ঢাকা বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

সূর্যশক্তিকে কাজে লাগাতে আসছে ৪০ বিদ্যুৎ প্রকল্প

শাহীনুর ইসলাম শানু
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৫, ০২:০০ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

দেশের স্থলভাগে তীব্র গ্যাসের সংকট চলছে। যার বিরূপ প্রভাব পড়েছে দেশের কৃষিক্ষেত্র ও শিল্পাঞ্চলগুলোতে। বিগত সরকার সেই প্রভাব মোকাবিলায় তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) নির্ভরতায় ছিল।

তবে অন্তর্বর্তী সরকার সেই এলপিজি নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে এবং গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্যাসকূপের অনুসন্ধান করছে।

এ ছাড়া গ্যাসনির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি পেতে সূর্যশক্তিতে ফিরছে সরকার। তাই নতুন করে ৪০টি বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নিতে যাচ্ছে।

নতুন প্রকল্পগুলোর মধ্যমে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ মিলবে। যদিও ২০২৫ সালে দেশের মোট জ্বালানির ১০ শতাংশ হওয়ার কথা থাকলেও মাত্র তিন শতাংশ অর্জন করেছে।

বিনিয়োগ অনাগ্রহকে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে দেশের অর্থনীতির সংস্কার ও সুরক্ষায় ১৮টি খাতে টেকসই উন্নয়নে কৌশল নির্ধারণ করেছে অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ টাস্কফোর্স কমিটি।

বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নে গত ১১ সেপ্টেম্বর অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ টাস্কফোর্স গঠন করে সরকার।

উন্নয়ন ও সংস্কারের প্রস্তাবিত সেই নীতি গত বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া হয়। 

জ্বালানি খাতের দৈন্য কমাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও নতুন গ্যাসের অনুসন্ধান করছে সরকার। টাস্কফোর্সের কৌশলপত্র পুনর্নির্ধারণী বৈঠকে গত সোমবার ১৮টি খাতের বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। 

অনুষ্ঠানে সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, এত দিন আমরা এলএনজি ও কয়লার দিকে ঝুঁকে ছিলাম। আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। আমরা নিজেরা গ্যাসের অনুসন্ধান করতে চাই।

তিনি বলেন, অনেক অবসরপ্রাপ্ত দক্ষ লোক আছে, তারা দেশের স্বার্থে কাজ করতে চান। আমরা তাদের দিয়েই অনুসন্ধানের কাজ শুরু করতে পারি। 

তার আগের একটি অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, দিনকে দিন দেশে গ্যাসের সরবরাহ কমে আসছে।

তাই এখন থেকে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর আলাদা গুরুত্বারোপ করা হবে। শিগগিরই ৪০টি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্প উদ্বোধন করা হবে। সেখান থেকে মিলবে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।

ফাওজুল কবির খান বলেন, সরকার কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়াতে টেকসই উদ্যোগের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

নবায়নযোগ্য শক্তির উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বড় পরিসরে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে এবং বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ চলছে।

তিনি বলেন, আমরা সাসটেইনেবিলিটিতে আমাদের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বৃহত্তর সিস্টেমের দিকে অগ্রসর হচ্ছি।

আমি আশা করি, আপনারা সাসটেইনেবিলিটির লক্ষ্যে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হবেন এবং দেশকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করবেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গ্রিন ফিন্যান্সের আওতায় ২০১৮-১৯ সাল থেকে গত ছয় বছরে দেশীয় ব্যাংকগুলো ৭৩ হাজার ১৭২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।

২০১৮-১৯ সালে এই পরিমাণ ছিল মাত্র ৯ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা, যা ২০২৩-২৪ সালে ২২ হাজার ৯৬০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।

অর্থাৎ গ্রিন ফিন্যান্স প্রতিবছর গড়ে ২৭.৮ শতাংশ বেড়েছে। অবশ্য ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এই হার ৮.৫ শতাংশ কমে যায়। ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বিনিয়োগের হার ৭৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।

এদিকে, চলতি ২০২৫ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ সক্ষমতা অর্জন করার লক্ষ্য থাকলেও ব্যর্থ হয়েছে। অর্জন করেছে প্রায় তিন শতাংশ।

তবে লক্ষ্য ছিল ২০৩০ সালে ৩০ শতাংশ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে শতভাগে উন্নীত হবে। পর্যায়ক্রমে ২০৫০ সালের পর আমরা আর জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করব না। 

সিইপিআর (সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চ) এবং ক্লিন (কোস্টাল লাইভলিহুড অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল অ্যাকশন নেটওয়ার্ক) সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা যায়, দেশের ৬২টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে ৪৩টি ব্যাংক সবুজ অর্থায়নে (গ্রিন ফিন্যান্স) বিনিয়োগ করছে।

সাবেক সরকারের আমলে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও অস্বচ্ছ বিনিয়োগে তা কমেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো শুধু নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে গত ছয় বছরে ২ হাজার ১১১ কোটি টাকা অর্থায়ন করেছে, যা মোট গ্রিন ফিন্যান্সিংয়ের মাত্র ২.৯ শতাংশ।

আবার ২০২০ সালে গ্রিন ফিন্যান্স ছিল মোট বিতরিত ঋণের ৩.৯৬ শতাংশ। ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) তা ছিল ১৬.৮৩ শতাংশ।

মোট বিনিয়োগের তুলনায় গ্রিন ফিন্যান্সের পরিমাণ খুবই কম। তার মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ নামমাত্র বলা যায়। তবে সরকার তা বাড়িয়ে নতুন কৌশলপত্র নির্ধারণ করেছে।

অতীত বিশ্লেষণ করা গবেষণা বলছে, ২০২৫ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা ১০% (৩,২৪৩ মেগাওয়াট) অর্জন করতে হলে আমাদের অবিলম্বে ২৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে।

২০৩০ সালের মধ্যে ৩০% (১১,৬০০ মেগাওয়াট) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে ৬ বছরে ৮৭ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা প্রয়োজন।

ভর্তুকি, কর অব্যাহতি, আমদানিনীতি যৌক্তিকীকরণ এবং সরকারি-বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে দীর্ঘমেয়াদি স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণের এক বড় পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। 
২০২৫ সালে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৩ শতাংশের কাছাকাছি অর্জন বাংলাদেশের।

নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক আইপিপির জন্য ১৫ বছরের কর অব্যাহতি প্রদান; যার মধ্যে ১০ বছরের জন্য ১০০ শতাংশ কর ছাড়, তিন বছরের জন্য ৫০ শতাংশ এবং দুই বছরের জন্য ২৫ শতাংশ কর ছাড় করা হয়েছে।

এদিকে, গত মাসে প্রধান উপদেষ্টা চীন সরকারকে বাংলাদেশে সোলার প্যানেল উৎপাদন কারখানা স্থাপনের আহ্বান জানিয়েছেন এবং নতুন করে প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান করা হচ্ছে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগে বহুপক্ষীয় এবং দ্বিপক্ষীয় অংশীদারদের আহ্বান করেছে ড. ইউনূসের সরকার।