স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া শুরু করলেও জিএসটি গুচ্ছভুক্ত ২৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা কোন পদ্ধতিতে হবে তা এখনো ঠিক করা সম্ভব হয়নি। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সাতটি গুচ্ছ থেকে বের হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যেই নিজস্ব পদ্ধতিতে শুরু করেছে ভর্তি পরীক্ষা প্রক্রিয়া। এসব বিশ্ববিদ্যালয়কে গুচ্ছে ফেরাতে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও তাদের গুচ্ছে না থাকার পক্ষে অটল অবস্থানের কারণে বিপাকে পড়তে হচ্ছে সরকারকে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজস্ব আইনে চলায় তাদের বাধ্য করাও সম্ভব হচ্ছে না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, গুচ্ছ ভেঙে গেলে পরিস্থিতি জটিল হবে। আমরা গুচ্ছে থাকতে সব বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্দেশ দিয়েছি। কিন্তু তা না মানলে কি করার আছে। তবে গুচ্ছ পদ্ধতি ভেঙে যাওয়ায় শিক্ষার্থীদেরও ভোগান্তি বাড়বে।
গুচ্ছে না থাকার পক্ষে অটল ৩ বিশ্ববিদ্যালয়, ফিরতে পারে ৪টি
চলতি শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষায় গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা বহাল রাখার জন্য ইতোমধ্যে কড়া নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে নির্দেশনায় নড়ছে না টনক। যে সাত বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ থেকে বের হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল তারা এখনো গুচ্ছে না ফেরার পক্ষে অটল রয়েছেন। তবে এই সাত বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ভর্তির জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেনি এমন দুই-একটি হয়তো গুচ্ছে ফিরতে পারে।
সূত্রমতে, গুচ্ছ থেকে বের হয়ে ইতোমধ্যেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীদের ভর্তির আবেদন নেওয়া শুরু করেছে। বাকিগুলোও ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু করার পথে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংশ্লিষ্টরা জানান, একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত মতেই গুচ্ছ থেকে বের হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আবার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভর্তির জন্য আবেদন নেওয়া হয়েছে। ফলে এই সিদ্ধান্ত থেকে বের হয়ে যাওয়া কঠিন।
গত সোমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের যুগ্মসচিব শারমিনা নাসরিন আক্তার স্বাক্ষরিত ভিসিদের দেওয়া নির্দেশনাপত্রে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় সুষ্ঠু উন্নয়ন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২০২০ সাল থেকে দেশের সরকারি সাধারণ, কৃষি, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক (সম্মান) পর্যায়ে গুচ্ছ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী ভর্তি কার্যক্রম চালু করা হয়। শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সাধারণ জনগণের মধ্যে এটি ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে এবং একটি শিক্ষার্থীবান্ধব কার্যক্রম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। তবে সম্প্রতি কিছু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পুনঃপুন অনুরোধ অগ্রাহ্য করে পৃথকভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ কারণে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জন্য বাড়তি আর্থিক ও মানসিক চাপ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, যা শৃঙ্খলার অভাবে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় গোপালগঞ্জের ভিসি অধ্যাপক ড. হোসেন উদ্দিন শেখর বলেন, সরকার চাচ্ছে আমরা গুচ্ছে থাকি আর একাডেমিক কাউন্সিল না থাকার পক্ষে। ফলে কোনপথে যাব দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেছি। কাউন্সিলের সঙ্গে আবারও আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. রেজাউল করিম বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী, অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুসারে ভর্তি কমিটির মাধ্যমে নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। আইন মোতাবেক এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক বলেন, মাত্র কয়েক বছর আগেও মানের দিক দিয়ে ঢাকার পরেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল। কিন্তু গুচ্ছে যাওয়ার পর আমাদের অবস্থান অনেক তলানিতে গেছে। তাই আমরা গুচ্ছে না থাকার পক্ষে।
ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেনিÑ এমন দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজস্ব আইনে চলে। তাই তাদের গুচ্ছে থাকার জন্য সরকার বাধ্য করতে পারে না। তবে যেহেতু সরকারি এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকারের টাকায় চলে তাই সরকারের সিদ্ধান্তও কিছুটা মেনে চলতে হয়। তাই সরকারের সিদ্ধান্ত মতে, গুচ্ছে ফেলার জন্য আমরা একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করছি। তারা ইতিবাচক মত দিলে আবারও কাউন্সিলের বৈঠক ডেকে ফেরার সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
