বিএনপি-জামায়াত দ্বন্দ্বে লাভ আওয়ামী লীগের

মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২৫, ১০:২৩ পিএম

বিএনপি-জামায়াত দ্বন্দ্বে লাভ আওয়ামী লীগের

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

জুলাই অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর রাজনীতিতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিশেষ করে বিএনপি এবং জামায়াতের মধ্যে এক ধরনের টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। এমন অবস্থায় দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী রাজনীতির মাঠে সরব হওয়ার পর দল দুটির মধ্যে আগামী নির্বাচন ও সরকার গঠন এবং বর্তমান সরকারের বিভিন্ন বিষয়ে হস্তক্ষেপসহ নানা ধরনের মতবিরোধ সৃষ্টি হচ্ছে। 

দল দুটির তৃণমূল থেকে শুরু করে শীর্ষ পর্যায়ের পাল্টাপাল্টি অবস্থান ও মতবিরোধ কয়েক মাস ধরে স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা গেছে। বিষয়টি নিয়ে সচেতন মহল মনে করছেন, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর টানাপোড়েনে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে আওয়ামী লীগ। দুই রাজনৈতিক দলের এমন আলোচনা-সমালোচনার সুযোগটা তৃতীয় পক্ষও নিতে পারে। 

সম্প্রতি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসার পর থেকেই অস্তিত্ব হারানোর পথে বসেছে দলটি। এ কারণে তারা নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে সারা দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করছে বলে অনেকে অভিযোগ করছেন। যার দায়ভার অনেকটা সরকারের ওপর পড়ছে। 

রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, সংস্কারের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকে সামনে রেখে বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করছে। একসময় জোটে থাকা দলগুলোর ক্ষমতার প্রশ্নে জোট শিষ্টাচারবহির্ভূত মন্তব্য ও কর্মকাণ্ড নেতাকর্মীদের মধ্যে সম্পর্কের প্রশ্নে যেমন উত্তাপ সৃষ্টি করছে। আবার পরস্পর সন্দেহও সৃষ্টি করছে। 

আগামী দিনে জনপ্রত্যাশিত সমাজ বিনির্মাণে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ধারণ ও বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শ্রদ্ধা এবং গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন আচরণ ও কর্মসূচি অনুশীলন করা অপরিহার্য। অন্যথায় সংঘাত কিংবা সহিংসতার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যাবে।

এদিকে শেখ হাসিনার পতনের পর দীর্ঘ ২৫ বছরের রাজনৈতিক মিত্রদের মধ্যে হঠাৎ কেন এমন বৈরী সম্পর্ক তৈরি হলো, সেটি নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে। এমন দ্বন্দ্বের বিষয়টি সম্প্রতি জোরালোভাবে প্রকাশ্যে আসলে সাধারণ মানুষ বলছেন, গত আগস্টের মাঝামাঝি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নির্বাচন আয়োজনে সময় দেওয়া নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দল দুটি দ্বন্দ্বে জড়ায়। 

জানা যায়, বিগত সময়ে রাজনৈতিক ধাক্কা সামলাতে দেশে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী একটি রাজনৈতিক জোট গঠন করে একই সিদ্ধান্তে চলছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনা এবং বিভিন্ন দলের নেতাদের ভাষ্যে নতুন এক বাস্তবতা ফুটে উঠছে। জামায়াত-বিএনপি সম্পর্ক এখন নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে, যেখানে দ্বন্দ্বের চিহ্ন স্পষ্ট। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনীতির মাঠে নতুন এক সমীকরণের সূচনা হতে পারে, যা আগামী জাতীয় নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

রাজনৈতিক মিত্রতার মাঝে ফাটল কেন: ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিএনপি ও জামায়াত আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের রাজনৈতিক জোট ভেঙে দেয়। এরপর থেকে দল দুটির মধ্যে সম্পর্কের উত্তাপ ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষ করে ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে তাদের মধ্যে সম্পর্কের তিক্ততা বাড়ে। 

শেখ হাসিনার সরকার পতনে বিএনপি ও জামায়াত একসঙ্গে বিভিন্ন আন্দোলনে অংশ নিলেও আসন্ন নির্বাচনে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। এ দ্বন্দ্বের মূল কারণ হতে পারে নির্বাচন এবং সরকারের ভবিষ্যৎ কাঠামো নিয়ে দল দুটির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সাম্প্রতিক এক বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করেন জামায়াত নেতারা।

একাত্তরের ইস্যু ও জামায়াতের ভূমিকা: বিএনপি ও জামায়াতের দ্বন্দ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা। বিএনপির নেতারা বেশকিছু দিন ধরেই জামায়াতের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার বিরোধিতা করার অভিযোগ তুলে তাদের ভূমিকা সামনে আনছেন। 

