রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি এখন ধ্বংসস্তূপ। ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভার্চুয়াল বক্তব্যকে কেন্দ্র করে বুধবার রাত থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত বুলডোজার দিয়ে ধানমন্ডির ওই বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। দেওয়া হয় আগুনও।
পাশাপাশি একই এলাকায় অবস্থিত শেখ হাসিনার বাসা সুধাসুধনে ভাংচুর ও আগুন দেওয়া হয়। উভয় বাড়িতে চলে লুটপাট।
শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্যের জেরে ঢাকার পাশাপাশি নোয়াখালীতে দলের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, খুলনায় শেখ বাড়ি খ্যাত শেখ হেলালের বাসা, বরিশালে আমির হোসেন আমু ও আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর বাসাও বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয় উত্তেজিত ছাত্র-জনতা। একই সঙ্গে গতকাল ভোলায় সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও কুষ্টিয়ায় মাহবুবুল আলম হানিফের বাড়িসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী নেতা ও সাবেক এমপিদের বাড়িতে ব্যাপক ভাংচর ও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।
অধিকাংশ জায়গায় পুলিশ ছিল নিষ্ক্রিয়। কিছুস্থানে সেনা সদস্যরা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও তুমুল জনরোষের মুখে তা কাজে দেয়নি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ঠিক ছয় মাসের মাথায় সাঁড়াশি হামলার এমন ঘটনা ঘটল।
ধানমন্ডি ৩২ নম্বর এখন ধ্বংসস্তূপ: ৩২ নম্বর বাড়ির বেশির ভাগ অংশই ভাঙা শেষ। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বলছেন, পুরো বাড়িটি সমতল না করা পর্যন্ত ওখান থেকে যাবেন না। গত দুই দিনে আশপাশে কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দেখা যায়নি।
ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার সময় শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ক্ষণে ক্ষণে স্লোগান দিচ্ছেন তারা। শেখ হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি করারও দাবি জানাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। গত বুধবার রাত সাড়ে ১১টায় ক্রেন ও এক্সক্যাভেটর দিয়ে এই ভাঙার কাজ শুরু হয়েছে।
ধানমন্ডি ৩২ এ গরু দিয়ে ভূরিভোজের আয়োজন করেছে বিক্ষুব্ধরা। ৩২ নম্বরের নারিকেল নিয়েও কাড়াকাড়ি হয়েছে। বুলডোজার দিয়ে বাড়ির ভেতরের একটি নারিকেল গাছ ভাঙার পর জনতা নারিকেল নিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়ায় এক নারীকে এবং কথা বলার সময় ‘আপার বাড়ি’ বলায় এক পুরুষকে গণপিটুনি দিয়েছে ছাত্র-জনতা। হামলা, ভাঙচুর ঠেকাতে পুলিশের কী উদ্যোগ ছিল এমন প্রশ্নের উত্তরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছি, আমরা চেষ্টা করেছি।
শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘ফ্যাসিবাদের’ পিতা বলে আখ্যায়িত করছেন শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, বাড়িটি পুরোপুরি ভাঙতে হবে। নাহলে ফ্যাসিবাদকে জিইয়ে রাখা হবে। এটি ভাঙার মাধ্যমে আমরা সবাইকে ফ্যাসিবাদের পরিণতি উপলব্ধি করাতে পারব। আমাদের বিপ্লব যাতে বিঘ্নিত না হয়, যারা শহিদ হয়েছেন তাদের রক্ত যাতে বৃথা না হয়। সেজন্য এই বাড়িটি ভাঙা জরুরি। দেশ, জাতি ও ধর্মের বিরুদ্ধে যারা কাজ করেন, তাদের পরিণতি কী?
