জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ছাপানোর কাজ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনা উঠেছে বিভিন্ন মহলে।
এনআইডি ছাপানো নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড শুরু হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক জাতীয় পরিচয়পত্র ছাপানোর জন্য এ সেক্টর থেকে আগেও কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
অভিযোগ আছে, এখনো এনআইডিতে বহাল গুম-খুনের মূল হোতাদের সহযোগীরা! তা ছাড়া ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের দোসরদের কৌশলে নতুন করে কাজ দেওয়ার চেষ্টা করছে নির্বাচন কমিশন অফিসে কর্মরত দোসররা। যেটা নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা হচ্ছে।
অনেকেই বলছেন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দোসরদের ঠিকাদারি কাজ দিয়ে তাদের মোটা করা হচ্ছে।
নির্বাচন কমিশন অফিস ও একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, কয়েক হাজার কোটি টাকার জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ছাপানোর কাজ নিয়ে আবারও আলোচনায় উঠে এসেছেন স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকীর নাম।
নানা কৌশলে বিশাল এই কাজ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে তারিক সিদ্দিকীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ফ্রান্সের একটি প্রতিষ্ঠানকে, তাও আবার দেশি-বিদেশি একাধিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে অনেক বেশি দরে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় পরিচয়পত্র ছাপানোর জন্য নির্বাচন কমিশন কিছুদিন আগে ডাইরেক্ট পারচেজ মেথডে (ডিপিএম) বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিকে (বিএমটিএফ) দায়িত্ব প্রদান করে।
আর এর পরপরই প্রতি কার্ডে প্রায় ১০০ টাকা বেশি খরচ করে ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠান সেল্পকে কাজটি দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়েছে জোরেশোরে।
ওই সূত্র আরও জানায়, প্রায় তিন কোটি এনআইডি কার্ডের এই কাজ অনেক কম দরে দেশি কোম্পানিকে দিয়ে করানো সম্ভব।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ফ্রান্সের এই কোম্পানি প্রতিটি জাতীয় পরিচয়পত্র ছাপার জন্য ২৭২ টাকা দর দিয়েও কাজ পাওয়ার পথে এগিয়ে রয়েছে।
যেখানে দেশি প্রতিষ্ঠান বিএমটিএফ প্রদত্ত রেট ১৭২ টাকা, যা সেল্পের দেওয়া দরের চেয়ে ১০০ টাকা কম।
সম্প্রতি রূপালী বাংলাদেশের এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফ্রান্সের সেল্প নামক এই প্রতিষ্ঠানটি প্রকৃতপক্ষে ভারতেরই একটি প্রতিষ্ঠান, যার লাইসেন্স কেবল করা হয়েছে ফ্রান্স থেকে।
ফ্রান্সে এই প্রতিষ্ঠানটির তেমন কোনো অস্তিত্বই নেই, কোনো কাজের অভিজ্ঞতাও নেই। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে তারিক সিদ্দিকীর মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানটি জাতীয় পরিচয়পত্র ছাপানোর কাজ নেবার জন্য অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পরে সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, কয়েক মাস যেতে না যেতেই আবারও তারিক সিদ্দিকীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দপ্তরের সাবেক এডিসি মেজর নাসিমুল হককে ‘লোকাল এজেন্ট’ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে সেল্প।
আর তার প্রচেষ্টায় ও মধ্যস্থতায় কয়েক হাজার কোটি টাকার এই জাতীয় পরিচয়পত্র ছাপানোর কাজ পেতে যাচ্ছে ফ্রান্সের সেই বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান সেল্প।
উল্লেখ্য, ফ্রান্সের লাইসেন্সে প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় এই প্রতিষ্ঠান সেল্প বিগত স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত সাত বছর ধরে জাতীয় পরিচয়পত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ইভিএম ইত্যাদি সরবরাহ ও ছাপানোর প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে নিয়ে গেছে।
প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের দর ছিল দেশি-বিদেশি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ে অনেক বেশি। কেবল পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহচর তারিক সিদ্দিকীর প্রত্যক্ষ মদদে ভারতীয় এই প্রতিষ্ঠানটি লুটপাট করে নিয়ে গেছে বাংলাদেশের হাজার হাজার কোটি টাকা এসব বিষয়ে কথা বলতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য করতে কেউ রাজি হননি।
আর বিএমটিএফ-এর পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন কর্মকর্তারা জানান, এখনো জাতীয় পরিচয়পত্র ছাপানোর কাজটি কোন প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হবে, সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিষয়গুলো গোপনীয়, বিস্তারিত কিছু জানানো সম্ভব নয়।
এনআইডির তথ্য ফাঁস হয়েছে পাঁচ প্রতিষ্ঠান থেকে: এদিকে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ পাঁচটি প্রতিষ্ঠান তৃতীয় পক্ষের কাছে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) তথ্য ফাঁস করেছে বলে প্রাথমিকভাবে প্রমাণ পেয়েছে ইসি।
গতকাল সোমবার নির্বাচন ভবনে ইসি সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। এনআইডি সেবা দিয়ে থাকে নির্বাচন কমিশন। এনআইডি তথ্যভান্ডারও ইসির নিয়ন্ত্রণে।
সরকারি-বেসরকারি ১৮২টি প্রতিষ্ঠান ইসির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। তারা এনআইডির তথ্য যাচাইসংক্রান্ত সেবা নিয়ে থাকে। আজ সকালে এনআইডি যাচাই সেবা গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করে ইসি। তাদের এ আলোচনা আরও চলবে।
ইসি সূত্র জানায়, যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তথ্য ফাঁস হয়েছে, সেগুলো হলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ইউসিবি ব্যাংকের উপায়, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আইবাস।
মতবিনিময় শেষে ইসি সচিব আখতার আহমেদ বলেন, দেখা যাচ্ছে, যাদের তথ্য যাচাইয়ের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তারা ইসির অগোচরে অন্য অনাকাক্সিক্ষত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে তথ্য দিচ্ছে। যেটা কাম্য নয়।
এটা নিয়ন্ত্রণে আনা ও ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করার জন্য তাঁরা আলোচনা করছেন। যাতে যার জন্য যতটুকু তথ্য প্রয়োজন, তিনি ততটুকু তথ্য নেন।
এক প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব জানান, এখন পর্যন্ত তাঁরা পাঁচটি প্রতিষ্ঠান পেয়েছেন, যেগুলোর কাছ থেকে তথ্য ফাঁস হয়েছে। কীভাবে এটি হয়েছে, তা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে। তথ্য ফাঁস বা পাচারের বিষয়গুলো কারিগরি, এগুলো আরও যাচাই-বাছাই করা হবে।
তিনি বলেন, এ তথ্য ফাঁস ইচ্ছাকৃতভাবে হয়েছে, নাকি অসাবধানতাবশত হয়েছে, সেটা দেখা হচ্ছে। যদি কেউ স্বপ্রণোদিতভাবে এটা করে থাকে, তাহলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।