ঢাকা বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

রপ্তানি প্রণোদনার বিকল্প খুঁজছে সরকার

হাসান আরিফ
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৫, ১২:২৫ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

রপ্তানি আয় বাড়াতে বিশেষ কিছু খাতে প্রণোদনার বিকল্প খোঁজা ও রপ্তানি বৃদ্ধির কৌশল খুঁজছে সরকার।

২০২৬ সালের পর রপ্তানি প্রণোদনা বন্ধ হলে খাতগুলো কিভাবে তাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখবে সেই বিষয়টিও বের করতে চায় সরকার।

তা ছাড়া ২০২৪ থেকে ২০২৭ সালের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যে রপ্তানি নীতি করেছে, তাতে প্রণোদনা বাদ দিয়ে অন্যান্য নীতি সহায়তা চালুর বিষয়টি রাখা হয়েছে।

এ জন্য প্রণোদনার বিকল্প সুবিধা কি হতে পারে এবং রপ্তানি ধরে রাখা ও বৃদ্ধির উপায় বের করতে ১১ সদস্যের পর্যালোচনা কমিটি গঠন করেছে সরকার। অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

এ বিষয়ে কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, তাদের লক্ষ্য হবে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর যেসব চ্যালেঞ্জে পরবে তা থেকে রপ্তানিকে কি করে রক্ষা করা যায় তা বের করা।

একই সঙ্গে প্রণোদনার বিকল্প হিসেবে রপ্তানি বৃদ্ধিতে কি ধরনের সহায়তা দেওয়া যায়। আর এই সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে যাতে ডব্লিউটিওর আইনের কোনো ব্যত্যয় না হয়।

তিনি জানান, আগামী ২০২৭ সাল পর্যন্ত রপ্তানি খাতে ১২টি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এ নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে।

এর মধ্যে রয়েছে রপ্তানিতে আর্থিক প্রণোদনার বিপরীতে বিকল্প সহায়তা দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য খাতের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা। কারণ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর নগদ সহায়তা বন্ধ হবে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

মনিটরিং সেলের ফিন্যান্সিয়াল এনালিস্ট মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন স্বাক্ষরিত এক চিঠির সূত্রে জানা গেছে, কমিটির কাজ হবে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাটজাত পণ্য, কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত কৃষি পণ্য এবং ফার্মাসিউটিক্যালস খাতের রপ্তানি সক্ষমতা বৃদ্ধির অন্তরায়গুলো কি কি তা চিহ্নিত করা।

২০২৬ সালের পর রপ্তানি প্রণোদনা বন্ধ হলে খাতগুলো কিভাবে তাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখবে।

এই খাতগুলোর রপ্তানি প্রণোদনা ব্যতীত অন্যান্য কি ধরনের আর্থিক ও অ-আর্থিক সহায়তা দেওয়া যেতে পারে নির্ধারণ করা এবং এসব সম্ভাবনীয় রপ্তানি খাতকে প্রমোট করার জন্য একটি প্লাটফর্মের রূপরেখা প্রস্তাব তৈরি ও একটি কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা।

উচ্চ পর্যায়ের এই কমিটিকে আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি মধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।

জানা গেছে, ১১ সদস্যের পর্যালোচনা কমিটির প্রধান করা হয়েছে অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও টিডিএম)।

আর সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন মনিটরিং সেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক-১ মো. আমিরুল ইসলাম। এই কমিটির সদস্য হিসেবে থাকবে মনিটরিং সেলের মহাপরিচালক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো এবং এফবিসিসিআই প্রতিনিধি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের অন্য সম্ভাব্য পণ্য খাত, যেমন চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, হস্তশিল্প, ফার্মাসিউটিক্যালস, আইসিটি ও আইটি এনাবল্ড সার্ভিসেস এবং হালকা প্রকৌশল পণ্য, তৈরি পোশাক খাতের মতো একই ধরনের সহায়তা পাচ্ছে না।

এই সমস্যাগুলো বহুবার আলোচনা করা হয়েছে কিন্তু বাস্তবায়নের অগ্রগতি খুব বেশি চোখে পড়েনি।

প্রতিযোগী দেশগুলোর কর্মপদ্ধতি বিবেচনা করার পাশাপাশি অর্থনীতিতে তাদের অবদান মূল্যায়নের জন্য খাতভিত্তিক নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন।

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণকালীন ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে প্রণয়ন করা হয়েছে রপ্তানিনীতি (২০২৪-২৭) করা হয়েছে।

এ সময়ে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের বাজারগুলোতে দীর্ঘদিনের পাওয়া শুল্ক-কোটামুক্ত সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ।

ইউরোপের বাজারে দেশের পণ্য রপ্তানিতে নতুন করে ১০ শতাংশ শুল্ক গুনতে হবে রপ্তানিকারকদের। সীমিত হবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও’র) চুক্তির আওতায় বিশেষ সুবিধাগুলো।

এসবসহ আরও বেশকিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই বাস্তবায়ন করতে হবে নতুন রপ্তানিনীতি।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বা ডব্লিউটিওর বিধান অনুসরণ করে রপ্তানিকারকদের আর্থিক প্রণোদনার বিকল্প খুঁজতে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণ হলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিদ্যমান বেশকিছু বাড়তি সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ।

সেই প্রস্তুতির অংশ হিসাবেও দেশীয় শিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে প্রণোদনামূলক নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হচ্ছে সরকারকে।