এই বাড়িটি দেখেই সবাই বুঝতে পারবে। এ থেকে সবাই শিক্ষা নেবে, ভবিষ্যতে দেশ এবং ধর্মের বিরুদ্ধে কেউ কাজ করলে তার সম্ভাব্য পরিণতি কী হতে পারে তা এখান থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। এখানে স্বৈরাচারের চিহ্ন মুছে দিতে এসেছি। তাদের কোনো চিহ্ন রাখা যাবে না।
ভারতে পলাতক থাকাবস্থায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী স্বৈরাচার শেখ হাসিনা দলটির ফেসবুক পেজে বক্তব্য প্রচারের প্রতিবাদে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটিতে বুধবার রাত থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত ভাঙচুর চালিয়েছে। ইতিমধ্যে পুরো বাড়িটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বাড়িটির অবশিষ্টাংশও ভাঙার কাজ চলছে।
সর্বশেষ গতকাল রাত ১০টা পর্যন্ত দেখা গেছে, ৩২ নম্বরের বাড়িটি পুরোটা ভেঙে সমতল করার কাজ চলছে। ছাত্র-জনতার দাবি, এখানে বাড়িটির কোনো চিহ্ন রাখা হবে না। গতকাল সকালে ক্রেন ও এক্সক্যাভেটর দিয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িটির অবশিষ্ট অংশ ভাঙতে দেখা গেছে।
গতকাল ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়ায় এক মধ্যবয়সী নারীসহ দুজনকে মারধর করেছেন ছাত্র-জনতা। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে শোরগোল চললেও আশপাশের এলাকা নীরব দেখা গেছে। বাসিন্দারা অন্যত্র চলে গেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাড়িটি সুরক্ষায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সামাজিক মাধ্যমে সরব হলেও ঘটনাস্থলে কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
এমনকি স্থানীয় লোকজনও এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করছেন। হাসিনা সরকারের পতনের পর সুসজ্জিত ও সুরক্ষিত বাড়িটিতে গেল ৫ আগস্ট অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। বুধবার ব্যাপক ভাঙচুরের পর ভেতরে পোড়ার মতো যা কিছু আছে, তাতে ফের আগুন দেওয়া হয়।
এদিকে, ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ভাঙচুরের ঘটনা অনভিপ্রেত ও অনাকাক্সিক্ষত উল্লেখ করে অন্তর্বর্তী সরকার বলেছে, পলাতক অবস্থায় ভারতে বসে জুলাই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্যের কারণে জনমনে গভীর ক্রোধের সৃষ্টি হয়েছে যার বহিঃপ্রকাশ এটি।
ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি অর্ধেকের বেশি গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর ভাঙা কার্যক্রম কর্মকাণ্ড কয়েক ঘণ্টা বন্ধ ছিল। এর মধ্যে বাড়িতে থাকা বই, বিভিন্ন আসবাবপত্র, লোহা, ভাঙা গ্রিল, কাঠÑ যে যার মতো যা পারছে নিয়ে যায়। রাতে একটি ক্রেন ও দুটি এক্সক্যাভেটর দিয়ে ওই বাড়ি ভাঙা শুরু হলেও সকালে দেখা যায় একটি এক্সক্যাভেটর। যান্ত্রিক ত্রুটির কথা বলে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় সেটিও সরিয়ে নেওয়া হয়।
এদিকে ভাঙা দুই ভবন এবং পেছনের বর্ধিত জাদুঘর ভবন থেকে রড কেটে নিতে দেখা গেছে নিম্ন আয়ের মানুষদের। হাতুড়ি, শাবল, লোহা কাটার ব্লেড দিয়ে যে যার মতো কেটে সরিয়ে নিচ্ছেন।
সুধাসদনেও লুটপাট: গত বুধবার রাত পৌনে ১১টার দিকে আগুন দেওয়া হয় ধানমন্ডি ৫ এ শেখ হাসিনার বাসভবন সুধাসদনে।
বুধবার রাতে দেওয়া আগুন বৃহস্পতিবার সকালেও ভবনটির কোথাও কোথাও জ্বলতে দেখা গেছে। দুপুরে বাড়িটির ভেতরে প্রচণ্ড তাপের মধ্যেই সেখান থেকেও যে যার মতো রড, সোফা, চেয়ার, টেবিলসহ আধপোড়া বিভিন্ন আসবাব, এসি, ফ্রিজসহ বিভিন্ন জিনিসপত্রের ভাঙা অংশ, তার সরিয়ে নিতে দেখা গেছে লোকজনকে।
