দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর এবং আগুন দেওয়াসহ লুটপাটের অভিযোগ মিলছে।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতা দেওয়াকে কেন্দ্র করে গত বুধবার রাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। একই রাতে ধানমন্ডির সূধাসদনসহ ঢাকার বাইরে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার বাড়িঘরে ব্যাপক ভাংচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনায় জনমনে উদ্বেগ দেখা দেয়।
আইন হাতে তুলে নিয়ে এমন মবজাস্টিস কোনোভাবেই কাম্য নয় বলছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলাম, আমার বাংলাদেশ (এবি পার্টি), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলনসহ বেশ কয়েক দলের নেতারা। বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনোকিছুই যেন সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই বলেও মনে করছেন রাজনীতিবিদরা।
তাদের মতে, চলমান ঘটনা নিয়ে উদ্বিগ্ন সাধারণ মানুষ, নতুনভাবে ভুগছেন পুরোনো আতঙ্কে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক গোলাম রাব্বানী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বর্তমানে সারা দেশে যে পরিস্থিতি তা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় কোনোকিছুতেই এই সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। যেটা কোনোভাবেই আমাদের জন্য স্বস্তিদায়ক নয়।
আমি জানি না, আমরা কোন দিকে আগাচ্ছি। যা হচ্ছে তা পুরোপুরিভাবেই এই সরকারের ব্যর্থতার ফল।
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকার কেন এগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন না বা তাদের মোটিভ কি, এটাও স্পষ্ট হওয়া উচিত।
বালাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় হামলা-ভাঙচুরের জন্য দায় অন্তর্বর্তী সরকারকে নিতে হবে।
দেশে নানা ধরনের খেলা চলছে। দেশ ও জাতির ওপর যে আক্রমণ আসছে, শুধু বুর্জুয়া দলের ওপর নির্ভর করে সেই আক্রমণ মোকাবিলা করা যাবে না। গণঅভ্যুত্থানের অর্জন কোনো গোষ্ঠীর একক অর্জন নয়। একটা কিছু বললেই মব তৈরি করবে। এটা কোনোভাবেই জাতির জন্য শুভকর ইঙ্গিত নয়।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, গত কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বাসা-বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও আগুনসহ যেসব অনাকাক্সিক্ষত কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে তা বিবেক ও দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে সমর্থনযোগ্য নয়।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামও এসব ঘটনাকে সমর্থন করে না। কারণ, আমরা মনে করি, এ ঘরনের ঘটনা যা মানুষের নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলে সেসব কর্মকাণ্ডে কোনোভাবেই কোনো দায়িত্বশীল নাগরিক সম্পৃক্ত থাকতে পারে না। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া যাবে না।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না জানান, আমরা দেখছি, দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘরে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার যে ঘটনা ঘটছে সেখানে বর্তমান সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।
মব জাস্টিসের নামে এ ধরনের ঘটনা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িসহ সারা দেশে বাড়িঘর ভাঙচুর, আগুনের ঘটনা ঘটছে। এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। একটি দেশ কখনোই খালি আবেগের ওপর ভর করে চলতে পারে না।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক বলেন, দেশের চলমান যে পরিস্থিতি সেখানে দেশপ্রেমিক সব জনগণকে যেকোনো মূল্যে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষা করা সব দেশপ্রেমিক জনগণের দায়িত্ব।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ বা বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ দেশের কোনো দায়িত্বশীল মহল সহিংস আন্দোলনের পক্ষে নয়।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরসহ সারা দেশে বিভিন্ন স্থানে যে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে তা কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত নয়।
একইসঙ্গে, দেশে একটি সরকার থাকা অবস্থায় এ রকম কর্মকাণ্ড গ্রহণযোগ্য নয় এবং সরকারের অস্তিত্বকেই তা প্রশ্নবিদ্ধ করে। জনগণের অভ্যুত্থানে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্যে জনগণের ভেতরে ক্ষোভ তৈরি করেছে। ক্ষোভ প্রকাশে আমাদের গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথকে সুগম না করে বরং আরও জটিল করে তুলতে পারে।
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, দেশের যে প্রেক্ষাপটে বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা কাম্য নয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যেন কোনোভাবেই অবনতি না ঘটে সেদিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে বর্তমান সরকারকে।
তবে, পতিত সরকার গুম, খুন, আয়না ঘরের রাজনীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, অলিগার তন্ত্র, লুটেরা তন্ত্র কায়েম করেছিল এবং নির্বাচন ধ্বংস করেছিল। সে বিষয়ে কোনো অনুসূচনা নেই তাদর।
ক্ষমা না চেয়ে, হঠাৎই তাদের এই ধরনের পদক্ষেপ আমাদের বিচলিত করেছে। তবে, শেখ হাসিনার মতো একজন ‘হাইলি সাইকোপ্যাত’ নারীর পক্ষে এ ধরনের কর্মকাণ্ড করা সম্ভব।
তার প্রতিবাদে দেশের গণঅভুত্থানের পক্ষে যে ছাত্র-জনতা ছিল তার একটা অংশ ধানমন্ডির ৩২ ভেঙে দিয়েছে।
রাজধানীর নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী মো. ফিরোজ বলেন, ৫ আগস্টের পর ঢাকাসহ সারা দেশে যেখানে সেখানে গণপিটুনিতে হত্যার মতো ঘটনা ঘটেছিল।
আমরা দেখেছি, মানসিক রোগীসহ সাধারণ মানুষও আক্রান্ত হয়েছিল। দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের লজ্জা লাগে, যেকোনো গণপিটুনির ঘটনা ঘটবার সময় ডিড় তৈরি হয় ঘটনাগুলোর ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করার জন্য।
একইসঙ্গে লক্ষ করছি, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলাতে ইস্যু সৃষ্টি করে হামলা, জ্বালাও-পোড়াও চলছে। যেকোনো সময় যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে যার উদাহরণ দেখলাম গাজীপুর হত্যার ঘটনা।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে এক বেসরকারি চাকরিজীবী বলেন, এক সময় ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে ভয় পেতাম। ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ কখন আমাকে গুম করবে, ট্যাগ দিয়ে নির্যাতন করবে।
আর, এখন ভয় পাই সমন্বয়ক বা যেকোনো চলমান ইস্যুতে কথা বলতে। তবে, বলুন আমাদের পরিবর্তনটা কোথায় হলো? নতুন বোতলে পুরোনো খাবার! এসব ভীতির নীতি থেকে আমাদের কে বের করবে? বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে করে আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে খুবই চিন্তিত।
দেশে একটি সরকার রয়েছে। স্বাধীন আইন ও বিচারব্যবস্থা রয়েছে। তারপরও যদি আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার সুযোগ থাকে কীভাবে।
এদিকে গত শুক্রবার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ, নিন্দা ও প্রতিবাদ করেছেন দেশের বিশিষ্ট ২৬ নাগরিক।
এক বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্পূর্ণ জ্ঞাতসারে নির্মমতার সঙ্গে বাড়িটি ধ্বংস করা হয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে ঘটনা-পরবর্তী একটি বিবৃতি দিয়ে এ দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারির ঘটনার দায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের ওপরেই অনেকাংশে বর্তায়। তাঁরা এসব ঘটনার বিচার দাবি করেছেন।
আপনার মতামত লিখুন :