ঢাকা সোমবার, ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

সুপার স্পেশালাইজডে সুপার অনিয়ম

শহিদুল ইসলাম রাজী
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২৫, ০৩:৪২ পিএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে চলছে সুপার অনিয়ম। হাসপাতালে জনবল নিয়োগে, ব্যবস্থাপনায়, প্রশিক্ষণে এবং অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয় ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে পদোন্নতি দিয়ে শীর্ষ পদে বসানোসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। বিএসএমএমইউর সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদের নজিরবিহীন অপকর্মে হাসপাতালটি এখনো শুরুর সংকটেই ঘুরপাক খাচ্ছে।

বিএসএমএমইউ সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে গতকাল রোববার অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বেলা ১১টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আজাদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দল এ অভিযান চালায়। অভিযানকালে জনবল নিয়োগ, পদোন্নতি, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতির সত্যতা পাওয়া গেছে। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য তুলে ধরে পরর্বর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশসহ কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করবে দুদক টিম।

দুদকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘বিএসএমএমইউর সাবেক অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদের দায়িত্ব পালনকালীন জনবল নিয়োগ, যন্ত্রপাতি ক্রয় ও হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে। এ অভিযোগের ভিত্তিতে আমাদের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট সেখানে অভিযান চালায়। এ সময় বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়। দুদক টিম অভিযানে প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণ ও অভিযোগসংক্রান্ত রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা শেষে কমিশনের কাছে সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন দাখিল করবে। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কমিশন পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেবে। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

দুদকের কাছে থাকা অভিযোগে বলা হয়, চরম দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় ডুবছে বিএসএমএমইউর ৭৫০ শয্যার সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল। এটি একটি করপোরেট হাসপাতাল হিসেবে গড়ে তোলা হবে, যেখানে ব্রেন ক্যানসার, দুর্ঘটনায় বড় ইনজুরি, কিডনি ও লিভার ট্রান্সপ্লান্ট, ইউরোলজি, কার্ডিয়াক সার্জারি ও কার্ডিওলজিসহ সব ধরনের জটিল রোগের উন্নত চিকিৎসাসেবা দেওয়া হবে। আমেরিকা, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে যে ধরনের হাসপাতাল রয়েছে, সেই মডেলেই হাসপাতালটি নির্মাণ করা হয়। 

২০২২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের উদ্বোধন করা হয়। বিএসএমএমইউর তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন ও তার দোসররা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ২০২৩ সালে লোকবল নিয়োগ দেন। উদ্বোধনের পর দুই বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও হাসপাতালটি পুরোপুরি চালু করা হয়নি। হাসপাতালটির ক্রয়কৃত ২৮৩ কোটি টাকার অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির বেশির ভাগই নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ফলে বিশাল এই প্রতিষ্ঠান থেকে কার্যত কোনো সেবাই মিলছে না।

অভিযোগে বলা হয়, সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের প্রকল্প পরিচালক হলেন অধ্যাপক ডা. জুলফিকার রহমান খান বাদশা। তার তথ্যমতে, এই হাসপাতালের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৮ সালে; শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৩ সালের জুনে। কিন্তু প্রায় এক বছর আগেই কাজ অসমাপ্ত রেখে ২০২২ সালে তড়িঘড়ি করে এটি উদ্বোধন করা হয়। এই হাসপাতাল নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য চুক্তি অনুযায়ী ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয় কোরিয়ান সরকার।

বাকি ৫০০ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকার দেয়। চুক্তি অনুযায়ী এই হাসপাতালে দুই বছর চিকিৎসাসেবা ও প্রশাসন পরিচালনা করার কথা কোরিয়ান সরকারের ৫৬ জন স্পেশালিস্টের। কিন্তু কোরিয়ান সরকার বারবার চিঠি দেওয়ার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তাতে সাড়া দেননি। এটা কোরিয়ান সরকারের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। তিনি নিজের পছন্দের চিকিৎসকসহ জুনিয়র কর্মকর্তাদের সিনিয়র পদে পদোন্নতি দিয়ে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের দায়িত্ব দেন। চুক্তির বাইরে গিয়ে ভিসির খেয়ালখুশিমতো হাসপাতাল পরিচালনা এবং দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে প্রতিষ্ঠানটি কার্যত চালু করা যায়নি।

