ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

অভিযান ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরু

শহিদুল ইসলাম রাজী
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২৫, ১২:১৮ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার পাশাপাশি সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে কঠোর সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি।

প্রায়ই প্রকাশ্যে চলছে ছিনতাই-ডাকাতি, হত্যার ঘটনা। ব্যবসায়ীদের হুমকি প্রদান ও চাঁদার জন্য প্রকাশ্যে কোপানোর মতো ঘটনা ঘটছে। মব জাস্টিসের নামে ভাঙচুর-হামলা ও সংঘর্ষ শুরু হয়েছে গত কয়েকদিন ধরে। গণপিটুনিতে হতাহতের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে ঘটে চলছে।

চলতি সময়ে গণপিটুনির সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় জনমনে নিরাপত্তার বিষয়টি প্রশ্নাতীতভাবে ভাবিয়ে তুলেছে।

ফলে আতঙ্ক নিয়ে চলাফেরা করছে সাধারণ মানুষ। গত শুক্রবার রাতে গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর সন্ত্রাসী আক্রমণের ঘটনায় নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে সরকারকে।

এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ও সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে যৌথ বাহিনীর সমন্বয়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ অভিযান শুরু করেছে সরকার। 

স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় গতকাল এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ১৬ জন, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) আওতাধীন থানাগুলোতে ২০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

মোহাম্মদপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে ‘গোল্ডেন গ্যাং’ লিডার রাকিবসহ ১৫ জনকে আটক করেছে সেনাবাহিনী। এ ছাড়াও শনিবার মধ্যরাতে দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে একযোগে অভিযান চালিয়েছে যৌথ বাহিনী।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। দেশে তৈরি হয় অরাজক পরিস্থিতি।

আন্দোলনে অনেক থানা ও পুলিশ ফাঁড়িতে ভাংচুর ও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। লুট করা হয় পুলিশের অস্ত্র-গোলাবারুদ। আত্মগোপনে চলে যান ক্ষমতাচ্যুত সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-এমপিসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগের নেতারা।

পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, লুট করা হয় পাঁচ হাজার ৮২৯টি বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ও ছয় লাখ ছয় হাজার ৭৪২টি গুলি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষায় গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে সারা দেশে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ অভিযানের ঘোষণা দেয়।

শুরু হয় অভিযান। তবে পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনা থেকে লুট অস্ত্রের মধ্যে এক হাজার ৩৯২ এবং ৩ লাখ ৯১ হাজার ৪৩৮ রাউন্ড গোলাবারুদ এখনো উদ্ধার হয়নি বলে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে।

অধরা রয়েছে জেল ভেঙে পলাতক ৭০০ অপরাধী। গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের শুরুতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যতটা খারাপ ছিল, পর্যায়ক্রমে তার চেয়ে অনেকটা ভালো হতে শুরু করে। ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে পুলিশ। পরিস্থিতির উন্নয়নে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা।

নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। তবে এখনো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। এর মধ্যে আবার হঠাৎ করে গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ-ভাঙচুরে নড়েচড়ে বসেছে সরকার।

গাজীপুরে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও মারধরের ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সারা দেশে ফের যৌথ বাহিনীর অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। 

গতকাল শনিবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর (অব.) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সমন্বয় সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘শুক্রবার রাতে গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর সন্ত্রাসী আক্রমণের ঘটনায় গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সমন্বয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। 

সভায় সংশ্লিষ্ট এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে ও সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে যৌথ বাহিনীর সমন্বয়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ পরিচালনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।

গতকাল থেকেই গাজীপুর এলাকাসহ সারা দেশে এই অভিযান শুরু হবে।
‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’-এর বিষয়ে আজ (রোববার) প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে বিস্তারিত জানানো হবে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়োজিত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বকস চৌধুরী, বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক, র‌্যাব, বিজিবি, আনসার, এসবি, সিআইডিসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের প্রধানেরা উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে গত ৩ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় নিরাপত্তা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

এতে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য একটি কমান্ড সেন্টার গঠনের নির্দেশ দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

