নগদ আর সঞ্চয়পত্রের দ্বন্দ্বে আটকা অনুদান

হাসান আরিফ

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৫, ০১:২০ এএম

নগদ আর সঞ্চয়পত্রের দ্বন্দ্বে আটকা অনুদান

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

জুলাই অভ্যুত্থানে শহিদদের পরিবারকে অনুদান এবং আহত ছাত্র-জনতার অনুদান ও সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য ২৩২ কোটি টাকা ছাড় করেছে অর্থ বিভাগ। 

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতিটি নিহত পরিবার পাবে ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। আর আহত ছাত্র-জনতার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করবে সরকার। কিন্তু নিহত পরিবার সঞ্চয়পত্রের পরিবর্তে নগদ টাকা দাবি করায় আটকে আছে বিতরণ কার্যক্রম।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, নিহতদের পরিবারকে নগদ টাকা না দিয়ে সঞ্চয়পত্র দেওয়া হবে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে দেওয়া হবে ১০ লাখ টাকা সমপরিমাণ সঞ্চয়পত্র। আর দ্বিতীয় ধাপে বাকি ২০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দেওয়া হবে আগামী বাজেটে। যা জুলাইয়ের পর থেকে বণ্টন করার সিদ্ধান্ত রয়েছে সরকারের।

সঞ্চয়পত্রের সুবিধার বাইরে জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে গণঅভ্যুত্থানে হতাহতদের আর্থিক সহায়তা করা হচ্ছে। এই সহায়তায় নিহত পরিবারকে নগদ পাঁচ লাখ টাকা করে দেওয়া হচ্ছে।

অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, অভ্যুত্থানে শহিদদের পরিবারকে অনুদান এবং আহত ছাত্র-জনতার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য অর্থ বিভাগ থেকে ২৩২ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে। আর আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সাড়ে তিনশ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হবে। ছাড়কৃত টাকা কর্তৃপক্ষ যেকোনো সময় সঞ্চয়পত্র হিসেবে বিতরণ করতে পারবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এই অর্থ বিতরণ করা হবে।

জানা গেছে, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, শহিদদের পরিবার সঞ্চয়পত্রের পরিবর্তে নগদ টাকা দাবি করায় তা বিতরণ করা যাচ্ছে না।

শহিদ পরিবারের একটা অংশ উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের সঙ্গে দেখা করে তাদের দাবি জানিয়ে আসেন।

এরপরই সঞ্চয়পত্র বিতরণ আটকে আছে। যদিও অনেক পরিবারের থেকে সঞ্চয়পত্র নেওয়ার জন্য নির্ধারিত ফরম পূরণ করা হয়েছে।

জানা গেছে, জুলাই অভ্যুত্থানে ৮২৬ জন শহিদের পরিবার এবং ১৫ হাজার আহতদের গত জানুয়ারি মাসে প্রথম কিস্তির মাসিক মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র কিনে দেওয়ার কথা ছিল। 

মেয়াদপূর্তিতে নগদায়নযোগ্য এসব সঞ্চয়পত্রের মুনাফা চলতি ফেব্রুয়ারি মাস থেকে পাওয়ার কথা ছিল। এসব সঞ্চয়পত্র কিনতে প্রায় ৬৩৮ কোটি টাকা খরচ হবে। শহিদ ও আহতের সংখ্যা বাড়লে এ খাতে টাকার পরিমাণও বাড়বে।

সূত্র জানায়, দেশের আর্থিক সংকটের কারণে সরকার বাজেট কাটছাট করছে, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বাদ দিতে হয়েছে। অনেক উন্নয়ন প্রকল্পে কাটছাট করা হয়েছে।

কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। সরকারি যানবাহন কেনার অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না। সব সংস্থার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও অন্যান্য খরচ কাটছাট করা হয়েছে।

এই পরিস্থিতিতেও সরকার জুলাই অভ্যুত্থানে হতাহতদের অনুদান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু সংকটের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকার নগদ অর্থের পরিবর্তে সঞ্চয়পত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মতো গণঅভ্যুত্থানে শহিদদেরও ভাতা দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের।

কিন্তু রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এসে এই ভাতা অব্যাহত রাখবে কি না, সেই সংশয় থেকেই সঞ্চয়পত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যাতে রাজনৈতিক সরকার আসার পরও তাদের সুবিধা অব্যাহত থাকে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ৮২৬ জন শহিদের প্রত্যেকের পরিবারকে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনে দেওয়ার কথা।

আহতদের মধ্যে ‘এ’ শ্রেণির এক হাজার জনকে দুই লাখ টাকা করে, ‘বি’ শ্রেণির তিন হাজার ও ‘সি’ শ্রেণির চার হাজার জনকে এক লাখ টাকা করে এবং ‘ডি’ শ্রেণির সাত হাজার জনকে ৫০ হাজার টাকা করে সঞ্চয়পত্র কিনে দেওয়া হবে। এ ছাড়া আহতদের দেশে-বিদেশে চিকিৎসার পরামর্শ সেবার জন্য ২৫ কোটি টাকা দেওয়া হবে। এসব খরচের জন্য ২৩২ কোটি ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে অর্থ বিভাগ।

