তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগে বিদেশভ্রমণের খরচ এবং প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়াই সেবাকাজ পাওয়ার সুযোগের মতো নানান আবদার করেছে সোশিয়ান এআই নামক একটি প্রতিষ্ঠান।
বিদেশভ্রমণের খরচ পেতে জালিয়াতি বা প্রতারণার আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগে সোশিয়ান এআইয়ের দুই কর্মকর্তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় আইসিটি বিভাগের আইডিয়া প্রকল্প কার্যালয়।
তবে অভিযোগ উঠেছে, নোটিশ দেওয়ায় উলটো প্রকল্প পরিচালকের বদলিতে প্রভাব বিস্তার করেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী (সিইও) তানভীর হাসান সৌরভ ও যোগাযোগ পরিচালক কাঞ্চন নাহার।
অন্যদিকে সরকারকে জনগণের মতামত বোঝাতে ৩ কোটি টাকা মূল্যের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)ভিত্তিক একটি সমাধান আইসিটি বিভাগের কাছে বিক্রিতে চিঠি দিয়েছিলেন সোশিয়ান এআইয়ের ওই দুই কর্মকর্তা। অবশ্য নতুন কর্মসূচি নেওয়া বর্তমানে বন্ধ থাকায় বাদ পড়ে সোশিয়ানের প্রস্তাবটি।
গত বছরের ২৫ থেকে ২৯ নভেম্বর জার্মানির রাজধানী বার্লিনে অনুষ্ঠিত হয় ‘এশিয়া বার্লিন সামিট-২৪’।
এই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আইডিয়া প্রকল্প থেকে অর্থসহায়তা পেতে আইসিটি বিভাগে আবেদন করেছিল সোশিয়ান এআই। তবে বিষয়টির প্রক্রিয়াকরণ সম্পন্ন হওয়ার আগেই শেষ হয় ঐ সামিট।
এ ঘটনার কিছুদিন পরেই ব্রুনাইতে এশিয়া প্যাসিফিক আইসিটি অ্যালায়েন্স (এপিকটা) অ্যাওয়ার্ড-২০২৪-এ অংশ নিতে আবারও অর্থসহায়তা চেয়ে আইসিটি বিভাগে আবেদন করে প্রতিষ্ঠানটি।
সিইও তানভীর হাসান সৌরভ এবং যোগাযোগ পরিচালক কাঞ্চন নাহারের ভিসা প্রসেসিং ফি, বিমান ভাড়া, থাকার ব্যবস্থা এবং যোগাযোগের জন্য সহযোগিতা চাওয়া হয় আইসিটি বিভাগের সচিব বরাবর।
আইসিটি সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী আবেদনটি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য পাঠান আইডিয়া প্রকল্পের তৎকালীন পরিচালক মোহাম্মদ নজরুল ইসলামের কাছে।
তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক এ বিষয়ে আয়োজক কর্তৃপক্ষ এপিকটা সচিবালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলে বেরিয়ে আসে থলের বেড়াল।
আইডিয়া প্রকল্প কার্যালয় এবং এপিকটা সচিবালয়ের যোগাযোগের কিছু সূত্র এসেছে রূপালী বাংলাদেশের কাছে।
এতে দেখা যায়, এপিকটা সচিবালয় এবং ব্রুনাইয়ের তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি ইন্ডাস্ট্রি কর্তৃপক্ষ (এআইটিআই) উভয় সংস্থাই জানায় যে, তানভীর হাসান সৌরভ এপিকটা অ্যাওয়ার্ড-২০২৪-এর একজন ‘নমিনি’ হিসেবে নিবন্ধিত হলেও কাঞ্চন নাহার অনুষ্ঠানে নিবন্ধিত নন।
এমনকি কাঞ্চন নাহার সম্পর্কে কোনো তথ্যও নিজেদের রেকর্ডে নেই বলে জানায় এপিকটা সচিবালয়।
অন্যদিকে, ভিসা প্রসেসিং ফি বাবদ আইসিটি বিভাগের আর্থিক সাহায্য চাইলেও ততদিনে তানভীর হাসান সৌরভ ব্রুনাইয়ের ভিসা পেয়েছিলেন।
সৌরভ ও কাঞ্চনের আবেদন যাচাইয়ে আইডিয়া প্রকল্প কার্যালয়ে চিঠি দেওয়া হয় ২৬ নভেম্বর। আর ২৯ নভেম্বর এপিকটা নিশ্চিত করে যে, সৌরভকে এরই মধ্যে ভিসা দিয়েছে ব্রুনাই।
