ঢাকা বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

আ.লীগের মিত্ররাও ‘কঠিন ধরাশায়ী’

সেলিম আহমেদ
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২৫, ০১:৫১ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিপাকে পড়েছে দলটির মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোও। 

দীর্ঘ সময় থেকে আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী ১৪ দলসহ মিত্র দলগুলোর দেখা নেই রাজনীতির মাঠে। এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাতীয় পার্টি-জেপির আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, তৃণমূল বিএনপির চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে।

যদিও মঞ্জুকে গ্রেপ্তারের ৫ ঘণ্টা পর শারীরিক অসুস্থতা বিবেচনায় জিম্মায় জামিন দেওয়া হয়েছে। মামলা হয়েছে দলগুলোর শীর্ষস্থানীয় প্রায় সব নেতার নামে। ফলে দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা তো দূরের কথা, গ্রেপ্তার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তারা। তালাবদ্ধ রয়েছে দলগুলোর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ও।

এ ছাড়াও আওয়ামী লীগের সহযোগী আখ্যা দিয়ে জাতীয় পার্টির (এরশাদ) কাকরাইল কার্যালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে ছাত্র-জনতা।

দলটিকে প্রকাশ্যে কোনো কর্মসূচিও পালন করতে দেওয়া হচ্ছে না। আগামী নির্বাচনে এসব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করতে পারবে কি না তা নিয়েও রয়েছে শঙ্কা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছে, ১৪ দলসহ আওয়ামী লীগের মিত্ররা যদি হাসিনার অপকর্মের সঙ্গী না হতেন তাহলে দেশের এ অবস্থা হতো না।

তাই আওয়ামী লীগের মতো এসব দলকেও এই দায় ভোগ করতে হবে। বিচারের আওতায় আসতে হবে। 

১৪ দলীয় জোটের নেই কার্যক্রম, অধিকাংশ কার্যালয় তালাবদ্ধ: ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার পর বিরোধীদলীয় অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে নিয়ে জোট গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করে আওয়ামী লীগ।

ওই বছরই ২৩ দফা ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), গণফোরামসহ ১৪ দল মিলে গঠন করা হয় জোটটি।

পরে নানা মতানৈক্যকে কেন্দ্র করে সিপিবি, বাসদ, গণফোরামসহ কয়েকটি দল বেরিয়ে যায়। ২০১৩ সালে জাতীয় পার্টি (জাপা) জোট ত্যাগ করে।

ভাঙা-গড়ার জোটে যোগ দেয় আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জেপি) ও নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীর নেতৃত্বাধীন তরিকত ফেডারেশন।

বর্তমানে আওয়ামী লীগ ছাড়া জোটের অন্য শরিক দলগুলো হলো বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), জাতীয় পার্টি (মঞ্জু), তরীকত ফেডারেশন, সাম্যবাদী দল (এমএল), গণতন্ত্রী পার্টি, গণআজাদী লীগ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ-রেজাউর), গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি ও কমিউনিস্ট কেন্দ্র। এই ১৪ দলের মধ্যে দুই দল বলা যায় অস্তিত্বহীন।

অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়া তুমুল বিতর্কিত বিগত দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজনে এসব দলের মুখ্য ভূমিকা রয়েছে।

যারা নিজের দল থেকে দাঁড়াতে জামানত হারাতেন সেইসব নেতাও হয়েছে এমপি। অনেকে মন্ত্রিত্বের সাধও পেয়েছিলেন। হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেননরাও মন্ত্রী হয়ে আওয়ামী লীগের কাঁধে বন্ধুক রেখে বিরোধী দল বিএনপি-জামায়াতকে নির্যাতন, জামায়াতকে নিষিদ্ধ, মিডিয়ার স্বাধীনতা হরণসহ নানা অপকর্ম করেছেন।

সর্বশেষ জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালে শিক্ষার্থীদের ওপর দমন-নিপীড়ন আর পুলিশি বর্বর অ্যাকশনের মদদদাতাও ছিলেন এই ১৪ দলীয় জোটের নেতারা।

কারণ তাদের সঙ্গে বৈঠক করেই ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই দমন-নিপীড়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

এদিকে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে ছাত্রদের ওপর হামলা ও হত্যার মামলা হয়েছে এসব দলের প্রায় সব শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে।

এর মধ্যে হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেননকে গ্রেপ্তার করে বারবার রিমান্ডে আনা হচ্ছে। জাতীয় পার্টির আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে আটক করা হলেও শারীরিক অসুস্থতা বিবেচনায় স্বজনদের জিম্মায় জামিন দেওয়া হয়েছে।

মামলার পর গ্রেপ্তার আতঙ্কে সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী, ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা, জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার, জাতীয় পার্টি-জেপি মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলামসহ অনেক শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে মামলা হওয়ায় তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

আবার মামলা না থাকলেও কেউ গ্রেপ্তার আতঙ্কে ভুগছেন। যাচ্ছেন না দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে, দিচ্ছেন না কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগস্টের পর থেকে জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, জেপি, তরিকত ফেডারেশনসহ অন্য দলগুলোর কেন্দ্রীয় কার্যালয় তালদ্ধ রয়েছে। অফিসে আসছেন না কোনো শীর্ষনেতা।