এলডিসি থেকে উত্তরণের পর অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।

রপ্তানির ক্ষেত্রে কোন খাতগুলোকে প্রাধান্য দিতে হবে, কোনগুলো দেশের বাইরে ব্র্যান্ডিং করতে হবে, সেই বিষয়গুলো রপ্তানি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

জানা গেছে, যদিও এর আগের ২০২১-২৪ রপ্তানিনীতিতে আট হাজার কোটি মার্কিন ডলারের আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা অর্জন সম্ভব হয়নি। কারণ কোভিড-১৯, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা রপ্তানি আয়ে বড় বাধা সৃষ্টি হয়।

সাবেক বাণিজ্য সচিব (সিনিয়র) মাহবুব আহমেদ জানান, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ ঘটবে আমাদের।

এ ঘটনার পর উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাজারে যেসব সুবিধা কমবে সেগুলো আরও তিন বছর বহাল থাকবে।

অর্থাৎ আগামী ২০২৯ সাল পর্যন্ত বলবত থাকবে। ফলে নতুন রপ্তানি নীতিমালা খুব বেশি প্রভাব পড়বে না।

তবে এর বাইরে যে সমস্যা সেটি হচ্ছে বাজার ও পণ্য বহুমুখীকরণ। কিছুটা কার্যকর হলেও এখন অনেক বাকি আছে।

পণ্য বৈচিত্র্যকরণে বিরাট সম্ভাবনা থাকলেও খুব বেশি এগোনো যায়নি। এ সময় অনেক পণ্য এলেও এখনো তৈরি পোশাকের ওপর নির্ভরশীলতাই রয়ে গেছে।

নতুন নীতিমালায় রপ্তানি বাণিজ্যে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন, প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ সহায়তা দিয়ে পণ্য ও বাজার বহুমুখীকরণ, বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতি রেখে বাণিজ্য ব্যবস্থার সক্ষমতা বাড়ানো, মুক্ত বাণিজ্য, দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন।

লক্ষ্যের মধ্যে শিল্প খাতে উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের মান উন্নয়ন, আইসিটি খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার, ই-কমার্স, ই-গভর্ন্যান্স ও চতুর্থ বিপ্লবের কৌশল গ্রহণ করে রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারণকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

নমুনা সংগ্রহ প্রসঙ্গে শর্ত দেওয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মতি নিয়ে শতভাগ রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্প বছরে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার এবং চামড়াশিল্পে ২০ হাজার মার্কিন ডলারের পণ্যের নমুনা পাঠাতে পারবে।

নানা চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও নতুন খসড়া নীতিতে ১৪টি পণ্যকে রপ্তানির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে অধিক মূল্য সংযোজিত তৈরি পোশাক ও ডেনিম, কৃত্রিম ফাইবার, গার্মেন্ট এক্সেসরিজ, ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য, জুতা, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাটজাত পণ্য, কৃষিপণ্য, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্নিচার, হোম টেক্সটাইল উল্লেখযোগ্য।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তৈরি পোশাক, ইলেকট্রনিক্স, চামড়াজাত পণ্য, হালকা প্রকৌশল পণ্য এবং আইটি পরিষেবার মতো বৈচিত্র্যময় পণ্য খাতের রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের ভিয়েতনাম, ভারত এবং কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলোর সঙ্গে কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

ভালো ব্র্যান্ডের অপ্রতুলতা, কমপ্লায়েন্স ইস্যু (পরিবেশ এবং শ্রম) এবং গুণগতমানসম্পন্ন পণ্যের জন্য নতুন আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

উপরন্তু, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার ফলে একতরফা অগ্রাধিকারমূলক বাজার প্রবেশাধিকার সুবিধা হারাবে, যা আমাদের প্রতিযোগিতা আরও বাড়িয়ে দেবে।

জাতিসংঘ বাণিজ্য ও উন্নয়ন সম্মেলনের (আঙ্কটাড) তথ্যানুযায়ী, অগ্রাধিকার বাজার সুবিধা হারানোর ফলে বাংলাদেশ প্রায় ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো রপ্তানি হ্রাস পাবে।

ডব্লিউটিও নিয়ম অনুসারে, উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশগুলো রপ্তানি আয়ের ওপর সরাসরি নগদ ভর্তুকি দিতে পারে না। তাই সরকার রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সঙ্গে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল গঠনের প্রস্তাব করেছে।

এ থেকে রপ্তানিকারকরা স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে ‘ভেঞ্চার ক্যাপিটাল’ হিসেবে ঋণ নিতে পারবেন। এ ছাড়া পণ্য উন্নয়ন ও রপ্তানিযোগ্য পণ্য বহুমুখীকরণেও সরকার পরামর্শ ও কারিগরি সহায়তা দেবে।

গুদামজাতকরণ ও বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপনে সহায়তা, বিদেশে বিপণনের জন্য দক্ষতা বাড়ানো ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবস্থা ও বর্জ্য শোধনাগার স্থাপনে স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ দেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে।

একইভাবে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস বিলের ওপর সরকার পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ রেয়াত দেবে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানে এগুলোর ব্যবহারের ওপর যৌক্তিক খরচ নির্ধারণ করবে।

ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল ব্যবহারের ক্ষেত্রেও দেওয়া যায় কি না তা খতিয়ে দেখা হবে। এ ছাড়াও, যন্ত্রপাতি ও খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানিতে লাইসেন্সিং ফি ও সব ধরনের শুল্কে ছাড় পেতে পারেন রপ্তানিকারকরা।

আর রপ্তানি আয়ের দুই থেকে আড়াই শতাংশ পর্যন্ত প্রণোদনা সেবা খাতে দেওয়া হবে।