এমন প্রেক্ষাপটে সরকারের থেকে আর্থিক এবং অন্যান্য সুবিধাপ্রাপ্তিতে তানভীর হাসান সৌরভ ও কাঞ্চন নাহার জাল বা ভুয়া আমন্ত্রণপত্র দাখিল করেছে উল্লেখ করে তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন আইডিয়া প্রকল্পের পরিচালক।
এতে উল্লেখ করা হয় যে, সৌরভ ও কাঞ্চন নাহারের এমন কর্মকাণ্ড একপ্রকার প্রতারণা বা ডিজিটাল জালিয়াতি।
ভবিষ্যতে আর কোনো স্টার্টআপ যেন সরকারি সুবিধাপ্রাপ্তির জন্য এ ধরনের জালিয়াতি বা প্রতারণার আশ্রয় না নেয়, সেজন্য কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয় বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
পাশাপাশি আইসিটি বিভাগ থেকে প্রাপ্ত সুবিধা বাতিল ও আইসিটি টাওয়ারে প্রবেশ নিষিদ্ধকরণসহ তাদের বিরুদ্ধে বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা কেন গ্রহণ করা হবে না; সেই জবাবও চাওয়া হয় চিঠিতে।
যদিও নিজেদের জবাবে প্রয়োজনীয় সব দলিল জমা দেওয়ার দাবি করেছেন সৌরভ ও কাঞ্চন।
নিজেদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে একটি নামসর্বস্ব অনলাইনে প্রকাশিত সংবাদের রেফারেন্সও দেন তারা।
তাদের জবাব যাই হোক, ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের হয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিদেশভ্রমণে রাষ্ট্রীয় অর্থ চাওয়ার বিষয়টি অস্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেছেন খোদ সরকারি কর্মকর্তারা।
আইসিটি বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিচয় গোপনের শর্তে রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘২০২৪-২৫ অর্থবছরে পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেট হ্রাস করা এবং বিদেশভ্রমণ সীমিতকরণে পরিপত্র রয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের।
গত বছরের ৪ জুলাই জারি করা পরিপত্র অনুযায়ী, যেখানে সরকারি কর্মকর্তাদেরই রাষ্ট্রীয় অর্থে বিদেশ সফর একরকম বন্ধ করা হয়, সেখানে ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের রাষ্ট্রীয় অর্থে বিদেশভ্রমণের বিষয়টি ঠিক সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইডিয়া প্রকল্প থেকে অদ্যাবধি ১০ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছে সোশিয়ান এআই।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে আইসিটি টাওয়ারের ১৪ তলায় আইডিয়া প্রকল্পের কার্যালয়ে অফিস স্পেস বরাদ্দ পায় ‘ইকো ডাইনামিক’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী আবার সোশিয়ান এআইয়ের যোগাযোগ পরিচালক কাঞ্চন নাহার।
বর্তমানে ইকো ডাইনামিকের কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও অফিস স্পেস ঠিকই ব্যবহার করছেন কাঞ্চন নাহার।
এমনকি এই সংবাদের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাওয়া হলে কথোপকথনের একপর্যায়ে প্রতিবেদককে আইসিটি টাওয়ারে যেতে বলেন তিনি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চলতি ফেব্রুয়ারি মাসে কাঞ্চন নাহারকে আইডিয়ার স্পেস ছেড়ে দিতে বলা হয় প্রকল্প কার্যালয় থেকে।
