ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

সার্টিফিকেট জালিয়াতি করে ‘বড় প্রকৌশলী’ তাহসিনা!

মেহেদী হাসান খাজা
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২৫, ০৮:২১ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সার্টিফিকেট জালিয়াতি করে চাকরিতে যোগ দিয়ে ‘বড় প্রকৌশলী’ দাবি করেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের এক নারী ইঞ্জিনিয়ার। তিনি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হলেও সিভিল ইঞ্জিনিয়ার পরিচয় দিয়ে এবং কাগজপত্র জালিয়াতি করে দীর্ঘদিন ধরে এ পদে কর্মরত আছেন। 

তথ্যমতে জানা যায়, ওই নারী প্রকৌশলীর নাম তাহসিনা আক্তার। তিনি এলজিইডির গুরুত্বপূর্ণ নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের উপসহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। তিনি দীর্ঘদিন ধরে সার্টিফিকেট জালিয়াতি করে চাকরি করে আসছেন। যদিও এলজিইডির উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে জানলেও তার বিরুদ্ধে তেমন কোনো আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। 

তথ্যমতে, এলজিইডির নিয়োগ বিধিমালা-২০০৯ অনুযায়ী একজন উপসহকারী প্রকৌশলীর ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকার কথা ডিপ্লোমা ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং। কিন্তু তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রকৌশলীর যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও এমন প্রতারণা করে চাকরিতে যোগ দেন। আর তাকে এসব কাজে তাকে সহযোগিতা করেছেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের বেশ কিছু অসাধু কর্মকর্তা। 

সম্প্রতি রূপালী বাংলাদেশের কাছে প্রকৌশলী তাহসিনার বিরুদ্ধে বেশ কিছু তথ্য-প্রমাণ এসেছে। সেখানে তার জাল-জালিয়াতির বেশ কিছু তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে। সেসব তথ্য নিয়ে কাজ করে রূপালী বাংলাদেশ। এরপরই বের হয়ে আসে প্রকৌশলী তাহসিনার প্রতারণার বিভিন্ন বিষয়। 

এলজিইডির সূত্র জানায়, তাহসিনা আক্তার ১৯৯৪ সালে বরিশাল পলিটেকনিক থেকে ডিপ্লোমা ইন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করছে। তার রোল নং-১০৩১, রেজিস্ট্রেশন নং এবং ২২৪৩ সার্টিফিকেট সিরিয়াল ০০২৮৫১২। ইলেকট্রিক্যাল ডিপ্লোমা করলেও ওই সার্টিফিকেট নকল করে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে তৈরি করেন। জানা যায়, এলজিইডির প্রকৌশলী তাহসিনা আক্তার জন্মগ্রহণ করছেন ১-১১-১৯৭৭ সালে। আর ডিপ্লোমা শেষ করছে ১৯৯৪ সালে। মাত্র ১৭ বছর বয়সে কীভাবে এসএসসি এবং তিন বছরের ডিপ্লোমা শেষ করলেন তিনি- এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বিভিন্ন মহলে? অনেকেই বলছেন, তিনি জাল-জালিয়াতি এবং ওপরের কাউকে ম্যানেজ অবৈধপথে চাকরিতে যোগ দেন। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বরিশাল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের দায়িত্বশীল এক কর্মকতা জানান, তাহসিনা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার না। তার কাগজপত্র চাইলে তিনি বলেন, রোল নম্বর ও সার্টিফিকেট সিরিয়াল নম্বর দেওয়া যাবে। তা ছাড়া যে তথ্য জানতে চেয়েছেন, সেটা সঠিক না। তিনি ইলেকট্রিক্যালে পড়েছেন, সিভিলে পড়েননি।

এসব থেকে জানা যায়, এলজিইডির গুরুত্বপূর্ণ নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের উপসহকারী প্রকৌশলী তাহসিনা আক্তার ডিপ্লোমা ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সার্টিফিকেট জালিয়াতি করে চাকরি করছেন। তা ছাড়া তিনি নারী হওয়ার সুবাদে সবকিছু ম্যানেজ করে উপসহকারী প্রকৌশলীদের সিনিয়রিটি তালিকায় সিরিয়াল ৬৯৪, শিক্ষাগত যোগ্যতা ডিপ্লোমা ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পদে এগিয়ে আছেন।  

তথ্যমতে, তাহসিনার প্রতারণার ব্যাপারে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের সবাই জানলেও এখনো গুরুত্বপূর্ণ নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে কর্মরত। জানা যায়, তার মামা ছিলেন সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. লুৎফর রহমান। পতিত স্বৈরাচারের দোসর।  

অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, প্রকৌশলী তাহসিনা বরিশালের সাবেক ভান্ডারিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মাফিয়া ডন মিরাজুল ইসলামের সহযোগিতায় এবং এ প্রকল্প পরিচালক মো. সুজায়েত হোসেনের হাত দিয়ে নিয়োগ পান। তা ছাড়া প্রকল্প পরিচালক সুজায়েত হোসেনের হাত দিয়ে তিনি বিভিন্ন অকর্ম করে আসছেন। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. সুজায়েত হোসেনের মন্তব্য চাইলে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে এলজিইডির গুরুত্বপূর্ণ নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের উপসহকারী প্রকৌশলী তাহসিনা আক্তার বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই।’ সূত্র জানায়, সম্প্রতি প্রকৌশলী তাহসিনা আক্তারের বিরুদ্ধে এসব জাল-জালিয়াতির বিষয়ে একটি অভিযোগ পড়ে দুদকে। সেই অভিযোগের তথ্যমতে জানা যায়, এলজিইডিতে কর্মরত প্রকৌশলী তাহসিনা আক্তার ডিপ্লোমা ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের যে সার্টিফিকেট জালিয়াতি করে চাকরি করছেন, সেই বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান করছে। বিষয়টি দুদক গুরুত্ব সহকারে অনুসন্ধান করছে। 

এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল এক ইঞ্জিনিয়ার রূপালী বাংলাদেশকে জানান, তাহসিনা আক্তার গুরুত্বপূর্ণ নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের উপসহকারী প্রকৌশলী ডিপ্লোমা ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং দাবি করেন। তিনি জালিয়াতি করে এ সার্টিফিকেট তৈরি করে চাকরি করে আসছেন। সবাই জানলেও তার বিরুদ্ধে অদৃশ্য শক্তির ভয়ে কেউ এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। তবে বিষয়টি তদন্ত করছে দুদক ও এলজিইডির সদর দপ্তর।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়িত্বশীল এক কর্মকতা জানান, এলজিইডির গুরুত্বপূর্ণ নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের উপসহকারী প্রকৌশলী তাহসিনা আক্তারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে দুদক অনুসন্ধান ও খোঁজখবর নিচ্ছে। তিনি বলেন, তাহসিনার বিরুদ্ধে যদি অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায় তাহলে দুদক তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করবে।