শেখ হাসিনার স্বামী এম এ ওয়াজেদ মিয়ার ডাক নাম ছিল সুধা মিয়া। তার নামেই এ বাড়ির নামকরণ। গত তত্ত্বাবধায়ক আমলে শেখ হাসিনা এই বাড়িতে কিছুদিন ছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচন এখান থেকেই করেন তিনি। সেই নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি রাষ্ট্রীয় বাসভবনে থেকেছেন। এই বাড়িতে কিছুদিন আওয়ামী লীগের কিছু অফিস ছিল।
পরে সেটি তালা মারাই থাকত। বিভিন্ন দিবসে এই বাড়িতে মাঝেমধ্যে এসেছেন শেখ হাসিনা। তার পুরো আমলজুড়ে এ বাড়ির নিরাপত্তায় নিরাপত্তা বাহিনীর প্রচুর সদস্য মোতায়েন থাকতেন।
গত বুধবার রাত ৯টায় শাহবাগে জড়ো হয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন ছাত্র-জনতার বিশাল এক মিছিল। রাত আটটার আগেই ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বিভিন্ন এলাকা থেকে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা জড়ো হতে থাকেন। তারা সেখানে বিক্ষোভ করতে থাকেন। রাত ৮টার দিকে বিক্ষোভকারীরা শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর শুরু করেন। তারা বাড়ির সামনে শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরালও ভাঙচুর করেন।
বুুধবার রাত ৮টা ৪০ মিনিটে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ভবনের তৃতীয় তলার একটি জায়গায় আগুন জ্বলতে দেখা যায়। পরে আগুনের মাত্রা আরও বাড়ে। রাত ৯টার দিকে লাঠিসোঁটা ও শাবল দিয়ে বাড়ির সীমানাপ্রাচীর ভাঙা শুরু হয়। কিছুক্ষণ পর সেনাবাহিনীর একটি দল ৩২ নম্বর বাড়িটির সামনে যায়। এ সময় বিক্ষোভকারীরা স্লোগান দেওয়া শুরু করেন।
একপর্যায়ে সেনাবাহিনীর দলটি সেখান থেকে মিরপুর রোডের দিকে চলে যায়। রাত ১০টার দিকে বিক্ষোভকারীরা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটির বিভিন্ন অংশ ভাঙার চেষ্টা করেন। আর তখন বাড়িটি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে সামনের সড়কে বিক্ষোভ চলছিল। অন্যদিকে বাড়িটির কাছেই ধানমন্ডি লেকের পাশে খোলা জায়গায় প্রজেক্টর বসিয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে প্রামাণ্যচিত্রের প্রদর্শনী করা হচ্ছিল।
বুধবার রাত সাড়ে ১০টার পর ধানমন্ডি ৫-এ অবস্থিত শেখ হাসিনার বাসভবন সুধা সদনে আগুন দেওয়া হয়। পরে আগুন ভবনটিতে ছড়িয়ে পড়ে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে আগুনের খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। তবে ‘নিরাপত্তা না থাকায়’ তারা আগুন নেভাতে যায়নি। রাত ১১টার দিকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে একটি ক্রেন নিয়ে আসেন বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। পরে আনা হয় একটি এক্সকাভেটর। মধ্যরাতে এই ভারী যন্ত্র দিয়ে ভবন ভাঙা শুরু হয়। রাত দুইটা নাগাদ বাড়িটির বড় অংশ ভাঙা শেষ হয়। ভবন ভাঙার কাজ চলার মধ্যে বিপুলসংখ্যক বিক্ষোভকারী স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদ, মুজিববাদ ও আওয়ামী লীগবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছিলেন। রাতভর ভবন ভাঙার কাজ চলে।
আ.লীগ সন্দেহে নারীসহ দুজনকে গণপিটুনি: বাড়ি ভাঙার মধ্যেই গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে উৎসুক জনতার ভিড়ে আওয়ামী লীগ সন্দেহে এক নারীসহ দুজনকে গণপিটুনি দিয়েছে ছাত্র-জনতা।
প্রত্যক্ষ্যদর্শীরা জানিয়েছেন, ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়ায় এক নারীকে এবং কথা বলার সময় ‘আপার বাড়ি’ বলায় এক পুরুষের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়।
