বত্রিশোর্ধ্ব মো. হাসান আলী। পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট (সিএ)। একটি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের অডিট অফিসার হিসেবে কর্মরত তিনি। সন্ধ্যায় অফিস শেষ করে প্রতিদিনের মতো বাসায় ফিরছিলেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন দুই সহকর্মী। হঠাৎ কয়েকজন লোক তাকে নিয়ে জটলা তৈরি করেন, কৌশলে পকেটে ঢুকিয়ে দেন ইয়াবা। এরপরই ঘটনাস্থলে হাজির পুলিশ। নিয়ে যাওয়া হয় থানায়।
ঘটনাটি ঘটেছে গত ২ ফেব্রুয়ারি রোববার সন্ধ্যায় তেজাগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায়। রূপালী বাংলাদেশের অনুসন্ধানে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়া সংঘবদ্ধ এই চক্রের সঙ্গে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা পুলিশের একটি দল যুক্ত রয়েছে। তাদের নেপথ্যের শক্তি ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) ইবনে মিজান বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সেদিনের ঘটনার বেশ কয়েকটি সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া গেছে, ফুটেজে দেখা গেছে, ২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার রহমান’র রেগনাম সেন্টার ভবনে থাকা অফিস থেকে বের হচ্ছেন হাসান। সঙ্গে দুই সহকর্মী বাশার ও ইমাম হোসেন। তিনজন এসকেএস স্কাই ভবনের ফুটপাত ধরে হেঁটে পুলিশ প্লাজার দিকে যাচ্ছিলেন।
হাসান অফিস থেকে বের হওয়ার পর তার পিছু নেয় অজ্ঞাত দুই ব্যক্তি। হাসান হেঁটে এসকেএস স্কাই ভবনের সামনে গেলে আচমকা চারদিক থেকে ৮-১০ জন লোক তাকে ঘিরে ধরেন। এরপর কিল-ঘুষি দিতে থাকেন। হালকা গড়নের এক ব্যক্তি হাসানের পকেটে একটি ছোট ‘প্যাকেট’ ঢুকিয়ে দেন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও হাসানের সহকর্মী ইমাম হোসেন বলেন, কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই কয়েকজন পুলিশ সদস্য সেখানে হাজির হন। আবু ঈসা নামে একজন এসআই ছিলেন পোশাক পরে। পুলিশ সদস্যরা জোর করে হাসানকে গাড়িতে তুলে ফেলেন। সঙ্গে সঙ্গে সেখানে থাকা লোকগুলো সটকে পড়েন। পুলিশ সদস্যরা জানান, তার পকেটে ইয়াবা পাওয়া গেছে। হাসানকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় নেওয়ার পর হাজতে ঢুকিয়ে রাখা হয়।
ইয়াবা উদ্ধারের কথিত এই অভিযানের বিষয়ে জানতে চাইলে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার এসআই আবু ঈসা একেক সময় একেক কথা বলেন। প্রথমে তিনি দাবি করেন, সোর্সের মাধ্যমে তিনি খবর পেয়েছেন হাসান ইয়াবা নিয়ে আসছেন।
আবার বলেন, ঘটনাস্থলের বিপরীত পাশে তখন তিনি অবস্থান করছিলেন। তবে থানা পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনার সময় ওই এলাকায় ঈসার কোনো ডিউটিও ছিল না। আবার সহকারী কমিশনার (এসি) রব্বানী হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনার দিন থানার কুইক রেসপন্স টিমের সদস্য ছিলেন ঈসা। খবর পেয়ে তিনি সেখানে যান।
অনুসন্ধান বলছে, ২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৭টার দিকে হাসান আলীকে থানায় আনা হয়। তার কাছে পাওয়া প্যাকেটে ১৯৩ পিস ইয়াবা আছে বলে দাবি করে পুলিশ। খবর পেয়ে ছুটে আসেন হাসানের সহকর্মী ও স্বজনেরা। ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানো হচ্ছে বলে অভিযোগ তোলেন স্বজনেরা। থানা পুলিশ দায় এড়িয়ে ডিসি বিষয়টি দেখছেন বলে সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন।
হাসানের মামা সরকারি কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান মধ্যরাতে ছুটে যান ডিসির কাছে। প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ে সন্দেহভাজন কিছু না মনে হওয়ায়, পরের দিন ৩ ফেব্রুয়ারি সকালে হাসানকে ছেড়ে দেবেন বলে তাকে আশ্বস্ত করেন ডিসি। হাসানের মামা কামরুজ্জামানকে ডিসি বলেন, হাসানকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
ডিসির কথায় আশ্বস্ত হয়ে থানায় ফিরে আসেন কামরুজ্জামান। থানায় এসে তিনি ওসি ও এসির সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ডিসি নির্দেশনা দিয়েছেন, সেই অনুযায়ী তারা ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
স্বজনদের অভিযোগ, ডিসি হাসানকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলে মূলত স্বজনদের ব্যস্ত রাখেন, যাতে তারা ডিএমপির ঊর্ধ্বতনদের কাউকে জানাতে না পারেন। পরের দিন ৩ ফেব্রুয়ারি ডিসির কথামতো থানায় যান হাসানের মামা ও সহকর্মীরা। পুলিশের পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী থানায় আসেন তেজগাঁও জোনের এডিসি ও এসি।
তারা ওসির কক্ষে হাসানকে নিয়ে ঘণ্টাব্যাপী জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এর মধ্যে তারা হাসানের পিসিপিআর, মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন, মোবাইল কললিস্ট, শিক্ষা-কর্মজীবন ও ব্যক্তিগত তথ্য যাচাই-বাছাই করেন। তবে পুলিশ তার বিষয়ে সন্দেহজনক কোনো কিছু পায়নি বলেও স্বজনদের জানায়। এরপর শুরু হয় হাসানকে ছেড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া।
গত সোমবার দুপুরে হাসানকে তার মামা মো. কামরুজ্জামানের জিম্মায় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় থানা পুলিশ। এসআই আবু ঈসা ও এসআই জিহান হোসাইনকে ওসি গাজী শামীমুর রহমান একটি জিম্মানামা লিখে তাতে কামরুজ্জামানের সই নিতে বলেন। পরিদর্শক তদন্তের কক্ষে বসে জিম্মানামা লেখেন ওই দুই এসআই। জিম্মানামায় সই করেন হাসানের মামা কারুজ্জামান।
এসআই ঈসা জিম্মানামায় উল্লেখ করেন, ‘কতিপয় লোক এক ব্যক্তিকে আটক করেছে খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে হাসানকে সুস্থ অবস্থায় তাকে পরিবারের জিম্মায় দেওয়া হলো।’ হাসানকে যখন পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হবে, তখনই এসআই ঈসার কাছে একটি ফোন আসে।
এরপর হাসানকে মুক্তি না দিয়ে আটক রাখা হয়। জানতে চাইলে এসি রব্বানী হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, তিনি অনেক নিচের কর্মকর্তা। ওপরের কর্মকর্তারা যেভাবে নির্দেশনা দিচ্ছেন, সেভাবেই কাজ হচ্ছে।
হাসানের স্বজনদের অভিযোগ, এক কক্ষে জিম্মানামা নিতে ব্যস্ত রেখে অন্য কক্ষে হাসানের বিরুদ্ধে মামলা করার নির্দেশ দেন ডিসি। যেন কেউ কিছু বুঝতে না পারেন। পরে স্বজনরা যখন ডিসির সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তখন তিনি মামলা হয়েছে বলে তাদের জানিয়ে দেন। ডিসি ইবনে মিজান বলেন, সদর দপ্তরের চাপে তিনি মামলা নিতে বাধ্য হয়েছেন।
এ বিষয়ে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) ইবনে মিজান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ওই দিন রাত ১১টার দিকে বিষয়টি আমার নলেজে আসে। বিষয়টি আমার কাছে ডাউটফুল মনে হওয়ায় নিজে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করি। অফিসারদের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করতে বলেছি। সেখানে কোনো সাধারণ জনতা ঘটনার ভিডিও করেছে কি না-সব তথ্য-উপাত্ত নিতে বলি।
যাতে করে ঘটনার যৌক্তিক বিষয়টি আমাদের সামনে উঠে আসে। বিষয়টি নিয়ে আমরা গভীরভাবে তদন্ত করছি। এতটুক এনশিওর করছি যে রিয়্যাল ফ্যাক্টটা অবশ্যই উঠে আসবে।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) এস এম মো. নজরুল ইসলাম বলেন, কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে যেন ফাঁসানো না হয়, সে ব্যাপারে তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমারও মনে হয়েছে, হাসান ভিকটিম হচ্ছেন, তাই ডিসিকে এ বিষয়ে যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলাম। কিন্তু মামলা কেন হলো তা বুঝতে পারছি না।’
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় এসআই আবু ঈসার করা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা এ মামলায় উল্লেখ করেন, ২ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১১টায় একজন লোককে জনগণ আটক করেছে এমন খবর পান তিনি। এরপর রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে সেখানে যান। আসামি হাসানকে থানায় নিয়ে আসেন। একটি পলিথিনের প্যাকেটে ১৯৩ পিস ইয়াবা পাওয়া গেছে।
