ঢাকা রবিবার, ০২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

এস আলম, বেক্সিমকোসহ শীর্ষ গ্রুপের ১৭৯ কোটি অর্থায়ন

শাহীনুর ইসলাম শানু

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২, ২০২৫, ০২:৫৩ এএম

এস আলম, বেক্সিমকোসহ শীর্ষ গ্রুপের ১৭৯ কোটি অর্থায়ন

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

জুলাই আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। তার প্রতিষ্ঠিত অলাভজনক প্রতিষ্ঠান সূচনা ফাউন্ডেশন দেশে মানসিক প্রতিবন্ধকতা বা অটিজম নিয়ে কাজ করে। সেই প্রতিষ্ঠানে ১৭৯ কোটি টাকা অর্থায়ন করেছে দেশের বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো ও পিকে হালদারসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি।

অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই অর্থায়ন করেছে দেশের বিতর্কিত শিল্প গ্রুপগুলো। যার কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট সূচনা ফাউন্ডেশনের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করেছে। সূচনা ফাউন্ডেশনের পরিচালন ফিসহ অন্যান্য খরচ বাদে অবরুদ্ধ হওয়া ব্যাংক হিসাবে বর্তমানে স্থিতি রয়েছে ৬৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে, নিবন্ধিত কার্যালয়ে অফিস না থাকায় প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদন অনুসারে, সূচনা ফাউন্ডেশনে আরও দাতাদের মধ্যে রয়েছে মেঘনা গ্রুপ, সামিট গ্রুপ ও ইউনাইটেড গ্রুপ। এ ছাড়াও তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের (আওয়ামী লীগ) সাবেক সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রাণ গোপাল দত্তের অ্যাকাউন্ট থেকেও টাকা জমা হয়েছে। সন্দেহজনক লেনদেন করায় গত বছরের নভেম্বরে সূচনা ফাউন্ডেশনের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার আদেশ দেয় বিএফআইইউ।

২০১৪ সালে অলাভজনক ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সূচনা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠা করেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। সংস্থাটি মানসিক প্রতিবন্ধী, স্নায়ুবিক ব্যাধি, অটিজম ও স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে কাজ করত। পুতুল ট্রাস্টি বোর্ডের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন এবং বোর্ডে ছিলেন আরও তিন ট্রাস্টি। তারা হলেনÑ মাজহারুল মান্নান, মো. শামসুজ্জামান ও জাইন বারি রিজভী।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার (এস কে) সুর চৌধুরীর মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা বিদেশে অর্থ পাচার, ব্যাংক থেকে বেনামি ঋণ গ্রহণ ও তছরুপসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। তার মধ্যে আর্থিক খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপট করে ভারতে অবস্থান নেন প্রশান্ত কুমার হালদার বা পিকে হালদার। শেখ হাসিনার আমলে ভারতে গ্রেপ্তার হলেও জানুয়ারি মাসে ছাড়া পেয়ে সেখানেই আছেন হালদার।

বিএফআইইউয়ের প্রতিবেদন অনুসারে, সূচনা ফাউন্ডেশনে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন উৎস থেকে ১৭৯ কোটি টাকা জমা হয়েছে। এর মধ্যে ১১৪ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। বর্তমানে ফাউন্ডেশনে আটকে আছে ৬৫ কোটি টাকা। সূচনা ফাউন্ডেশনের টাকা এসেছিল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা ইসলামি ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে।

এদিকে, সূচনা ফাউন্ডেশনের নিবন্ধিত ঠিকানায় গত বুধবার গিয়ে অফিসের ‘অস্তিত্ব’ খুঁজে পায়নি বলে জানিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কন্যা পুতুল বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে কর্মরত। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুতুলের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে পূর্বাচলে প্লট অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে তথ্য গোপন করা ও ক্ষমতার অপব্যবহার করার অভিযোগে দুদকও একটি মামলা করেছে পুতুলের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা এবং ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়সহ শেখ পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগে একাধিক মামলা করা হয়েছে।

এদিকে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে বিকর্তিত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এস আলমের নিয়ন্ত্রণে ছিল দেশের শরিয়াভিত্তিক ৯টি ব্যাংক।

বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট ও বেনামি ঋণ নেওয়ায় ইতোমধ্যে গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলমসহ তার পরিবারের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা দায়ের করেছে দুদক। তার মধ্যে শুধু ইসলামি ব্যাংক থেকে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা সরিয়ে নেয় এস আলম গ্রুপ। একইসঙ্গে টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ৫৮ একর জমি ক্রোকের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। 

অন্যদিকে, দেশের শীর্ষ শিল্প বেক্সিমকো গ্রুপ। সেই শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অধিকর্তা ছিলেন দেশের আর্থিক খাতে এক অভিশপ্ত নাম সালমান এফ রহমান।

গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। দরবেশখ্যাত এফ রহমানের নামে গত ১৫ বছরে আর্থিক খাতে নজিরবিহীন দুর্নীতি, লুটপাট, জালিয়াতি ও টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। দেশের সরকারি ও বেসরকারি সাতটি ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন।

২০২৩ সাল শেষে জনতা ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকটিতে সালমান এফ রহমানের দুই প্রতিষ্ঠানে ২৩ হাজার ৭০ কোটি টাকার ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপের ২০ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। ফান্ডেড ২০ হাজার ২০৮ কোটি এবং নন-ফান্ডেড ৫৪৪ কোটি টাকা। বেক্সিমকো লিমিটেডে ফান্ডেড ১ হাজার ৯৯৪ কোটি ও নন-ফান্ডেড ৩২৪ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে।

বিগত কয়েক দশকে শেয়ারবাজারে এমন কোনো বড় কেলেঙ্কারি হয়নি; যার সঙ্গে সালমান এফ রহমানের সম্পৃক্ততা নেই। তিনি গত ৩ বছরেই দৃশ্যমানভাবে বাজার থেকে ৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা নিয়েছেন। অদৃশ্যসহ ২০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এফ রহমান।

আরবি/জেডআর

Link copied!