দেশের গ্রাম-গঞ্জে প্রতিনিয়ত ঘটছে চুরি-ডাকাতির ঘটনা। বিভিন্ন কৌশলে ঘরে ঢুকে পরিবারের সদস্যদের অজান্তে লুটে নিচ্ছে নগদ অর্থ ও স্বর্ণালংকার।
আবার অস্ত্রের মুখে জিম্মি করেও টাকাপয়সা, স্বর্ণালংকার লুটে নিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে উদ্বেগ-আতঙ্ক।
অনেক জেলা-উপজেলার বাসিন্দারা রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, রাত নামলেই আতঙ্কে থাকতে হয়।
পুলিশি টহল না থাকার কারণে চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় কেউ কেউ থানায় অভিযোগ করলেও অনেক ভুক্তভোগীই ঝামেলা ভেবে পুলিশকে জানান না।
তবে পুলিশ জানিয়েছে, এ ধরনের ঘটনা ঠেকাতে নিয়মিতই অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। শিগগির দোষীদের গ্রেপ্তার করা হবে বলেও আশ্বস্ত করছেন তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে গত ছয় মাসে ৫ হাজার ২৯৩টি চুরি ও ১ হাজার ১৪৫টি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। গত বছরের আগস্টে চুরির ঘটনা ছিল ৫১৩টি।
মাসে মাসে বেড়ে চলতি বছরের জানুয়ারিতে তা ১ হাজার ৫৯টি হয়। অনুরূপ আগস্টে ডাকাতির ঘটনা ছিল ১০৭টি।
গত কয়েক মাসে বেড়ে জানুয়ারিতে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ২৪২টি। পুলিশের অপরাধ পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি চুরি-ডাকাতি হয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন ও ঢাকার রেঞ্জ এলাকায়।
আর সবচেয়ে কম চুরি হয়েছে রংপুর মেট্রোপলিটনে ও সিলেট রেঞ্জে।
এছাড়া সবচেয়ে কম ডাকাতি ছিল বরিশাল মেট্রোপলিটন ও ময়মনসিংহ রেঞ্জে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার কারণে সহিংস অপরাধের চেয়ে সম্পত্তিসংক্রান্ত অপরাধ অনেক বেশি বেড়ে গেছে।
ফলে চুরি-ডাকাতি থেকে মুক্তি পেতে পুলিশকে কমিউনিটি বেজড এনগেজমেন্ট বাড়াতে হবে।
উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে গ্রাম-গঞ্জে একটা কমিটি করে এর মাধ্যমে মনিটরিং করা গেলে অনেকাংশেই চুরি-ডাকাতি রোধ করা সম্ভব হবে।
ফলে যেসব এলাকায় চুরি-ডাকাতি বেশি সংঘটিত হচ্ছে, সেসব এলাকার বিষয়ে পুলিশকে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে তা পর্যালোচনা করে সক্ষমতা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের গত ছয় মাসের অপরাধচিত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ছয় মাসে চুরির ঘটনা ছিল ৫ হাজার ২৯৩টি এবং ডাকাতির ঘটনা ছিল ১ হাজার ১৪৫টি।
আগস্টে চুরির ঘটনা ছিল ৫১৩টি। মাসে মাসে বেড়ে জানুয়ারিতে তা ১ হাজার ৫৯টি হয়।
অনুরূপ আগস্টে ডাকাতির ঘটনা ছিল ১০৭টি। গত কয়েক মাসে বেড়ে জানুয়ারিতে তা ২৪২টি হয়।
গত বছরের আগস্টে চুরির ঘটনা ছিল ৫১৩ ও ডাকাতি ১০৭টি, সেপ্টেম্বরে চুরি ৮৩৮টি ও ডাকাতি ১৬১, অক্টোবরে চুরি ৯৭০টি ও ডাকাতি ২২৫টি, নভেম্বরে চুরি-ডাকাতি একটু কমলেও ডিসেম্বরে ফের বেড়ে যায়।
নভেম্বরে চুরির ঘটনা ছিল ৯৪৭টি এবং ডাকাতির ঘটনা ছিল ১৮০টি।
ডিসেম্বরে চুরি ৯৬৬টি ও ডাকাতি ২৩০টি এবং চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে চুরি-ডাকাতি ডিসেম্বরের চেয়েও বেড়েছে।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, জানুয়ারিতে চুরির ঘটনা ছিল ১ হাজার ৫৯টি এবং ডাকাতি ছিল ২৪২টি।
গত ছয় মাসে পুলিশের দেওয়া অপরাধ পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, পুলিশের মেট্রোপলিটন এলাকাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চুরির ঘটনা ঘটেছে ঢাকা মেট্রোপলিটনে।
আর সবচেয়ে কম চুরি হয় রংপুর মেট্রোপলিটনে। এছাড়া আটটি মেট্রোপলিটন এলাকায় সবচেয়ে বেশি ডাকাতির ঘটনা ঘটে ঢাকা মেট্রোপলিটনে।
