ঢাকা সোমবার, ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

আন্দোলনের নেপথ্যে কী

মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২৫, ০১:১৭ এএম

আন্দোলনের নেপথ্যে কী

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

‘গুলশান, মহাখালী ও বনানী রোডে পোলাপানরা সব সড়কে বইসা আছে, তারা তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় চায়, এমন আন্দোলন চলছে আমি তো জানি না। এখন এ রাস্তা দিয়ে তেমন কোনো গাড়ি চলতাছে না। আমি এখন টাঙ্গাইলে কেমনে যামু বাবা’।

গতকাল রোববার বিকেল ৪টার ঢাকায় পরিচিত একজনকে ফোন করে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন, যাতায়াতে বাধা পাওয়া আজমল নামের এক ব্যক্তি। তিনি মহাখালীতে ক্যানসার হাসপাতালে রোগী দেখতে এসেছিলেন। অবরোধের কারণে ঢাকার মহাখালী এলাকায় আটকা পড়েছিলেন তিনি। এভাবেই গত এক সপ্তাহের টানা আন্দোলনে ভোগান্তিতে পড়ছেন, এ সড়কে চলাচলকারী বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। 

তিতুমীরের এই আন্দোলনকে অনেকেই অযৌক্তিক হিসেবে দাবি করছেন। তার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে অনড় কলেজটির শিক্ষার্থীরা। সরেজমিনে দেখা গেছে, ছাত্রলীগ-শিবিরের এক অংশের সর্মথকেরা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তবে আন্দোলনের পন্থা নিয়ে তাদের মধ্যে মতভেদ তৈরি হচ্ছে। একটি পক্ষ আন্দোলন করতে চাইলেও রাস্তা বন্ধের পক্ষে নেই। আবার অন্য পক্ষ রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলন করতে ইচ্ছুক।

এদিকে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন হয়তো অন্তর্বর্তী সরকারের গলার কাঁটা হয়ে উঠতে পারে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন। তাই এ বিষয়ে সরকারের অতিরিক্ত সতর্ক থাকা উচিত বলে জানান তারা।

সংশ্লিষ্ট তথ্যে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিতুমীর কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে থেকে আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করছে। আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ছাত্রলীগের রিপন, জুয়েল, সাইফুল, ইব্রাহীম, সানিসহ বেশ কিছু নেতাকর্মী শেলটার দিচ্ছেন। পাশাপাশি তারা এ কাজে ছাত্রলীগ নেতা মির্জা রাকিব, সুজন, জাহিদ, মো. বেলাল আহমেদ তালুকদার, মাহফুজ, সাবের হোসেন, সোহান, রাসেলসহ বেশ কয়েকজনকে সহযোগিতা করছেন।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে আন্দোলন মানুষের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ ও দেশের সচেতন মহল মনে করছে- তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা কি সত্যিই বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে আন্দোলন করছে নাকি এর নেপথ্যে অন্য কিছু রয়েছে।

এদিকে তিতুমীর কলেজকে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর আগে তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌক্তিকতা যাচাইয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আশ্বাসের ১৪ দিনের মাথায় একটি কমিটি গঠন করা হয়। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের যৌক্তিকতা ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ৫ সদস্যের কমিটি সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন জমা দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

দাবির মুখে সরকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করবে না: এদিকে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, দাবির মুখে সরকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করবে না। সাত কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একে অপরকে চায় না। তাই ৭ কলেজকে নিয়ে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য একটি কমিটি কাজ করছে। তবে দাবি বাস্তবায়নের সময় বেঁধে দেওয়া কাক্সিক্ষত নয় বলে জানান তিনি। গতকাল পরিকল্পনা কমিশনে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠক শেষে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন।

ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, তিতুমীর কলেজকে বিশেষ কোনো সুবিধা দেওয়ার সুযোগ নেই। দাবির মুখে সরকার আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করবে না। 

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘আমি মনে করি, এ মুহূর্তে অনেক কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করা উচিত। এর মধ্যে রাজশাহী কলেজ রয়েছে।’

তিতুমীর কলেজের অনেক শিক্ষার্থী ক্লাসে ফিরে যেতে চায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা জনদুর্ভোগ চায় না। জনদুর্ভোগের বিষয়টি মাথায় রাখতে শিক্ষার্থীদের অনুরোধও করেন তিনি। 

তিনি বলেন, ‘আমরা দাবি দাওয়ার জন্য আসিনি। একটা সুশাসন ও সংস্কারের জন্য এসেছি। দাবির মুখে সরকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করবে না।’

এর আগে গত শনিবার রাতে দ্রুত দাবি বাস্তবায়ন করা না হলে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছিলেন তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। সেই ধারাবাহিকতায় রোববারও আমরণ অনশন করেন তারা। অসুস্থ হয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন এখনো চারজন। শিক্ষার্থীরা বলছেন, যেকোনো মূল্যে ৭ দফা কর্মসূচি মেনে নেওয়ার ঘোষণা আসতে হবে। যতক্ষণ এ ঘোষণা না আসবে, ততক্ষণ তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। এ ছাড়া তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, এই অবস্থায় তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের ঘোষণা আদায়ে সময় বেঁধে দিয়ে আন্দোলন করার যৌক্তিকতা নেই।

এসব বিষয়ে তিতুমীরের সবেক শিক্ষার্থীরা বলছেন, শিক্ষা উপদেষ্টা রাজশাহী কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করা উচিত এটা বললেন কেন? উপদেষ্টা রাজশাহী কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করবে ভালো কথা এর সঙ্গে তিতুমীরের নাম আসবে কেন? তারা বলছেন, উপদেষ্টা সাহেব কি রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সৃষ্টির জন্য আমন্ত্রণ জানালেন?

অনেকেই বলছেন, রাজধানীর সুনামধন্য ৭টি কলেজ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে, তা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে আন্তরিক মনে হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে ৭ কলেজ নিয়ে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় বা বোর্ড করার ঘোষণা দিয়েছে। তবে, সরকারের এ সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধা আঙুল দেখিয়ে দেশের নাজুকতম অবস্থায় একটি পরিকল্পিত অস্থিরতা সৃষ্টি করছে তারা। একটি বিশ্ববিদ্যালয় হতে হলে যে পরিমাণ অবকাঠামো, আর্থিক সার্পোটসহ জনবল প্রয়োজন তা বর্তমান প্রেক্ষাপটে জোগান দেওয়া প্রায় অসম্ভব। একই সঙ্গে ঢাকায় ৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।

সেখানে তিতুমীর সাধারণ মানুষকে আন্দোলনের মধ্যে জিম্মি করে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর হবে এমন কোনো আশ্বাস পায়। সারা দেশে আরও অনেক ঐতিহ্যবাহী কলেজ রয়েছে তারাও এমন আন্দোলনে নেমে পড়ার সমূহ-সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। ফলে ৭ কলেজ থেকে বের হয়ে নিজেদের আলাদা ভাবা এবং এমন দাবি করা পাগলের প্রলাপ ছাড়া কিছু নয়।

বর্তমানে তিতুমীর কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত। কিন্তু তাতে নানা সংকট দেখা দেওয়ায় ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলছিল বহু দিন ধরে। সেই সমস্যার সমাধানের দাওয়াই হিসাবে তারা ভাবছে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। এর আগে গত ৬ নভেম্বর এ দাবিতে কলেজের সামনের সড়কে মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছিল তিতুমীরের শিক্ষার্থীরা। তার আগে ৩০ নভেম্বরও কলেজের সামনের সড়ক ২ ঘণ্টা অবরোধ করে রাখে তারা। এরপর গত সোমবার মহাখালীতে ‘ব্লকেড’ কর্মসূচি ও অনশন কর্মসূচি চলতে থাকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরই একমাত্র দাবি নয়: তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরই একমাত্র দাবি নয় বলে জানিয়েছেন বিক্ষোভে থাকা একাধিক শিক্ষার্থীরা। এ বিষয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মোহাম্মাদ শিমুল। তিনি বলেন, ‘আসলে আমাদের মূল দাবি, শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন।  চলমান শিক্ষাব্যবস্থায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর পড়াশুনা শেষ করতে করতে ৭-৮ বছর সময় লেগে যায়। আমরা চাই এ সেশনজট থেকে মুক্তি পাক শিক্ষার্থীরা।’