১৯৭১ সালে জামায়াতের ভূমিকা ও তাদের ইতিহাস নিয়ে যখন আলোচনার ঝড় ওঠে, তখন জামায়াত নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে চেষ্টা করে। তবে মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে জামায়াতের বক্তব্য ও অবস্থান বিএনপির সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলছে। 

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেছেন, একাত্তরে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এর আগে গত ডিসেম্বরের শেষদিকে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের ‘পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক শক্তি’ বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ আরও বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীর এই বক্তব্যে আমি অবাক হয়েছি যে, আমরা ভেবেছিলাম এখন একটা সুযোগ এসেছে। 

এই সুযোগে বোধহয় তারা একাত্তরের ভূমিকার জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। সেটি না করে তারা একাত্তরে তাদের ভূমিকাকে জাস্টিফাই করছে।’ বিএনপির এমন সমালোচনার পর জামায়াতের মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘ডা. শফিকুর রহমান সাহেব তার দলের অবস্থান তুলে ধরেছেন, কিন্তু তার বক্তব্যকে বিকৃত করে উপস্থাপন করা ঠিক নয়।

 এমন পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের কারণে জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আরও বাড়বে। বিগত সরকারের পতনের পর জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে একাধিক বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। 

বিশেষত নির্বাচন ও জাতীয় ইস্যুতে তারা আরও দূরে যাবে এমনকি তাদের মতভেদের কারণে সংঘর্ষ হতে পারে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেছেন, বিএনপি ও জামায়াত বরাবরই আলাদা দল ছিল এবং আমাদের রাজনৈতিক অবস্থানও আলাদা। তার মতে, জামায়াতের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতার কারণে দুটি দলের মধ্যে ‘ন্যাচারালি’ দূরত্ব আছে।

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী এ ধরনের বক্তব্যের সঙ্গে একমত নয়। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘এটি কোনো দলের মতামত নয়, বরং নেতার ব্যক্তিগত মতামত।’ তার মতে, এমন বক্তব্য দুটি দলের সম্পর্ককে প্রভাবিত করবে না। 

তিনি আরও বলেন, গণতান্ত্রিক দেশে প্রতিটি মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার রয়েছে। এটি স্পষ্ট যে, জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণ শুধু আদর্শগত নয়, বরং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা নিয়েও রয়েছে অনেক প্রশ্ন। জামায়াতের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা এবং বিএনপির সে বিষয়ে মতপ্রকাশ রাজনৈতিক উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে আগামী দিনে দুই দলের সম্পর্ক আরও জটিল হতে পারে এবং দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে পারে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমীর মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন জানান, পতিত আওয়ামী সরকারের গুম, খুন, জুলাই গণহত্যার বিচার ত্বরান্বিত, স্বৈরাচারী শেখ হাসিনাসহ সব হত্যাকারীর বিচার নিশ্চিত করা এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমানো ও চাঁদাবাজি বন্ধের দাবিতে আমাদের একমত হতে হবে। 

তিনি বলেন, জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে শেখ হাসিনা প্রতিবেশী দেশে পলায়ন করলেও তাদের পক্ষ থেকে দেশ ও জাতিসত্তাবিরোধী ষড়যন্ত্র থেমে নেই। তাদের এ ষড়যন্ত্রে দেশি ও বিদেশি শক্তি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ইন্ধন জোগাচ্ছে। বিপ্লব ও অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করার সুগভীর চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে। 

তাই দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই এদের কঠোর হস্তে দমন করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। প্রয়োজনে সবাইকে একজোট হয়ে কাজ করতে হবে। দেশের ও জনগণের বৃহৎ স্বার্থে আমরা সবসময় এক ছিলাম ও রয়েছি। জামায়াতে ইসলামী দেশ ও জাতির কল্যাণে বিরামহীনভাবে কাজ করে আসছে এবং করে যাবে।

এসব বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, সংস্কারের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকে সামনে রেখে বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করছে। 

সাধারণ মানুষ মনে করছে, বিএনপি ও জামায়াতে টানাপোড়েনে লাভবান হচ্ছে আওয়ামী লীগ। দেশের এই ক্লান্তি সময়ে যদি জনগণের চিন্তা-চেতনা থেকে এই দুই দল বের হয়ে যায় এবং তারা যদি সংশোধন না হয়- এভাবেই নিজেদের মধ্যে নির্বাচন বা সংস্কার নিয়ে দ্বিমত তৈরি হতে থাকলে সংঘাত কিংবা সহিংসতার সম্ভাবনা বাড়তে পারে। এতে করে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা আরও বাড়তে পারে।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!