একপর্যায়ে তাদের মারতে মারতে ধানমন্ডি ৩২ থেকে প্রধান সড়কে নিয়ে যায়। পরে এক ফটোসাংবাদিকসহ কিছু লোকজন তাদের রিকশায় উঠিয়ে দেন। এ সময় ঘটনাস্থলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্যকে দেখা যায়নি।
ডিএমপি কমিশনার বললেন, ‘চেষ্টা করেছি’: ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ঠেকাতে পুলিশের কী উদ্যোগ ছিল এমন প্রশ্নের উত্তরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী উত্তরে বলেন, আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছি, আমরা চেষ্টা করেছি। গভীর রাত পর্যন্ত আমি নিজে সেখানে ছিলাম।
গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার উত্তরায় কাউন্টার ও ই-টিকেটিংয়ের মাধ্যমে বাস সেবার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসে ধানমন্ডির ঘটনা নিয়ে সাংবাদিকের প্রশ্নের মুখে পড়েন।
ধানমন্ডি ৩২-এ গরু দিয়ে ভূরিভোজের আয়োজন: রাজধানীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির সামনে একটি গরু জবাই করা হয়েছে। জুলাই ঐক্যজোট নামের একটি সংগঠন গতকাল বিকেল সোয়া ৪টার দিকে গরুটি জবাই করে। অনুষ্ঠিত হয় ভূরিভোজের আয়োজন।
শেখ মুজিবুর রহমানের পুরোনো বাসভবন ভেঙে সেখানে একটি গরু আনা হয়। গতকাল বিকেল ৩টার দিকে, ধানমন্ডি ৩২-এ গরুটি আনা হয়। গরু আনার সময় উপস্থিত জনগণ শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে নানা স্লোগান দিতে থাকে।
নোয়াখালীতে ওবায়দুল কাদেরের বাড়িতে ভাংচুর-আগুন: আমাদের নোয়াখালী প্রতিনিধি মো. আবদুল্যাহ চৌধুরী জানান, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের গ্রামের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে উপজেলার বসুরহাট পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের রাজাপুর গ্রামের বাড়িটির দ্বিতল ভবন ভাঙা শুরু হয়।
স্থানীয়রা জানায়, দুপুর পৌনে ১টার দিকে উপজেলার বসুরহাট বাজার থেকে মিছিল বের করেন ছাত্র-জনতা। মিছিলটি বসুরহাট বাসস্ট্যান্ড হয়ে কাদেরের বাড়িতে গিয়ে শেষ হয়। পরে সেখানে থাকা ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই বসুরহাট পৌরসভার সাবেক মেয়র আব্দুল কাদের মির্জার দোতালা ভবন হাতুড়ি, শাবল দিয়ে ভাঙা হয়। পরে তার ছোট ভাই শাহাদাত মির্জার ভবনও ভাঙচুর করা হয়।
এর আগে, গত ৫ আগস্ট বিকেলে ওই বাড়ির পাঁচটি বসতঘর ও দুটি গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতাকে বিভিন্ন আসবাবপত্র নিয়ে যেতে দেখা যায়।
খুলনায় শেখ হেলাল ও জুয়েলের বুলডোজার অভিযান: সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচার খুলনার বাড়ি ‘শেখ বাড়ি’ ভেঙে দিয়েছে উত্তেজিত ছাত্র-জনতা।
নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের ফেসবুক পেজে শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদে গতকাল বুধবার রাত ৯টার দিকে নগরীতে বিক্ষোভ মিছিল করে বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এর আগে রাত পৌনে ৯টায় শেখ বাড়ির আস্তানা গুঁড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
ঘটনাস্থলে গিয়ে রাত ৯টার দিকে মিছিলটি নগরীর শেরে বাংলা রোডস্থ ‘শেখ বাড়ি’র সামনে পৌঁছায়। সেখানে উত্তেজিত ছাত্র-জনতা ভাঙচুর করে। পরে বুলডোজার এনে বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