তবে নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র বলছে, যে চার বিশ্ববিদ্যালয় এখনো গুচ্ছের ভর্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেনি তারা শর্তসাপেক্ষে গুচ্ছে ফিরতে পারে। তাদের শর্তগুলো হলো- দ্রুত ভর্তি পরীক্ষা শেষ করতে হবে, একাধিক মাইগ্রেশন বন্ধ করা এবং মাইগ্রেশনের সময় বারবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফি নেওয়া বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়াও অন্য সংকটগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে সমাধান করতে হবে। আগামী মঙ্গলবার গুচ্ছের চূড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারণ স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ইতোমধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের একটি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে। চলতি মাসেই ভর্তি পরীক্ষা নেবে চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার একটি রোডম্যাপ নির্ধারণ করা হলেও সেটি চূড়ান্ত থাকবে কি না তা নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভর্তি পরীক্ষার একটি তারিখ নির্ধারণ করা হলেও এখনো ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়নি। সব বিশ্ববিদ্যালয় চূড়ান্ত ঐকমত্যে এলেই পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত এক উপাচার্য বলেন, সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যেই তাদের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত মতে, গুচ্ছ থেকে বের হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যেই নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। ফলে তাদের গুচ্ছে ফেরার পথ অনেকটা কঠিন। তবে যারা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন নাই তাদের দু-একটি হয়তো ফিরতে পারে।
তিনি বলেন, আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি গুচ্ছ ভর্তি কমিটির বৈঠক ইউজিসিতে অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে চূড়ান্তভাবে বোঝা যাবে কারা শেষমেশ গুচ্ছে থাকবে আর কারা থাকবে না। ওইদিন এবারের গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার ভর্তি বিজ্ঞাপ্তি প্রকাশের সিদ্ধান্ত আসবে।
জিএসটি গুচ্ছভুক্ত সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা কমিটির আহ্বায়ক ও মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল আজীম আখন্দ বলেন, ৪ ফেব্রুয়ারির সভায় গুচ্ছে অংশ নেওয়া ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা অংশ নেবেন। সেখানে গুচ্ছের চূড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারণ হবে।
যে কারণে সংকট সংশ্লিষ্টা জানান, মূলত গুচ্ছে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে বিগত সময়ের অব্যবস্থাপনার কারণেই আজকের এই অবস্থা। সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করলে গুচ্ছ নিয়ে জটিল এই পরিস্থিতি তৈরি হতো না। এতে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবিধা হলেও দুর্ভোগ বাড়বে শিক্ষার্থীদের।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা ও ভর্তি নিয়ে ধীরগতি, সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত ভালো শিক্ষার্থী না পাওয়া, গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার খরচের হিসাব নিয়ে নয়ছয়, মেধাবীদের ভর্তিতে অনাগ্রহ, গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েও শিক্ষার্থী না পাওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব স্বকীয়তা নষ্ট হওয়াসহ অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণেই মূলত বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুচ্ছ থেকে বের হয়ে যেতে চায়।
গত দুই বছরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এই প্রক্রিয়া থেকে বের হতে জোর চেষ্টা চালিয়েছিল। এ কারণে গত শিক্ষাবর্ষের পরীক্ষা নিয়ে দেখা দেয় জটিল অবস্থা। শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলরের অভিপ্রায় অনুযায়ী, গতবার গুচ্ছ পদ্ধতিতেই পরীক্ষা হয়।
এবারের ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের গুচ্ছে ভর্তি পরীক্ষা শুরুর পর থেকেই দেখা দেয় পুরোনো সংকট। আপত্তি তুলে বের হয়ে যাওয়ার পথ খুঁজতে শুরু করে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়। সর্বপ্রথম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ থেকে বের হয়ে নিজস্ব প্রদ্ধতিতে ভর্তি নেওয়ার জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। শিক্ষা উপদেষ্টাসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি একাধিকবার বৈঠক করেও বিষয়টি মিমাংসা করতে পারেনি।
প্রসঙ্গত, করোনা মহামারির সময় যাতায়াত সমস্যার কথা বিবেচনা করে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া শুরু হয়। ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুয়েট ছাড়া বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেয়।
এর মধ্যে কৃষি ও কৃষি শিক্ষাপ্রধান সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কৃষি গুচ্ছ, তিনটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে প্রকৌশল গুচ্ছ এবং ২৪টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে (জিএসটি) গত সেশন পর্যন্ত গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :