রোজার আগে সব বই পাওয়া অনিশ্চিত

উৎপল দাশগুপ্ত

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২৫, ০১:৪৬ এএম

রোজার আগে সব বই পাওয়া অনিশ্চিত

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

চলতি শিক্ষাবর্ষের প্রায় দেড় মাস পেরিয়ে গেলেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সব শিক্ষার্থী এখনো বিনা মূল্যের সব পাঠ্যবই পায়নি।

প্রাথমিক স্তরে এখনো বই বিতরণ বাকি রয়েছে ১৫.৯৯ শতাংশ।

অন্যদিকে মাধ্যমিক স্তরের বই বাকি রয়েছে ৫২ শতাংশ। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ১৭ কোটি বই চলতি মাসের অবশিষ্ট সময়ের মধ্যে ছাপানো সম্ভব নয়।

আগামী ২ মার্চ থেকে স্কুলে শুরু হচ্ছে রোজা ও ঈদুল ফিতরের ছুটি। তাই রোজার আগে সব শিক্ষার্থীর শতভাগ বই পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। 

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সব বই ছাপিয়ে বিতরণের জন্য প্রেসগুলোকে সময় বেঁধে দিয়েছে।

তবে বই ছাপানোর সঙ্গে যুক্ত সূত্রগুলো জানিয়েছে, সব বই ছাপানো শেষ করতে মার্চ মাসও লাগতে পারে।

এনসিটিবি ও সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে বই বিতরণ পরিস্থিতি সম্পর্কে এসব তথ্য জানা গেছে।এদিকে শিক্ষাবর্ষ শুরুর প্রথম থেকেই বইয়ের অভাবে পড়াশোনা ব্যাহত হয়েছে শিক্ষার্থীদের।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও পূর্ণসূচি অনুযায়ী ক্লাস শুরু করা সম্ভব হয়নি। রোজা ও ঈদের ছুটি এবং এসএসসি পরীক্ষা শেষে মে মাস থেকে পূর্ণ গতিতে পুরো শিক্ষা কার্যক্রম চলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সাধারণত স্কুলগুলোতে জুন-জুলাই মাসে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ডিসেম্বরে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আলোচনা চলছে।

সেক্ষেত্রে নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করতে হবে। বইয়ের অভাব এবং বড় ছুটির কারণে শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সিলেবাস শেষ করার জন্য পূর্ণ সময় পাবে না।

এতে সব শ্রেণির শিক্ষার্থীসহ বিশেষভাবে ২০২৬ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের শিখনঘাটতি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন শিক্ষকেরা।

এবার প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪ কোটি ৩৪ লাখ ৩ হাজার ২৮৩।

তাদের জন্য ছাপা হচ্ছে ৪০ কোটি ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ২০২ কপি বই।

প্রাথমিকের ২ কোটি ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৪৭৯ শিক্ষার্থীর জন্য ছাপানো হচ্ছে ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫০ হাজার ৪৯২টি বই।

মাধ্যমিক পর্যায়ের ২ কোটি ২৪ লাখ ৫৮ হাজার ৮০৪ শিক্ষার্থীর জন্য ছাপানো হচ্ছে ৩০ কোটি ৯৬ লাখ ১২ হাজার ৮৪৭ কপি বই।

তাছাড়া দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য সাড়ে ৮ হাজারের বেশি ব্রেইল বই ছাপা হচ্ছে। আর শিক্ষকদের জন্য প্রায় ৪১ লাখ সহায়িকা বই ছাপা হচ্ছে।

বই ছাপানো-সংক্রান্ত এনসিটিবির গত ৯ ফেব্রুয়ারির তথ্য থেকে দেখা গেছে, প্রাথমিকের প্রি-প্রাইমারির ৬২ লাখ ১৮ হাজার ৩৩৪ কপির মধ্যে ছাপা সম্পূর্ণ হয়েছে ৫৫ লাখ ৩০ হাজার কপি।

বই হিসেবে প্রস্তুত হয়েছে ৫২ লাখ ৬৭ হাজার ৩২৬ কপি। উপজেলা পর্যায়ে বিতরণের আগে প্রি-ডেলিভারি ইন্সপেকশন (পিডিআই) শেষ হয়েছে ৫০ লাখ ৩৮ হাজার ৬৩৬ কপি। পিডিআই সম্পূর্ণ হয়েছে ৮১.০৩ শতাংশ। পিডিআই চলছে ১৮.৯৭ শতাংশ।

প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির (৭০ লট) ৩ কোটি ৯ লাখ ৭৪ হাজার ১৪ কপি বইয়ের মধ্যে ছাপা সম্পূর্ণ হয়েছে ৩ কোটি ৯ লাখ ৫০ হাজার ৪৮৮ কপি।

বই হিসেবে বিতরণের জন্য প্রস্তুত হয়েছে ৩ কোটি ৮৫ লাখ কপি। এর মধ্যে পিডিআই শেষ হয়েছে ৩ কোটি ৮৩ লাখ। পিডিআইয়ের হিসাবে ৯৯ শতাংশ। পিডিআই চলছে ১ শতাংশ বইয়ের।