বরিশালে আমু ও হাসানাতের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে: আমাদের ব্যুরো প্রধান হাসিবুল ইসলাম জানান, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আক্রোশমূলক বক্তব্যের প্রতিবাদে বুধবার রাতে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর বাড়িটিতে ব্যাপক ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার রেশ বরিশালেও ছড়িয়ে পড়ে।
আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কেন্ত্রীয় নেতা আমির হোসেন আমুর বরিশালের বগুড়া রোডের হোয়াইট হাউস ও শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ’র কালিবাড়ির সেরনিয়াবাত ভবনে হামলা-ভাঙচুর-লুটপাট শেষে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। অবশ্য এই বাড়ি দুটিতে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরেও হামলা-ভাঙচুর চালানো হয়েছিল।
ঝালকাঠিতেও আমুর বাসা ও তার স্ত্রীর নামে মেডিকেল ভাংচুর: অন্যদিকে আমাদের ঝালকাঠি প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গতকাল সকালে ঝালকাঠি শিল্পকলা একাডেমির সামনে সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমুর স্ত্রী বেগম ফিরোজা আমু হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজে হামলা ও ভাঙচুর চালায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মী ও জনতা। এরপর তারা আমুর পোড়া বাসভবনে গিয়ে ভাঙচুর শুরু করে।
ভোলায় তোফায়েল আহমেদের বাড়িতে ভাংচুর-আগুন: আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের ভোলা শহরের বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। বুধবার রাতে ভোলা শহরের গাজীপুর রোডের ‘প্রিয় কুটির’ নামের বাসভবনে এই ঘটনা ঘটে।
সিলেটে শেখ মুজিবের ম্যুরাল ভাংচুর: সিলেট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে স্থাপিত শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
বুধবার রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা বুলডোজার দিয়ে ম্যুরালটি গুঁড়িয়ে দেয়। এর আগে রাত সাড়ে ৯টার দিকে বন্দরবাজার এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা। পরে তারা বিক্ষোভ মিছিল বের করে। এরপর বুলডোজার নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে যান ছাত্ররা।
এ সময় জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের প্রধান ফটক বন্ধ ছিল। পরে তারা তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে থাকা শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরালটি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
কুষ্টিয়ায় হানিফের হামলা-ভাংচুর : আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কুষ্টিয়া-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাহাবুল আলম হানিফের বাড়িতে আবারও হামলা চালিয়েছেন ছাত্র-জনতা।
বুধবার রাত ৯টার দিকে কুষ্টিয়া শহরে একতারা মোড় এবং সরকারি কলেজ থেকে আনন্দ মিছিল বের করে ছাত্র-জনতা। আনন্দ মিছিলটি হানিফের বাড়ির সামনে এসে বাড়িতে ভাঙচুর চালায়। এ সময় বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় বাড়ির সামনের অংশ।
নাটোরে সাবেক এমপি শিমুলের বাড়িতে আগুন: নাটোর সদর আসনের সাবেক এমপি শফিকুল ইসলাম শিমুলের বাড়ি এবং পরিত্যক্ত একটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা। বুধবার রাত ১২টার দিকে শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে জড়ো হতে থাকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। পরে তারা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শহরের কান্দিভিটা এলাকায় সাবেক এমপি শফিকুল ইসলাম শিমুলের বাড়ির দিকে রওনা হয়। পথে জেলা আওয়ামী লীগের পরিত্যক্ত কার্যালয় ও নাটোর পৌরসভার সাবেক মেয়র উমা চৌধুরী জলির বাড়িতে হামলা চালায়।