আন্দোলনে নামার কারণ ব্যাখ্যা করে সৌরভ নামের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমাদের কলেজে প্রত্যেকটি বিভাগে শিক্ষকের সংকট, ল্যাব ফ্যাসিলিটি নেই। দীর্ঘদিনের এসব সংকট কোনোভাবেই কাটছে না। তাই বাধ্য হয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি অন্য দাবি নিয়েই সড়কে নামতে হয়েছে আমাদের।’

কলেজের ভূগোল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীর আশকর মিয়া বলেন, ‘আমরা ক্লাস করি কলেজের শিক্ষকদের কাছে। কিন্তু পরীক্ষার সময় এত দিন আমাদের প্রশ্ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।  এ ব্যবস্থারও পরিবর্তন চাই আমরা। আমরা নিজস্ব স্বাধীনতা চায়।’

একই বিভাগের শিক্ষার্থী মো. শান্ত মিয়া বলেন, ‘আমি কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম ২০২১-২২ সেশনে।  এখন পড়ছি সেকেন্ড ইয়ারে। এরই মধ্যে আমাদের ৫ মাস সেশনজট হয়ে গেছে। আমাদের ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হতে চেয়েছিল ২০  জানুয়ারি আর শেষ ৯ এপ্রিল, পরীক্ষা তো দূরের কথা কিছুই হয়নি।  মাত্র ৮টি বিষয়ের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য ৪-৫ মাস সময়ের প্রয়োজন কেন? আবার এ পরীক্ষার পর আরও ১-২ মাস লাগবে প্র্যাক্টিক্যাল ও ভাইভা শেষ হয়। তার মানে সেকেন্ড ইয়ার শেষ করতে করতেই ১ বছরের বেশি সময় সেশনজটে পড়তে হয় আমাদের।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সময়ের কি কোনো মূল্য নেই? এ বাড়তি সময়ের জন্য আমাদের থাকা-খাওয়ার পেছনে কত বাড়তি খরচ হয়, সেই হিসাব কি কেউ করে?’

কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ফরহাদ হাসান মনে করেন, পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় না হলে তাদের এ সংকটের সুরাহা হবে না। ‘এই দাবি পূরণ হলেই কেবল আমরা এসব সমস্যা থেকে মুক্তি পাব। তাই এটা আমাদের কাছে খুবই যৌক্তিক আন্দোলন।’ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিলে এ ৭ কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের সবগুলোর জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি তোলে। তবে এখন তিতুমীরের শিক্ষার্থীরা শুধু তাদের জন্যই একটি বিশ্ববিদ্যালয় চাইছে।

মো. সুমন মিয়া বলেন, ‘আমরা চাই, সরকারি তিতুমীর কলেজকে ‘তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয়ে’ রূপান্তরের জন্য কমিশন গঠন করা হোক।

অবরোধ ঘিরে সতর্ক পুলিশ: গতকাল সন্ধ্যা ৬টার পর কলেজ থেকে মিছিল নিয়ে এসে মহাখালী অবরোধ করেন তারা। শিক্ষার্থীদের এই অবস্থান ঘিরে পুরো এলাকাজুড়ে মোতায়েন করা হয় বিপুলসংখ্যক পুলিশ। আমতলী মোড়ে প্রস্তুত রাখা হয় জলকামান।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. তারেক মাহমুদ বলেন, ‘বর্তমানে আমরা আমতলীতে অবস্থান করছি। আমরা পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছি।’ 

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে রাস্তায় যান চলাচল শুরু করার কোনো ব্যবস্থা করবেন কি না? এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত এখনো আসেনি। আমরা বর্তমানে আমাদের অবস্থানে আছি।‘

এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত অবরোধের ফলে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের উভয় পাশের যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে গুলশান ট্রাফিক বিভাগ।

আরবি/জেডআর

Link copied!