২০১১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির বিনা মূল্যের পাঠ্যবই ছাপায় উত্থাপিত অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (এনসিটিবি) অভিযান চালিয়েছে দুদক।
মূলত দক্ষিণ কোরিয়ার টিপিএস নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে অন্যায্যভাবে বঞ্চিত করে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে প্রাথমিকের দুই কোটি বই ছাপার কাজ দেওয়ার অভিযোগকে কেন্দ্র করেই এই তদন্তের শুরু।
তবে ২০১১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতিবছরই ভারতীয় প্রেসগুলোর কাজ পাওয়ার প্রক্রিয়ায় কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না সেই বিষয়গুলো নিয়েই পুরো তদন্ত প্রক্রিয়া চলবে বলে জানা গেছে।
এদিকে এনসিটিবি অভ্যন্তরীণভাবে আলাদা একটি কমিটি গঠন করে উল্লিখিত অভিযোগ তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শিগগিরই এনসিটিবির তদন্ত শুরু হতে যাচ্ছে।
জানা গেছে, ২০১৬ সালে আহ্বান করা ২০১৭ শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান টিপিএস এনসিটিবির দরপত্রে অংশ নিয়ে ১৭টি টেন্ডারে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়।
কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার এই প্রতিষ্ঠানকে অন্যায্যভাবে বঞ্চিত করে ৫০ কোটি টাকার প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির প্রায় দুই কোটি বই ছাপার কাজ ভারতীয় প্রতিষ্ঠান কৃষ্ণা ট্রেডার্সকে দেওয়া হয়।
ওই বছরই বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ও দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন সংস্থায় লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয় ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষে।
তবে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার নামমাত্র তদন্ত করে বিষয়টি ধামাচাপা দেয়। এ নিয়ে ঢাকায় অবস্থিত দক্ষিণ কোরিয়ার দূতাবাস তৎকালীন সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বললেও কিছুই করা হয়নি।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর কোরিয়ান টিপিএস কোম্পানির বাংলাদেশি অংশিদার মেগাটেক জিএনবিডি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগ শুরু করে।
ক্ষতিপূরণ ও প্রতিকার চেয়ে প্রতিষ্ঠানটি গত মাসে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং এনসিটিবিতে লিখিত আবেদনও জমা দিয়েছে। এনসিটিবির বর্তমান চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান এসব তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে গতকাল রোববার দুদকের দুই সদস্যের একটি দল বিষয়টি নিয়ে তদন্তের জন্য এনসিটিবির উৎপাদন নিয়ন্ত্রক আবু নাসের টুকুর সঙ্গে কথা বলেন।
দুদকের ওই দলে ছিলেন উপপরিচালক মো. রোকনুজ্জামান রোকন ও সহকারী পরিচালক তাপস ভট্টাচার্য। দুদকের তদন্তের বিষয়ে উৎপাদন নিয়ন্ত্রক আবু নাসের টুকু রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ২০১১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রাথমিক স্তরের বই ছাপার প্রক্রিয়ার সার্বিক বিষয় সম্পর্কে ওনারা জানতে চেয়েছেন।
বিশেষ করে ভারতীয় প্রেসগুলো কীভাবে কাজ পেয়েছে, কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ত্রুটি হয়েছে কি না ইত্যাদি জানতে চেয়েছেন।
আমি বলেছি, ওই সময় তো আমি ছিলাম না। তবে ডকুমেন্ট সবই হয়তো আছে। সময় দিলে কাগজপত্র গুছিয়ে দেওয়া যাবে।
এ বিষয়ে দুদকের উপপরিচালক মো. রোকনুজ্জামান রোকন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ২০১১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির বই ছাপা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে এই অভিযান করা হয়।
এনসিটিবির বইগুলো এক একটি লটের মাধ্যমে সাধারণত ছাপা হয়। এসব লটের কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্ত করা হচ্ছে। এ ছাড়া প্রায় প্রতিবছরই ভারতীয় প্রেসগুলো বই ছাপার কাজ পেয়েছে। এখানে কোনো ত্রুটি হয়েছে কি নাÑ সেটিও দেখা হবে।
এনসিটিবিতে কথা বলে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে তদন্তের উপাদান কেমন মনে হয়েছে প্রশ্নের উত্তরে এই কর্মকর্তা বলেন, এখানে কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে।