তিনি বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে সর্বোচ্চ আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। আমাদের অবশ্যই একটি কমান্ড সেন্টার বা কমান্ড সদর দপ্তর স্থাপন করতে হবে, যা পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করবে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নতুন কমান্ড কাঠামো ‘দক্ষতা ও নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে’ দেশের সব বাহিনী ও থানা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করবে।

জানা গেছে, গতকাল শুক্রবার রাতে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ধীরাশ্রম এলাকায় সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম. মোজাম্মেল হকের বাড়িতে লুটপাটের খবর পেয়ে ছাত্ররা তা বন্ধ করতে গিয়ে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন।

এতে অন্তত ১৫ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এর প্রতিবাদে গতকাল গাজীপুর মহানগরীর রাজবাড়ীতে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ সমাবেশ করে ছাত্র-জনতা। ছাত্রদের হামলার ঘটনায় গতকাল সন্ধ্যায় এ খবর লেখা পর্যন্ত ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন গাজীপুর মহানগর পুলিশের কমিশনার ড. নাজমুল করীম খান।

গতকাল শনিবার সকালে পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে ফরিদপুরের বোয়ালমারীর চৌরাস্তায় অবস্থিত ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতিস্তম্ভ’ এক্সকাভেটর দিয়ে ভেঙে দিয়েছেন বিক্ষুব্ধ লোকজন।

এর আগে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বাড়ি, শেখ মুজিবের ম্যুরাল এবং মুজিব পরিবারের সদস্যদের নামসম্বলিত ফলক ভাঙচুরের ঘটনায় ঘটে। এতে দেশব্যাপী জনমনে উদ্বোগ, আতঙ্ক বিরাজ করে।

এদিকে এ ধরনের ঘটনা উসকে দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে দায়ী করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। আর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তাকেও দায়ী করেছেন কেউ কেউ।

দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে ভবিষ্যতে গণতন্ত্রের পথে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া উত্তরণের জন্য আমাদের বাধা আসতে পারে।

এ সময় তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আপনারা শক্ত হাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করুন। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি যাতে না হয় এবং এই ফাঁকে যাতে কথিত ফ্যাসিবাদের দোসররা দেশে এবং বিদেশে কোনো রকমের ষড়যন্ত্র করার সুযোগ না পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখুন।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর সাংবাদিকদের বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখার জন্য সারা দেশে অপরাধের হটস্পট চিহ্নিত করে সেই জায়গাগুলোয় আলাদা ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি লক্ষ্যে এরই মধ্যে অভিযান শুরু করেছে যৌথবাহিনী। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ডিবির ৪২টি টিম নিয়মিত কাজ করছে। ন্যূনতম ২০টি টিম রাতে পেট্রোলিংয়ের কাজ করছে। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে অভিযানের জন্য স্পেশাল টিম রয়েছে।

ধরপাকড় শুরু: স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ও সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে যৌথ বাহিনীর সমন্বয়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরপরই দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান শুরু করেছে যৌথ বাহিনী।

গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ ছাড়া চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন থানা এলাকায় আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

গত ২৪ ঘণ্টা চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) আওতাধীন থানাগুলোতে ২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সিএমপির জনসংযোগ বিভাগ থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, আসামিদের সিএমপির বিভিন্ন থানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘটনায় দায়ের করা মামলা এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়ের হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে।

এ ছাড়া রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে ‘গোল্ডেন গ্যাং’ লিডার রাকিবসহ ১৫ জনকে আটক করেছে সেনাবাহিনী।

এ সময় তাদের কাছ থেকে দেশীয় অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করা হয়।

সেনাবাহিনী জানায়, সম্প্রতি গ্যাংটির লিডার গোল্ডেন রাকিবের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের একটি সিসিটিভি ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। পরে ঢাকা উদ্যান এলাকার একটি রিকশা গ্যারেজে অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করা হয়।

এরপর জিজ্ঞাসাবাদে রাকিব গ্যাংয়ের অন্য সদস্যদের তথ্য দেয়। পরে তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী অপর সদস্যদের আটক করা হয়।