ইকো ডাইনামিক ছাড়াও আরও ৪৫টি প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দের মেয়াদ শেষ হওয়ায় আগামী মে মাসের মধ্যে অফিস স্পেস ছেড়ে দিতে বলা হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, অফিস স্পেস ছেড়ে দিতে বলায় প্রকল্পের তৎকালীন পরিচালক মোহাম্মদ নজরুল ইসলামসহ প্রকল্পের একাধিক কর্মকর্তার নামে আইসিটি বিভাগে নানান অভিযোগ দেওয়া হয়। এ কাজের অন্যতম নেতৃত্বদানকারী হলেন কাঞ্চন নাহার।
রূপালী বাংলাদেশের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রকল্প পরিচালক নজরুল ইসলামকে সরাতে আইসিটি বিভাগের বিভিন্ন দপ্তরে বারংবার ধরনা দিয়েছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং ই-ক্যাবের সাবেক সভাপতি শমী কায়সারের ঘনিষ্ঠ কাঞ্চন নাহার।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, খাতা-কলমে প্রতিষ্ঠান থাকলেও ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না সোশিয়ান এআই ও ইকো ডাইনামিকের।
বিষয়টি রূপালী বাংলাদেশের কাছেও স্বীকার করেন সৌরভ ও কাঞ্চন।
এমন প্রেক্ষাপটে অর্থ উপার্জনে তারা নানান পন্থা অবলম্বন করছেন বলে জানান একাধিক সূত্র।
তারই অংশ হিসেবে রাষ্ট্রীয় অর্থে বিদেশভ্রমণে ব্যর্থ হয়ে নতুন উপায় হিসেবে আইসিটি বিভাগের কাছে ‘এসিবি এআই’ নামে একটি সেবা বিক্রির চেষ্টা করে সোশিয়ান এআই।
কোনো ধরনের প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়াই ‘এসিবিআই কর্মসূচি’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরির প্রস্তাব দেয় সোশিয়ান এআই।
গত ২০ জানুয়ারি বিভাগের সচিব বরাবর তানভীর হাসান সৌরভ ও কাঞ্চন নাহার শান্তার যৌথ স্বাক্ষরিত চিঠির কপি এসেছে রূপালী বাংলাদেশের কাছে।
এতে উল্লেখ করা হয় যে, ‘আমরা আইসিটি বিভাগ থেকে এসিবিএআই নামে একটি কর্মসূচি গ্রহণ করতে যাচ্ছি।
এই কর্মসূচির আওতায় একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা এবং ব্যবহার করা হবে, যার আওতায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা জনগণের মতামত বিশ্লেষণ করে সেই অনুযায়ী বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।’
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয় যে, সোশিয়ান এআই এই কর্মসূচির কার্যক্রম ‘আনঅফিশিয়ালি’ শুরুও করেছে এবং বিভিন্ন অংশীজনকে প্রতিবেদন দিচ্ছে।
এই কর্মসূচি দ্রুত বাস্তবায়নে সচিব বরাবর আবেদনও করেন সৌরভ ও শান্তা। জানা যায়, এই সেবাটি আইসিটি বিভাগকে ৩ কোটি টাকায় বিক্রির চেষ্টা করছিল প্রতিষ্ঠানটি।
বিষয়টি মেনে নিয়ে কাঞ্চন নাহার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এই সিস্টেমের দাম আরও বেশি। চেয়েছিলাম কমেই সিস্টেমটা সরকারকে দিতে।
কোন ধরনের দরপত্র ছাড়া এমন সেবা কীভাবে সরকারের কাছে বিক্রি করা যায় এমন প্রশ্নের জবাবে সৌরভ বলেন, ‘প্রস্তাব করেছিলাম, তারা রাখেনি। কাজেই বিষয়টি সেখানেই শেষ।’
সোশিয়ান এআইয়ের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে আইডিয়া প্রকল্পের তৎকালীন পরিচালক নজরুল ইসলাম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘তাদের বিদেশভ্রমণে অর্থায়নের বিষয়ে সচিব মহোদয়ের দপ্তর থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আমার কাছে আসে।
আমি সব তথ্য যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি।’ এর থেকে আর বেশি কিছু বলতে চাননি এই কর্মকর্তা।