জনপ্রত্যাশিত শিক্ষা, সেবা ও সুরক্ষা নিয়ে কাজ করছে সরকার। সেবার গুণমান বাড়িয়ে টেকসই উন্নয়নে দেশের ১৮টি খাতে কৌশলগত সংস্কার করা হবে। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণ করে বৈষম্যহীন উন্নয়নে কাজ করতে সরকারকে বিশ্লেষণধর্মী বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরেন ট্যাক্সফোর্স বিশেষজ্ঞরা।
সরকারে গঠিত টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে ‘ক্রিমিনাল ইনস্টিটিউট ব্যাংক’ খাতের শুদ্ধাচার ও সুরক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অর্থনীতির সংবেদনশীল খাত শেয়ার বাজারে উন্নয়ন ঘটানো, নতুন বিনিয়োগ ব্যবস্থাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে ঢাকায় শিক্ষার্থীরা আন্দোলন অব্যাহত রাখলে নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় দিতে সরকারকে নিরুৎসাহিত করেছে টাক্সফোর্স কমিটি।
বৈষম্যহীন টেকসই অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণের লক্ষ্যে প্রতিবেদনে তুলে ধরে গঠিত টাস্কফোর্স। গত বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়।
অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ টাস্কফোর্স কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষার মানোন্নয়নে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কমাতে হবে। একইসঙ্গে রাজনীতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া অনগ্রসর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একীভূত করতে হবে।
সামাজিক সুরক্ষার খাতগুলোকে নীতিগত ও আর্থিক সহায়তা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। সুস্বাস্থ্যের বিকাশ ও সেবার মানোন্নয়ে পিএসসির আওতায় নেওয়ার চিন্তা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে কোনো উন্নতি করতে পারেনি বাংলাদেশ বিমান। ‘একটি অথর্ব প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে দুই ভাগ করা হবে। একটি অংশ বিদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান দিয়ে পরিচালনা এবং একটি দেশের নির্দিষ্ট জনবল দিয়ে পরিচালনা করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে দেশীয় বিমান কোম্পানিটি মুনাফা করতে ব্যর্থ হলে ছাঁটাই করা হবে।
‘ক্রিমিনাল ইনস্টিটিউট ব্যাংক’ খাতের শুদ্ধাচার ও সুরক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিগ প্রজেক্টে প্রায় সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার তছরুপ করা হয়েছে। যার মূলে অর্থনীতিক সমীক্ষা প্রতিবেদন। সঠিকভাবে না হওয়ায় বিপুল পরিমাণ অর্থ তছরুপ হয়েছে। অর্থনীতিক সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে তালিকাভুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের বিশেষ অনুদান এবং শাস্তির ব্যবস্থাও রাখার বিধান থাকবে।
জ্বালানি খাতের দৈন্য কমাতে নাবায়নযোগ্য জ্বালানি দিতে ঝুঁকছে সরকার। একই সঙ্গে নতুন গ্যাসের অনুসন্ধান করছে। টাক্সফোর্সে কৌশলপত্র পুনর্নির্ধারণী বৈঠকে ১৮টি খাতের বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে।
সারা দেশে তীব্র গ্যাসের সংকট চলছে। যার বিরূপ প্রভাব পড়েছে দেশের কৃষিক্ষেত্র ও শিল্পাঞ্চলগুলোতে। বিগত সরকার সেই প্রভাব মোকাবিলায় তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) নির্ভরতায় ছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকার সেই গ্যাসনির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে নবায়নযোগ্য জ¦ালানিতে ফিরছে সরকার। তাই নতুন করে ৪০টি বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নিতে যাচ্ছে। নতুন প্রকল্পগুলোর মধ্যমে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ মিলবে। যদিও ২০২৫ সালে দেশের মোট জ¦ালানির ১০ শতাংশ হওয়ার কথা থাকলেও মাত্র তিন শতাংশ অর্জন করেছে। বিনিয়োগ অনাগ্রহকে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদের নেতৃত্বে গত ১১ সেপ্টেম্বর এই টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। পরিকল্পনা কমিমনে কমিটির সংবাদ সম্মেলনে গত সোমবার উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা ড. আখতার মাহমুদ, অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান, কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েটের গবেষণা বিভাগের সাবেক প্রধান ড. আব্দুর রাজ্জাক, বুয়েটের শিক্ষক ড. শামসুল হক, ঢাকা বিশ্ব^বিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ড. রুমানা হকসহ অনেকে।
অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, মেগা প্রজেক্টগুলোর অনেক অর্থ ভিন্ন খাতে চলে গেছে। প্রায় সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্তভাবে নেওয়া হয়েছে। ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্ট ভালো না হওয়ায় এই অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হয়েছে। একটি ভালো রিপোর্ট মানে কোম্পানির চূড়ান্ত প্রতিবেদন। কত দিনে মুনাফা করবে এবং দুর্বলতা কোথায় তাও উঠে আসে। তাই এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনা জরুরি। তাদের সুবিধা দেওয়া এবং শাস্তির আওতায় নিতে হবে।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ বিমানকে ‘একটি অথর্ব প্রতিষ্ঠান’ আখ্যায়িত করে এটিকে দুই ভাগ করার কথাও বলেন উপদেষ্টা। ব্যাংক খাতের সংস্কার নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে গবেষকরা বলেন, সাবেক সরকারের আমলে বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়েছে। পরিবারতন্ত্রকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আরও দুর্বল হয়। অন্যদিকে সরকারি ব্যাংকগুলো রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালনা পর্ষদ নিয়োগ দেওয়া হয় এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলো পরিবারকেন্দ্রিক গড়ে উঠেছে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক আরও দুর্বল হওয়া নতুুন ব্যাংকের লাইসেন্স প্রদান, টাকা লোপাটের সংস্কৃতি বাড়ে। এখানে বিএফআইইউ ছিল অকার্যকর।
সুপারিশ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, দ্বৈত্য শাষন ব্যবস্থা রহিত করা, দেউলিয়া আইনের সংশোধন এবং ব্যাংকগুলোর ওয়েবসাইটে তথ্য না দেওয়ার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের দেওয়া চলতি অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ রাখা অর্থের ৫৩ শতাংশই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সরকারের জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রের (এনএসএসএস) সঙ্গে এই খাতগুলো মিলছে না।
সামাজিক সুরক্ষার নামে কিছু খাতে বরাদ্দের আরও কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, যেমন জয়িতা ফাউন্ডেশনের ভবন নির্মাণ, ভূমিকম্পসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় যন্ত্রপাতি কেনা, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কল্যাণে অনুদান, ইলিশ মাছ সম্পদ উন্নয়নে প্রযুক্তি কর্মসূচি, বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড, গ্রামীণ যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়ন, বিনা মূল্যে বই ছাপা ও বিতরণের মতো খরচও সামাজিক সুরক্ষা খাতের খরচ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
অর্থাৎ সামাজিক সুরক্ষা বাজেটের নামে বরাদ্দ রাখা হলেও এসব টাকা শেষ পর্যন্ত দরিদ্র ও আর্থিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী পায় না। ফলে তাদের দারিদ্র্য অবস্থারও উন্নতি হয় না।
আপনার মতামত লিখুন :