তবে এনসটিবিতে বর্তমানে যারা রয়েছেন তাদের অধিকাংশ গত ৫ আগস্টের পর পোস্টেড।
স্বাভাবিকভাবেই ১১-১২ বছর আগের এসব তথ্য গুছিয়ে পেতে সময় লাগবে। এসব ডকুমেন্টস হাতে পাওয়ার পর বিষয়টি সম্পর্কে আরও স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যাবে।
এদিকে ২০১৭ সালের টেন্ডার নিয়ে যে অভিযোগের ভিত্তিতে এই তদন্তের শুরু, সে সময় এনসিটিবির চেয়ারম্যান ছিলেন প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা।
অনিয়মের মাধ্যমে ভারতীয় প্রেসকে কাজ দেওয়া, এনসিটিবির অর্থে একাধিকবার ভারত ভ্রমণ, সঠিক সময়েও ভারতীয় প্রেসগুলোর নিম্নমানের কাগজে বই দেওয়া ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় এনসিটিবির সাবেক এই চেয়ারম্যানের কাছে।
তিনি বলেন, বিষয়গুলো দীর্ঘদিন আগের। এতদিন পর বিষয়গুলো ঠিকমতো মনেও নেই। তাই কোনো অভিযোগের বিষয়ে স্পেসিফিকভাবে (সুনির্দিষ্ট) মন্তব্য করা সম্ভব নয়।
তবে কোনো প্রেসকে কাজ দেওয়ার আগে সেই প্রেস পরিদর্শন কাজের প্রক্রিয়ার মধ্যেই পড়ে। আমার দায়িত্বকালীন সময়ে সব ধরনের অভিযোগ সমাধানের চেষ্টা করেছি।
আমি এখনো এসব বিষয়ে কিছু জানি না। অফিসিয়াল ওয়েতে (মাধ্যমে) আসলে তখন বলব।
অন্যদিকে ভারতীয় প্রেসকে কাজ দেওয়ার অনিয়ম সম্পর্কে দুদকের অভিযান ও তদন্তের বিষয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, এটা অত্যন্ত ভয়ানক অভিযোগ।
মাসখানেক আগে কোরীয় কোম্পানির বাংলাদেশি অংশীদার এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, এনসিটিবি ও দুদকসহ সব জায়গায় অভিযোগ দেয়। এর আগেও তারা (কোম্পানি) তৎকালীন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করে সমাধান পায়নি। তাই তারা এখন বিষয়টির বিচার ও ক্ষতিপূরণ চায়।
এতদিন পর এ বিষয়ে কীভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা বিষয়টি ধামাচাপা না দিয়ে দুদককে সর্বাত্মক সাহায্য করতে চাই। এ ছাড়া আমরা অভ্যন্তরীণ একটি কমিটি গঠন করে বিষয়টি তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দুদকের পাশাপাশি আমাদের তদন্তও চলবে।
ওই কোম্পানিকে কাজ পাওয়া থেকে অন্যায্যভাবে বঞ্চিত করায় কোরিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্ক যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মন্তব্য করে এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলেন, এতে বাংলাদেশ ও এনসিটিবির ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই অনিয়ম যারা করেছে তারা এর দায়িত্ব নেবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে ২০১১ সাল থেকে সাদা কাগজে চার রঙের প্রাথমিক স্তরের বিনা মূল্যের বই ছাপার কাজ হয়। তখন ভারত, চীন, কোরিয়া ও ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশ এনসিটিবির টেন্ডারে অংশ নিত।
কিন্তু পরবর্তীতে ভারতীয় প্রেসগুলোকে কাজ দিতে দরপত্রে কিছু পরিবর্তন হয় বলে অভিযোগ ছিল খোদ এনসিটিবিরই। এ নিয়ে গত বছর রূপালী বাংলাদেশ পত্রিকায় প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে।
তবে গত বছরের টেন্ডারে ভারতীয় একটি প্রেস কাজ পেলেও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের বই ছাপার আদেশ বাতিল করে পুনঃদরপত্র দেয়।
সূত্র জানায়, ২০১১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত যে কয়েকটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান পাঠ্যবই ছাপার কাজ পেয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে কৃষ্ণা ট্রেডার্স, ভিকে উদ্যোগ, পীতাম্বরা বুকস, সুদর্শন বোর্ড অ্যান্ড পেপার মিলস।
২০১৭ শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক স্তরের ২ কোটি পাঠ্যবই ছাপার টেন্ডারে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান টিপিএস সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়া সত্ত্বেও তাদের পরিবর্তে কাজ দেওয়া হয় ভারতীয় প্রতিষ্ঠান কৃষ্ণা ট্রেডার্সকে।
ওই বছর ভারতের একটি প্রেস ৫৯ লাখ বই ছাপার কাজ পেলেও ২৬ লাখ বই সরবরাহ করেছে ২৩ জানুয়ারির পর।
নিম্নমানের কাগজেও সময়মতো বই দিতে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা ও নিম্নমানের কাগজের ছাপা হলেও তৎকালীন এনসিটিবির তদারকি প্রতিবেদনে এসবের উল্লেখ নেই।
অথচ এই চেয়ারম্যান ভারতীয় প্রেস পরিদর্শনের জন্য এনসিটিবির টাকায় একাধিকবার ভারত ভ্রমণ করেছে।