পিরোজপুরে সাবেক এমপি আওয়ালের বাড়িতে হামলা: পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম এ আউয়াল ও তাঁর ভাই পিরোজপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হাবিবুর রহমান মালেকের বাড়ি ভাঙচুরের পর আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে নির্মিত শেখ মুজিব এবং শেখ হাসিনার গ্রাফিতি মুছে ফেলা ও মুর্যাল ভেঙে ফেলেছেন শিক্ষার্থীরা। বুধবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বটতলায় জমায়েত হয়ে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন।
এ সময় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার গ্রাফিতি ও মুর্যাল ভাঙতে শুরু করেন।
ময়মনসিংহ: ময়মনসিংহ নগরের সার্কিট হাউস মাঠ সংলগ্ন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল ভাঙচুর করা হয়েছে।
বুধবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে হাতুড়ি-শাবল নিয়ে ম্যুরাল ভাঙচুর করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ময়মনসিংহ জেলা কমিটির সদস্য সচিব আলী হোসেন, জেলা কমিটির মুখপাত্র ফয়সাল ফারনিম, মহানগর কমিটির সদস্য সচিব আল নুর মো. আয়াস, মহানগর কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক নাফিউস রোহানসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ১৫ থেকে ২০ জন নেতা-কর্মী।
চুয়াডাঙ্গা: চুয়াডাঙ্গায় জেলা আওয়ামী লীগ অফিস ও শহরের বিভিন্ন স্থানে থাকা শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল ভেঙে দিয়েছে ছাত্র-জনতা। বুধবার রাতে মিছিল নিয়ে এসে বুলডোজার দিয়ে এসব স্থাপনা ভেঙে ফেলা হয়।
রাবিতে চার হল ও এক স্কুলের নামফলক ভেঙে নতুন নামকরণ: আমাদের রাবি প্রতিনিধি জানান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) চারটি আবাসিক হল ও শেখ রাসেল মডেল স্কুলের নামফলক ভেঙে নতুন নামকরণ করা হয়েছে। বুধবার রাতে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা এই নামকরণ করেন।
এদিন রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা চত্ত্বর থেকে এই প্রতিবাদ কর্মসূচি শুরু হয়ে রাত ১১টায় শেষ হয়। নামফলক ভাঙচুর করা হলগুলো হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা হল, নির্মাণাধীন হল এ এইচ এম কামারুজ্জামান হল ও শেখ হাসিনা হল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অধীন শেখ রাসেল মডেল স্কুল।
বেরোবিতে হল ও ম্যুরালের নাম পরিবর্তন: রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) শেখ পরিবারের নামে থাকা দুই হল ও ম্যুরালের নাম ফলক ভেঙ্গে ফেলেছেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। বুধবার রাত ১০টায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের নাম পরিবর্তন করে বিজয় ২৪ এবং বঙ্গবন্ধু ম্যুরালের নাম মুক্ত মঞ্চ দেন শিক্ষার্থীরা।
টাঙ্গাইলে আওয়ামী লীগের কার্যালয় তছনছ: টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় গুঁড়িয়ে দিয়েছে ছাত্র-জনতা।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টার দিকে শহরের মেইনরোডে অবস্থিত আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ভেক্যু দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়। এতে ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
আপনার মতামত লিখুন :