অভিযোগে বলা হয়, সুপার হাসপাতালে কাজ করার লিখিত অঙ্গীকার করে কোরিয়ায় প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছিলেন ১৫৭ জন। এর মধ্যে ৫২ চিকিৎসক, ২৯ কর্মকর্তা, ৫৩ জন সিনিয়র স্টাফ নার্স ও ২৩ জন টেকনিশিয়ান। প্রশিক্ষণ শেষে ৬ চিকিৎসক, ৫ কর্মকর্তা, ৫০ জন সিনিয়র স্টাফ নার্স, ১১ জন টেকনিশিয়ানসহ ৭২ জন যোগ দিয়েছেন। বাকি ৮৫ জন যোগ দেননি।

যেসব চিকিৎসক দুই থেকে চার মাস প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তাদের প্রত্যেককে দৈনিক ৭৫ ডলার প্রশিক্ষণ ভাতা দেওয়া হয়। সেই হিসাবে যারা দুই মাস প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তারা একেকজন সাড়ে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা আর যারা চার মাস ছিলেন তারা ৯ থেকে ১০ লাখ টাকা পেয়েছেন।

এছাড়া তাদের যাতায়াত, হোটেল ভাড়া, খাওয়া প্রভৃতি খরচ মিলিয়ে আরও কয়েক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে যারা দুই মাসের প্রশিক্ষণ নেন, তারা প্রতিদিন ৬০ ডলার ভাতা পেয়েছেন।

সেই হিসাবে প্রতিজন দুই মাসে সাড়ে ৩ লাখ টাকা ভাতা পেয়েছেন। তাদেরও আসা-যাওয়া, হোটেল ভাড়া, খাওয়া খরচ প্রভৃতি মিলিয়ে আরও কয়েক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৮৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীও সুপার হাসপাতালে যোগ দেননি। তারা বিএসএমএমইউতে রয়ে গেছেন।

অভিযোগে আরও বলা হয়, বিএসএমএমইউর সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদের নজিরবিহীন অপকর্মে হাসপাতালটি এখনো শুরুর সংকটেই ঘুরপাক খাচ্ছে। ওই সময় নিয়োগ, কেনাকাটা, পদোন্নতিসহ কিছুই হতো না ঘুষ ছাড়া। বিএসএমএমইউতে এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা করেননি। 

অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদের বিদায়ের পর ভিসি হিসেবে নিয়োগ পান  অধ্যাপক ডা. দীন মো. নূরুল হক। তিনি বেশি দায়িত্ব পালন করেনি। তিনি বিদায়ের আগে একই কায়দায় জুনিয়র চিকিৎসকসহ কর্মকর্তাদের সিনিয়র পদে পদোন্নতি দিয়ে হাসপাতালের বিভিন্ন ইউনিটের দায়িত্ব দেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের কয়েক দিন পর ভিসি অধ্যাপক ডা. দীন মো. নূরুল হক পদত্যাগ করেন।

দুদক এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের একজন কর্মকর্তা জানান, বিএসএমএমইউর সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে জনবল নিয়োগে অনিয়ম, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম, প্রশিক্ষণে অনিয়ম, অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয় ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে পদোন্নতি দিয়ে শীর্ষ পদে বসানোসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে এই অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানকালে অনেক অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।

যেমন-অভিযানককালে দুদক টিম দেখতে পেয়েছে হাসপাতালটিতে অপ্রয়োজনীয় অনেক দামি যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়েছে। এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, হাসপাতালের ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম ও দুর্নীতির সত্যতা পাওয়া গেছে। 

তৃতীয়ত, সুপার হাসপাতালে আগ্রহী ১৫৭ চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারী সরকারি অর্থ খরচ করে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে প্রশিক্ষণ নেন। তারা পাঁচ বছর কাজ করার অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্তু প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী মাত্র ৭২ জন সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে যোগদান করেছেন। বাকি ৮৫ জন এই হাসপাতালে যোগদান না করে বিএসএমএমইউতে দায়িত্ব পালন করছেন।

চতুর্থত, হাসপাতালটিতে দুটি ব্যাংক ও একটি ফার্মেসি স্থাপনে অনিয়ম ও দুর্নীতি সংঘটিত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। পঞ্চমত, স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে অযোগ্য কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়ে হাসপাতালের শীর্ষ পদে বসানো হয়েছে।

অভিযানের বিষয়ে জানতে গতকাল বিকালে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. সাইফুল্লাহ মুন্সীর মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলে তিনি ফোনকল রিসিভ করেননি।