জানা গেছে, এই সঞ্চয়পত্র নিহতদের পরিবার এবং আহতরা চাইলেই বিক্রি করতে পারবেন না।

তবে যারা সঞ্চয়পত্রের মুনাফা নিতে চাইছেন না, তাদের সঞ্চয়পত্র কিনে না দিয়ে নগদ টাকা দেওয়া ছাড়াও অন্য কী করা যায়, সে বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ও ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম এক চিঠিতে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদকে বলেছেন, আহত ছাত্র-জনতার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ৬৩৭.৮০ কোটি টাকা প্রয়োজন।

এর মধ্যে ৩৯০ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে আহতদের অনুদান দেওয়ার জন্য।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের চিঠির সূত্রে জানা গেছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে প্রত্যেক শহিদ পরিবারকে পর্যায়ক্রমে ৩০ লাখ টাকা অনুদান এবং আহতদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে উপদেষ্টা পরিষদের নবম বৈঠকের ১৪.২ নম্বর সিদ্ধান্তে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অধীনে গঠিত সেলের কার্যপরিধি সম্প্রসারণ করা হবে।

এ ছাড়া উপদেষ্টা পরিষদের ষোড়শ বৈঠকের ১৩ নম্বর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান অধিদপ্তর’ গঠিত না হওয়া পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ওই সেল জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদ পরিবারদের আর্থিক অনুদান এবং আহতদের পুনর্বাসনসংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে নির্বাহ করবে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান অধিদপ্তর’ প্রতিষ্ঠার পর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের এই সেল জুলাই গণঅভ্যুত্থান অধিদপ্তরকে সেলের সম্পদ ও দায়-দায়িত্ব হস্তান্তর করবে।

জানা গেছে, রুলস অব বিজনেস, ১৯৯৬-এর ২৩(৩) বিধি অনুসারে, এ সিদ্ধান্ত প্রয়োজনবোধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগকে জানাতে বলা হয়েছে।

সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতি সম্পর্কিত প্রতিবেদন, সিদ্ধান্তটি অবহিত হওয়ার পনেরো দিনের মধ্যে একবার এবং সিদ্ধান্তটির বাস্তবায়ন কার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত প্রতি মাসের ৪ তারিখের মধ্যে একবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ অধিশাখায় পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।

দুই উপদেষ্টা অর্থ উপদেষ্টাকে দেওয়া চিঠিতে বলেছিলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় জুলাই অভ্যুত্থানে শহিদ ব্যক্তিদের প্রত্যেকের পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

শহিদ পরিবার ও আহতদের অনুদান দেওয়ার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিতকরণের জন্য প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন ও নিম্নস্বাক্ষরকারীগণের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি গত ২৯ ডিসেম্বর (২০২৪ সালের) একটি সভায় মিলিত হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, খাতওয়ারি বাজেট বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

গত ১৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভা শেষে জুলাই অভ্যুত্থানে শহিদ পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা করে অনুদান দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ুবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম।

ফাওজুল কবির খান ও মো. নাহিদ ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, জুলাই অভ্যুত্থানে ৮২৬ জন শহিদ হয়েছেন, যাদের প্রত্যেকের পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা হারে মোট ২৪৭.৮০ কোটি টাকা দিতে হবে।

এ ছাড়া, অভ্যুত্থানে ১৫০০০ আহতকে অনুদান বাবদ ২৯০ কোটি টাকা এবং দেশে-বিদেশে আহতদের চিকিৎসা বা কনসালটেন্সি বাবদ ১০০ কোটি টাকা ছাড় করার অনুরোধ করা হয়েছে।

আহতদের মধ্যে মারাত্মক আহত ১০০০ জনের প্রত্যেককে ৫ লাখ, ৩০০০ জনের প্রত্যেককে ৩ লাখ, ৪০০০ জনের প্রত্যেককে ২ লাখ এবং বাকি ৭০০০ জনের প্রত্যেককে ১ লাখ টাকা হারে দেওয়ার অনুরোধ করেছেন ফাওজুল কবির ও নাহিদ ইসলাম।

গত ২১ ডিসেম্বর জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহিদ ও আহত ব্যক্তিদের নামের তালিকা চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে প্রথম ধাপের খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছে গণঅভ্যুত্থানসংক্রান্ত বিশেষ সেল।

প্রথম ধাপের খসড়া তালিকায় শহিদ ৮৫৮ জন এবং আহতের সংখ্যা ১১,৫৫১ জন।

বরাদ্দকৃত অর্থ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে শহিদ পরিবার ও আহতদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।

অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এই বাবদ প্রাপ্য অর্থ সম্পূর্ণভাবে নিবেদিত হবে। শহিদ পরিবার ও আহতদের সহায়তা ব্যতীত অন্য কোনো কাজে এ অর্থ ব্যয় করা যাবে না।

আরবি/জেডআর

Link copied!