দলের ভবিষ্যৎ ও বর্তমান অবস্থা নিয়ে জানতে জোটের কয়েকজন নেতাকে ফোন দিয়ে নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওয়ার্কার্স পার্টির সম্পাদকীয় কমিটির এক নেতা বলেন, আমার বিরুদ্ধে এখনো মামলা হয়নি।

 তবে আটক করলে যেকোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো সম্ভব এই ভয়ে খুব একটা বের হচ্ছি না। আর মাঠের কর্মসূচি দিলে জনতার গণরোষে পড়তে হবে এই ভয়ে কোনো কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে না। আমরা মাঠের পরিস্থিতি যাচাই করছি।

পাশাপাশি আগামী দল কীভাবে চলবে সেই বিষয় নিয়েও দলের বাইরে থাকা নেতাদের সঙ্গে কথা বলছি।

বিপদে জাতীয় পার্টিও: আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর রাজনৈতিকভাবে জাতীয় পার্টিও পড়েছে বিপদে। বিগত তিন নির্বাচনে এই দলটি ছিল বিরোধী দল।

মূলত তাদের অংশগ্রহণই বিতর্কিত নির্বাচনগুলোকে বৈধতা দিয়েছিল বলে মনে করেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা

সরকার পতনের সরকারের প্রধান উপদেষ্টার রাজনৈতিক সংলাপে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তোপের মুখে তাদের সংলাপে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে বাদানুবাধেও জড়িয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র, শ্রমিক ও জনতার ব্যানারে একদল লোক দলটি কাকরাইল কার্যালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগও করেছে।

এখন মূলত বনানীর চেয়ারম্যান কার্যালয়ে ঘরোয়াভাবে কিছু সভা-সমাবেশ হলেও বাইরে কোনো কর্মসূচি করতে পারছে না দলটি।

মামলা হয়েছে চেয়ারম্যান জি এম কাদের, মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুসহ অনেক নেতারা বিরুদ্ধে।

তাদের গ্রেপ্তার করা না হলেও রাজনৈকিতভাবে চাপে রয়েছেন। 
এ প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, আমাদের আওয়ামী লীগের দোসর বলা হচ্ছে।

কিন্তু দোসর কীভাবে, এর কোনো জাস্টিফিকেশন নেই। ২০০৮ সালে নবম সংসদে আমরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোট করেছি।

কিন্তু উনার (শেখ হাসিনার) অপকর্মে আমরা একাত্ম ছিলাম না। এটা প্রমাণিত। ২০১৪ সালের নির্বাচন আমরা বর্জন করেছি।

এরশাদ সাহেবকে জোর করে সিএমএইচে ভর্তি করে, দলের ভেতরে বিভক্তি সৃষ্টি করে ক্ষুদ্র একটি অংশকে নির্বাচনে নেওয়া হয়। ২০২৪ সালের নির্বাচনও আমরা করতে চাইনি, জোর করে নির্বাচনে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। এ ঘটনা অনেকে দেখেছেন এবং জানেন।

দ্বাদশ নির্বাচনের তিন কিংস পার্টিও ধরাশায়ী: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপিসহ মিত্র দলগুলো বয়কট করলেও অংশ নিয়েছিল নির্বাচনের আগে নিবন্ধন পাওয়া ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে খ্যাত তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) ও সুপ্রিম পার্টি।

ওই নির্বাচনে এসব দল থেকে ২৭০ জন প্রার্থী ভোটে অংশগ্রহণ করলেও জয়ী হতে পারেননি কেউ। উল্টো জামানত হারিয়েছেন প্রায় সবাই। 

আওয়ামী লীগ পতনের পর বিপদে পড়েছেন তারা। ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন তৃণমূল বিএনপির চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী।

বাকি অনেক নেতার বিরুদ্ধে মামলা হওয়ায় গ্রেপ্তার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কর্মসূচি দূরে থাক দলের কার্যালয়ও খোলা হচ্ছে না।

আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগও থাকছে না: জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর ১৪ দলসহ অন্যান্য মিত্রদলগুলোকে আওয়ামী লীগের সহযোগী হিসেবে আখ্যায়িত করছেন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতারা।

তারা আওয়ামী লীগের পাশাপাশি এসব দলের নেতাদের বিচারের আওতায় আনার দাবি তুলছেন। ফলে দলগুলোর সহসাই রাজনীতিতে ফেরা নিয়ে রয়েছে সংশয়।

আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে কি না তা নিয়েও দেখা দিয়েছে শঙ্কা। কারণ, ইতোমধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ঘোষণা দিয়েছেন, আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেওয়া হবে না। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং সরকারের বর্তমান উপদেষ্টা মাহফুজ আলম সম্প্রতি বলেছেন, আমাদের লক্ষ্য একটি সুস্থ ও অবাধ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপহার দেওয়া।

তবে শেখ হাসিনা এবং তার দোসরদের জন্য সেই নির্বাচন নয়। কারণ, দেশের গণমানুষকে সঙ্গে নিয়ে শেখ হাসিনাকে উৎখাত করেছি। তাই আগামী যেকোনো নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসরদের অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে না।’