সবচেয়ে কম ডাকাতি ছিল বরিশাল মেট্রোপলিটনে। পুলিশের রেঞ্জ এলাকায় গত ছয় মাসে সবচেয়ে বেশি চুরির ঘটনা ছিল ঢাকা রেঞ্জে।
সবচেয়ে কম চুরির ঘটনা ছিল সিলেট রেঞ্জে। এছাড়া সবচেয়ে বেশি ডাকাতি ঢাকা রেঞ্জে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম রেঞ্জ এবং তৃতীয় অবস্থানে রাজশাহী রেঞ্জ। সবচেয়ে কম ডাকাতি ময়মনসিংহ রেঞ্জে।
পুলিশ সদর দপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত অপরাধচিত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ডাকাতি ছিল ১৩৫টি, চুরি ৯০৪টি।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে দেখা গেল ডাকাতি ২৩০টি, চুরি ৯৬৬টি। পাশাপাশি বার্ষিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে ডাকাতির ঘটনা ছিল ১ হাজার ৫৪৬টি, চুরি ৩ হাজার ৯০টি। সেখানে ২০২৪ সালে এসে ডাকাতি হয়েছে ১ হাজার ৯০২টি, চুরি ১১ হাজার ৩১০টি।
অর্থাৎ, ২০২৪ সালে আগের বছরের তুলনায় চুরি বেড়েছে ৮ হাজারেও বেশি।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার কারণে সহিংস অপরাধের চেয়ে সম্পত্তি-সংক্রান্ত অপরাধ অনেক বেশি বেড়ে গেছে।
ফলে চুরি-ডাকাতি থেকে মুক্তি পেতে পুলিশকে কমিউনিটি বেইজড এনগেজমেন্ট বাড়াতে হবে। উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে গ্রাম-গঞ্জে একটা কমিটি করে তার মাধ্যমে মনিটরিং করা যায় তাহলে অনেকাংশেই চুরি-ডাকাতি রোধ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, এসব অপরাধ দমনে পুলিশের এই মুহূর্তে সক্ষমতা নেই। তারা নিজেরাও ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় আছে। আত্মমনোবলের জায়গা থেকে কাজ করতে তাদের মধ্যে অনেক নিষ্ক্রিয়তা পরিলক্ষিত হচ্ছে।
তাই কমিউনিটি এনগেজমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পুলিশকে সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে চুরি-ডাকাতি মোকাবিলা করতে হবে। তাছাড়া এটা সম্ভব নয়।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, যেসব এলাকায় চুরি-ডাকাতি বেশি সংঘটিত হচ্ছে, সেসব এলাকার বিষয়ে পুলিশকে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে তা পর্যালোচনা করতে হবে।
এসব অপরাধপ্রবণ এলাকায় কারা চুরি-ডাকাতির সঙ্গে জড়িত, তাদের নেটওয়ার্ক ভেঙে দিতে হবে। একই সঙ্গে জড়িত প্রত্যেক অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
তিনি বলেন, রাতের বেলা চুরি ও ডাকাতি যদি বেশি হয়, তাহলে পুলিশের টহল দলকে আরও জোরদার করতে হবে।
জানা গেছে, চুরি-ডাকাতি ঠেকাতে স্বেচ্ছায় দেশের বিভিন্ন স্থানে রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে এলাকাবাসী।
বরিশালের বাকেরগঞ্জের বিভিন্ন ইউনিয়নে, রাজবাড়ীর কালুখালী ও বগুড়ার ধুনট উপজেলার চিকাশি ইউনিয়নসহ বিভিন্ন অঞ্চলে রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দারা।
গরু চুরি ঠেকাতে বগুড়ার ধুনটে রাতে দল বেঁধে পাহারা দিচ্ছে গ্রামবাসী। গ্রামীণ পাকা সড়কে বসিয়েছে চেকপোস্ট।
প্রতিদিন রাত ১২টার পর এই সড়কে চলাচলকারী সন্দেহভাজন গাড়ি চেকপোস্টে থামিয়ে তল্লাশি চালানো হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে বেশ কিছুদিন ধরে আশঙ্কাজনকভাবে গরু চুরি বেড়ে যায়। গত এক মাসে প্রায় অর্ধশত চুরির ঘটনা ঘটেছে।
খোজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১০ ফেব্রুয়ারি বিকালে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় ভবেরচর বাসস্ট্যান্ডে মোহাম্মদ আলী প্লাজা থেকে আব্দুল্লাহপুরে যাওয়ার রাস্তায় অস্ত্রধারী চার সদস্যের একটি ডাকাত দল কাঠ ব্যবাসয়ী ইয়াজ উদ্দিনকে পিস্তল ঠেকিয়ে ও ছুরিকাঘাত করে ২ লাখ টাকা নিয়ে যায়।
