দ্বার খুলল অমর একুশের বইমেলা-২০২৫। বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণে মাসব্যাপী দেশের বৃহত্তম অমর একুশে বইমেলার উদ্বোধন করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল শনিবার বিকেল ৪টায় বইমেলার উদ্বোধন করেন তিনি। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক।
অমর একুশে বইমেলা-২০২৫ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিজয়ীদের হাতে ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২৪’ তুলে দেন প্রধান উপদেষ্টা। এবার সাতজন লেখককে এই পুরস্কার দেওয়া হয়।
পুরস্কারপ্রাপ্তরা হলেন-মাসুদ খান (কবিতা), শুভাশিস সিনহা (নাটক ও নাট্যসাহিত্য), সলিমুল্লাহ খান (প্রবন্ধ/গদ্য), জি এইচ হাবীব (অনুবাদ), মুহম্মদ শাহজাহান মিয়া (গবেষণা), রেজাউর রহমান (বিজ্ঞান), সৈয়দ জামিল আহমেদ (ফোকলোর)।
প্রতি বছরের মতো মাসব্যাপী চলবে এই বইমেলা। বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিস্তীর্ণ প্রান্তরজুড়ে নতুন ও পুরোনো সব বইয়ের পসরা সাজিয়ে নিতে ব্যস্ত প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানগুলো। স্টল ও প্যাভিলিয়নে বিক্রয়কর্মীদের ব্যস্ততার পাশাপাশি মেলার দুই প্রাঙ্গণ মুখর হয়ে উঠতে শুরু করেছে কবি, লেখক, সাহিত্যিক, পাঠক ও দর্শনার্থীদের পদচারণায়।
এ বছরের বইমেলার প্রতিপাদ্য বিষয় ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান: নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ’। বইমেলায় অংশগ্রহণকারী ৭০৮ জন প্রকাশকের মধ্যে ৯৯টি স্টল বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে, ৬০৯টি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নির্মাণ করা হয়। গত বছর বইমেলায় ৬৩৫টি প্রতিষ্ঠানকে মোট ৯৩৭টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। মেলায় ৩৭টি প্যাভিলিয়ন থাকবে, একটি বাংলা একাডেমিতে এবং ৩৬টি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। লিটল ম্যাগাজিন কর্নারটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্মুক্ত মঞ্চের কাছে গাছের নিচে থাকবে, তাতে প্রায় ১৩০টি লিটল ম্যাগাজিন স্টল থাকবে।
প্রতিবছরের মতো এবারও মেলার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে শিশু-কিশোরদের জন্য শিল্পাচার্য, আবৃত্তি ও সংগীত প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন বিনোদনমূলক কার্যক্রমের আয়োজন করা হবে। ৮ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি বাদে শুক্র ও শনিবার বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত চলবে বিশেষ ‘শিশু প্রহর’। আয়োজকরা বলছেন, এই বছর অমর একুশে বইমেলা পরিবেশবান্ধব এবং শূন্য-বর্জ্য হওয়ার লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে। ‘সকল অংশগ্রহণকারী এবং বইমেলার অংশীদারদের একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের পরিবর্তে পাট, কাপড় ও কাগজের মতো টেকসই উপকরণ ব্যবহার করার জন্য উৎসাহিত ও অনুরোধ করা হচ্ছে। বইমেলার বিন্যাস গতবারের মতো থাকলেও কিছু আঙ্গিকগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিশেষ করে মেট্রোরেল স্টেশনের অবস্থানগত কারণে গতবারের মেলার বাহির-পথ এবার একটু সরিয়ে মন্দির গেটের কাছাকাছি স্থানান্তর করা হয়েছে।
এ ছাড়া টিএসসি, দোয়েল চত্বর, এমআরটি বেসিং প্লান্ট এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন অংশে মোট চারটি প্রবেশ ও বাহির-পথ থাকবে। খাবারের স্টলগুলো ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনের সীমানাঘেঁষে বিন্যস্ত করা হয়েছে।
নামাজের স্থান ও ওয়াশরুমসহ অন্যান্য পরিষেবা অব্যাহত থাকবে। শিশুচত্বর মন্দির গেটে প্রবেশের ঠিক ডান দিকে বড় পরিসরে রাখা হয়েছে, যেন শিশুরা অবাধে বিচরণ করতে পারে এবং তাদের কাক্সিক্ষত বই সহজে সংগ্রহ করতে পারে।
বইমেলায় বাংলা একাডেমি এবং মেলায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ২৫ শতাংশ কমিশনে বই বিক্রি করবে। প্রতিদিন বিকেল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে সেমিনার এবং সন্ধ্যায় থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বাংলা একাডেমির তিনটি প্যাভিলিয়ন এবং শিশু-কিশোর উপযোগী প্রকাশনার বিপণনের জন্য একটি স্টল থাকবে। আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি ও ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্যতীত প্রতি শুক্র ও শনিবার বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ‘শিশুপ্রহর’ থাকবে বইমেলায়।
অমর একুশে উদযাপনের অংশ হিসেবে শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি এবং সংগীত প্রতিযোগিতার আয়োজন থাকছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে থাকছে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা। মেলার প্রবেশ ও বাহির পথে পর্যাপ্তসংখ্যক আর্চওয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
একুশে বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ২০২৪ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণগত মান বিচারে সেরা বইয়ের জন্য প্রকাশককে ‘চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার’ এবং ২০২৪ সালের বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের মধ্য থেকে শৈল্পিক বিচারে সেরা বই প্রকাশের জন্য তিনটি প্রতিষ্ঠানকে ‘মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ দেওয়া হবে। এ ছাড়া ২০২৪ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণগত মান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থের জন্য একটি প্রতিষ্ঠানকে ‘রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার’ এবং এ বছরের মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে স্টলের নান্দনিক সাজসজ্জায় শ্রেষ্ঠ বিবেচিত প্রতিষ্ঠানকে ‘কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ প্রদান করা হবে।
বইমেলায় বাংলা একাডেমি প্রকাশ করছে নতুন ৪৩টি ও পুনর্মুদ্রিত ৪১টি বই। এ ছাড়া প্রতি বছরের মতো এবারের মেলায়ও থাকছে দেশের বিনোদন অঙ্গনের তারকাদের বই। যেসব বইয়ের প্রতি বরাবরই পাঠকদের থাকে অন্যরকম আগ্রহ।
এবারের বইমেলায় থাকছে সংগীতশিল্পী ফাহমিদা নবীর একটি বই। নাম ‘ফাহমিদা নবীর ডায়েরি’।নতুন এ বইটি প্রকাশ করতে যাচ্ছে শব্দশিল্প প্রকাশনী, যার প্রচ্ছদ করেছেন চারু পিন্টু। বইটি নিয়ে তিনি ফেসবুকে একটি পোস্টে লিখেছেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমার বাবার লেখা, কথার ভঙ্গি, গান গাইবার অনুভব আমাকে অনুপ্রাণিত করত।
আম্মাকে দেখতাম বই পড়তে, ডায়েরি লিখতে। খুব ভালো লাগত। আমিও লেখার চেষ্টা করতাম, করছি।’ এরপর জীবনের নানারকম অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা এ বইটি সম্পর্কে ফাহমিদা নবী আরও লিখেছেন, ‘গানের গভীরতায় জীবনবোধ আর চারপাশের যাপিত জীবন কোনোটাই জীবনদর্শনের বাইরে নয়। তাই যা দেখি তাই নিজের মতো করে লিখি, ভাবনাগুলো নিয়ে ইতিবাচকতায় সমাধানের পথ খুঁজি আর লিখে ফেলি উপলব্ধি। চলতি পথে জীবনের অনেক অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি অনুভব ও অনুধাবনের মাধ্যমে তুলে ধরি।’
এদিকে ২০২৪ সালের শেষদিকে প্রকাশিত হয়েছে বরেণ্য অভিনেতা, নাট্যকার ও নির্মাতা আবুল হায়াতের আত্মজীবনী ‘রবি পথ’। নতুন এ বইটি পাওয়া যাবে এবারের বইমেলায়।
অভিনেত্রী ফারজানা ছবির উপন্যাস ‘বৃত্তবাস’। যেটি প্রকাশ হবে মিজান পাবলিশার্স থেকে। এবারের মেলায় অভিনেত্রী আশনা হাবিব ভাবনার একটি উপন্যাস ও একটি কবিতার বই পাওয়া যাবে। উপন্যাসের নাম ‘আমরা কখনো বন্ধু ছিলাম না’। অভিনেতা ফারুক আহমেদের লেখা ‘স্মৃতিতে হুমায়ূন আহমেদ’ ও ‘আমার না বলা কথা’র পর এবার থাকছে ‘হাউ মাউ খাও’। প্রকাশ পেয়েছে মিজান পাবলিশার্স থেকে। গীতিকার ও নির্মাতা ওয়ালিদ আহমেদের লেখা দুটি বই আসছে এবারের মেলায়।
ভালোবাসা, অনুভূতি ও জীবনের নানা রঙের সংমিশ্রণে লেখা গান ও কবিতার সংকলন ‘দূরে গোধূলি’ এবং উপস্থাপনা, রেডিও-টিভি প্রেজেন্টেশন ও আত্মবিশ্বাসী কথা বলার কৌশল নিয়ে লেখা ‘কথার জাদু’। ধ্রুপদী পাবলিকেশনসের স্টলে পাওয়া যাবে বই দুটি। অভিনেত্রী শানারেই দেবী শানু ও অভিনেত্রী আশনা হাবিব ভাবনার বইও প্রকাশ পাবে এবারের বইমেলায়। শানুর উপন্যাস ‘বাঘ মানুষ’ প্রকাশ করছে ‘আজব প্রকাশ’।
বইমেলা প্রতি কর্মদিবসে সবার জন্য বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা এবং সরকারি ছুটির দিনে সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত উন্মুক্ত থাকবে। দুপুরের খাবার ও নামাজের জন্য এক ঘণ্টা বিরতি থাকবে। ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে মেলা সকাল ৮টা থেকে শুরু হয়ে রাত ৯টা পর্যন্ত চলবে।
উল্লেখ্য, অমর একুশে বইমেলায় বই প্রকাশের আগে পাণ্ডুলিপি বাংলা একাডেমি বা পুলিশকে পড়তে দেওয়ার বিষয়টি হাস্যকর বলে মন্তব্য করে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেছেন, গণমাধ্যমে একটা সংবাদ ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করছে। পুলিশের এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বলা হচ্ছে, বই ছাপানোর আগে বাংলা একাডেমি বা পুলিশকে পড়তে দেওয়া উচিত। এটা অবিশ্বাস্য, এটা হাস্যকর। আমাদের সরকারের নীতিমালার আশপাশেই নেই।
গতকাল শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার চত্বরে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, সরকার মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। সেটা যদি আমাকে গালাগালি করেও হয়, এতে কিছু যায় আসে না। আর বই প্রকাশ সেন্সর করব, এটা হাস্যকর। এই ভুল বোঝাবুঝি এখানেই দূর করতে চাই। অন্তর্বর্তী সরকারের বই সেন্সরের পরিকল্পনা নেই। ওই পুলিশ কর্মকর্তা যদি বলে থাকেন, সেটা তিনি তার ব্যক্তিগত ভাবনার কথা বলেছেন। এটার সঙ্গে আমরা একমত নই।
আপনার মতামত লিখুন :