মামলায় এ-ও উল্লেখ করেন, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি পেশাদার মাদক ব্যবসায়ী। দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবা ট্যাবলেট ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় বিক্রি করে আসছেন।
তবে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, রবিবার (২ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা ৭টার দিকে হাসানকে থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। এর আগে থেকেই এসআই ঈসা সেখানে ছিলেন। তাকে মধ্যরাতে আটক করা হয়েছে, এই তথ্য সঠিক নয়।
এই মামলায় দুজনকে সাক্ষী করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে একজনের নাম মো. নাঈম। হাসানকে যে ভবনের সামনে মারধর করা হয়েছে, সেই এসকেএস স্কাই বিল্ডিংয়ের নিরাপত্তাকর্মী তিনি। ঘটনা সম্পর্কে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ভবনের সামনে অনেক লোকের ভিড় দেখেন। তবে সেখানে কী হয়েছে সেটা তিনি জানতে পারেননি।
পরে ৩ ফেব্রুয়ারি বিকেলে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার পুলিশের একটি দল তার কাছে আসে। তারা জোর করে কাগজে তার দুটি স্বাক্ষর নেয়। তিনি কোনো ইয়াবা দেখেননি। তাকে যে মামলার সাক্ষী করা হয়েছে, তা-ও জানেন না এই নিরাপত্তাকর্মী। অপর সাক্ষীর নাম সেলিম মিয়া। গাড়িচালক এই ব্যক্তিকে মামলার সাক্ষী করা হলেও তিনি ঘটনার বিষয়ে স্পষ্ট কিছুই বলতে পারেননি।
মিথ্যা তথ্য দিয়ে মামলা দেওয়ার বিষয়ে মামলার বাদী এসআই আবু ঈসা সাংবাদিকদের বলেন, তিনি ঢাকায় নতুন এসেছেন। এই শহরের কালচার সম্পর্কে কিছুই জানেন না। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাকে যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, তিনি সেভাবেই কাজ করেছেন।
এমন মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসানোর বিষয়টি পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের জানালে, নিজের অপরাধকে ঢাকতে ডিসি ইবনে মিজান দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। তিনি হাসানের স্বজন, সহকর্মী ও তার কর্মস্থলের লোকজনকে নানাভাবে হুমকি দিতে থাকেন। বিষয়টি জানাজানি হলে, ভবিষ্যতে হাসানের এই মামলায় ক্ষতি হবে বলেও জানান তিনি।
এ অভিযোগের বিষয়ে ডিসি ইবনে মিজান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এটা তো আমার কোনো ইস্যু নয়, আমি হুমকি দিতে যাব কেন। থানার টহল টিম অভিযান চালিয়ে আসামি ধরেছে। মামলাও তারা করেছে। আমি তো মামলাও রুজু করিনি। টহলেও ছিলাম না। থানা পুলিশ আমায় কোনো কিছু জানায়নি, আমি বিষয়টি জানিও না।
পরে যখন বিষয়টি জানতে পেরে আমার কাছে ডাউটফুল মনে হলো, সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত শুরু করি, এখনো তদন্ত করছি রিয়্যাল ফ্যাক্টটা বের করার জন্য।
অভিযুক্ত এসআইয়ের ঘটনাস্থলে এলাকায় ডিউটি না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, এই বিষয়গুলো আমরা খতিয়ে দেখছি। আশা করছি, রিয়্যাল ফ্যাক্টটা তদন্তে বেরিয়ে আসবে।
জানতে চাইলে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) গাজী শামীমুর রহমান বলেন, কর্মকর্তারা যা বলছেন, তিনি তা-ই করেছেন। হাসানকে আদালতে ওঠানোর পর আদালত হাসানকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। তিনি বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার শেখ সাজ্জাদ আলী ডিসি ও সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের কর্মকর্তাদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পুরো ঘটনার জন্য বারবার দুঃখ প্রকাশ করেন কমিশনার। অধীনস্থ কর্মকর্তাদের এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নিতেও বলেন তিনি। কমিশনারের দাবি, ঘটনার ব্যাপারে তাকে অন্ধকারে রেখেছিলেন উপকমিশনার।
আপনার মতামত লিখুন :