এ বিষয়ে গজারিয়া থানার ওসি আনোয়ার আলম আজাদ জানান, ঘটনাটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
গত ৯ ফেব্রুয়ারি রাতে কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বালুরঘাটে প্রায় ১ লাখ টাকা ডাকাতির অভিযোগ পাওয়া গেছে।
৬ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার রাতে ফেনীর সোনাগাজী পৌরসভার গ্রিল কেটে ভেতরে ঢুকে আলমারিতে থাকা টাকা লুট করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
সোনাগাজী পৌরসভার প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুল হাসান বলেন, আলমারি থেকে ১ লাখ ৮৫ থেকে ৯০ হাজার টাকার মতো লুট করে নিয়ে যায়।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি বুধবার রাতে নাটোরের বড়াইগ্রামের আগ্রাণ গ্রামে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে দুই ভাইয়ের বাড়িতে দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে।
রাত দেড়টার দিকে সাত-আটজনের একটি ডাকাত দল প্রথমে বাবলুর দরজায় নক করে। এ সময় নিজেদের কেউ ডাকছে ভেবে দরজা খুলে দিলে তারা বাড়ির সদস্যদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে।
এরপর তাদের দুই পরিবারের আলমারি ভেঙে নগদ সাড়ে ৪ লাখ টাকা ও মোট ৬ ভরি স্বার্ণলংকারসহ কয়েকটি বিদেশি কম্বল নিয়ে যায় ডাকাতেরা।
গত ৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সাভারের রাজফুলবাড়িয়া মোহাম্মদ আলী স্কুলের বিপরীতে প্রবাসী এমদাদুল হকের বাড়িতে ঢুকে অস্ত্রের মুখে পরিবারের সবাইকে জিম্মি করে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার লুট করে দুর্বৃত্তর।
গত ১ ফেব্রুয়ারি শনিবার গভীর রাতে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে চরপাতা গ্রামে গোয়ালঘরের দেয়াল ভেঙে তিনটি গরু নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, তিনটি গরুর বাজারমূল্য প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টাকা। ইউপি সদস্য ছালেহ আহমেদ লিটন জানান, গোয়ালঘরের দরজায় তালা দেওয়া ছিল।
তালা কিংবা দরজা ভাঙা হয়নি। দেওয়াল ভেঙে তার তিনটি গরু ডাকাতি করে নিয়ে গেছে। এর মধ্যে একটি গরু দিনে ৮-১০ কেজি দুধ দিত।
গত ১ ফেব্রুয়ারি ভোররাতে গাজীপুর দক্ষিণ বারতোপা (বাবুবাজার) গ্রামের শিক্ষিকা শাম্মী আক্তারের বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ১০-১৫ জনের একদল ডাকাত বারান্দার গ্রিলের তালা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করে।
ডাকাতেরা গৃহকর্তা শাওনকে হাত-পা বেঁধে মাথার ওপর রাম দা ধরে গৃহকর্তার স্ত্রী শিক্ষিকা শাম্মী আক্তারকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ৫০ হাজার টাকা, ৮ ভরি স্বর্ণালংকার, তিনটি স্বর্ণের চেইনসহ মালামাল লুটে নেয় ডাকাতেরা।
গত ৩০ জানুয়ারি বরিশালের মহানগরীর বিমানবন্দর থানার গড়িয়ারপার নিজাম কাজীর বাড়িতে বাসার গ্রিল কেটে নগদ প্রায় ৪ লাখ টাকা ও ছয় ভরি স্বার্ণালংকার নিয়ে যায় ডাকাতেরা।
গত ২৫ জানুয়ারি রাতে বরিশালের বাকেরগঞ্জের পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর খান মোহাম্মদ সেলিমের বাসায় চুরির ঘটনা ঘটে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এনামুল হক সাগর বলেন, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও খুনের বিষয় নিয়ে পুলিশ সব সময়ই কাজ করে।
সব সময় চেষ্টা থাকে এই অপরাধগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখার। চুরি-ডাকাতি রোধে সারা দেশের সব ইউনিটের দায়িত্বশীলদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :