে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হন। এ সময় অনেক সাধারণ মানুষ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।