 প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির (২৭ লট) ১ কোটি ২৮ লাখ ৯৩ হাজার ৩৬০ কপি বইয়ের মধ্যে ছাপা সম্পূর্ণ হয়েছে ১ কোটি ২০ লাখ ৩৪ হাজার ৬০০ কপি। বই হিসেবে প্রস্তুত হয়েছে ১ কোটি ১৬ লাখ ৫২ হাজার ৮৩২ কপি। পিডিআই শেষ হয়েছে ১ কোটি ১৫ লাখ ৭৭ হাজার ২৫২ কপি।

পিডিআইয়ের হিসাবে ৮৯.২৯ শতাংশ। পিডিআই বাকি রয়েছে ১০.১ শতাংশ। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ৪ কোটি ৩ লাখ ৬১ হাজার ৪০০ কপির মধ্যে ছাপা হয়েছে ৩ কোটি ৩৪ লাখ ৮ হাজার ৯২৪ কপি। বই হিসেবে প্রস্তুত হয়েছে ৩ কোটি ২৮ হাজার ৩৪০ কপি।

পিডিআই শেষ হয়েছে ২ কোটি ৮৭ লাখ ৩৩ হাজার ৭৯৬ কপি। পিডিআইয়ের হিসাবে ৭১ শতাংশ।

পিডিআই চলছে ২৯ শতাংশ। এছাড়া ভ্যারিয়েশন লট (প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়), ভ্যারিয়েশন লট (চতুর্থ ও পঞ্চম) এবং এমএলই মোট ১৫ লাখ ৩৩ হাজার কপির মধ্যে ছাপা শেষ হয়েছে সাড়ে ১১ লাখ, বই হিসেবে প্রস্তুত হয়েছে ৮ লাখ।

পিডিআই শেষ হয়েছে ৭ লাখ ৭২ হাজার। পিডিআই বাকি দেড় লাখ। পিডিআইয়ের হিসাবে ৮৪ শতাংশ। পিডিআই চলছে ১৬ শতাংশ। 

অন্যদিকে মাধ্যমিক স্তরের ষষ্ঠ ও ইবতেদায়ি (প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়) শ্রেণির ৩ কোটি ৮১ লাখ ৩৭ হাজার ৩৭৩ কপি, সপ্তম শ্রেণির ৩ কোটি ৮ লাখ ৪৪ হাজার ৩৮৪ কপি, অষ্টম শ্রেণির ১ কোটি ৯৩ লাখ ৬১ হাজার ৩০৯ কপি, নবম শ্রেণির ২ কোটি ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৩ কপি এবং দশম শ্রেণি ও ইবতেদায়ির (চতুর্থ ও পঞ্চম) ৫ কোটি ৪৫ লাখ ৩৩ হাজার ১২২ কপিসহ মোট ১৬ কোটি ৩৪ লাখ ৬২ হাজার ১৯১ কপি বই ছাপা শেষ হয়েছে।

এসসব বইয়ের মধ্যে পিডিআই শেষ হয়েছে ১৩ কোটি ৯ লাখ ৪৯ হাজার ১৯৬ কপি। ছাপানো বইয়ের পিডিআই বাকি রয়েছে ৫৭ শতাংশ।

এই হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে, মাধ্যমিক স্তরের শতভাগের মধ্যে এখনো ছাপানো হয়নি ৪৬ শতাংশ।

এদিকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর ও রাজশাহী জেলা শিক্ষা অফিস থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, ঢাকা জেলায় ২ কোটি ১৬ লাখ ৪৫ হাজার ৬০০ কপি বইয়ের চাহিদার বিপরীতে গতকাল বুধবার পর্যন্ত পাওয়া গেছে ১ কোটি ২১ লাখ ২০ হাজার ৭৮৬ কপি।

চট্টগ্রাম জেলায় ১ কোটি ৭৩ লাখ বইয়ের চাহিদার বিপরীতে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত পাওয়া গেছে ৬৪ লাখ ১৪ হাজার ৮৯২ কপি। রংপুর জেলায় ৩৯ লাখ ২১ হাজার ৩০ কপি বইয়ের চাহিদার বিপরীতে পাওয়া গেছে ১১ লাখ ৯০ হাজার ১২৭ কপি।

রাজশাহী জেলা শিক্ষা অফিস বই চাহিদার তথ্য দিতে পারেনি। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত এই জেলায় ১৭ লাখ ২০ হাজার ১৯২ কপি বই বিতরণের তথ্য পাওয়া গেছে। রাজশাহী ছাড়া বাকি তিন জেলার চাহিদার বিপরীতে গড় হিসেবে বই পৌঁছেছে ৫০ শতাংশের কম।

রাজধানীর রমনা থানা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, এই এলাকার অন্তর্ভুক্ত ৪১টি স্কুলের অষ্টম ও দশম শ্রেণির সব বই পেয়েছে শিক্ষার্থীরা। তবে ষষ্ঠ, সপ্তম ও নবম শ্রেণির মোট বইয়ের মধ্যে ৪০ শতাংশ এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে।

রাজধানীর মতিঝিল অঞ্চলের একটি সরকারি বালিকা বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত রোববার পর্যন্ত ওই স্কুলের চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে তিনটি এবং ষষ্ঠ, সপ্তম ও নবম শ্রেণিতে চারটি বই পেয়েছে। তবে অষ্টম শ্রেণির সব শিক্ষার্থী সব বই পেয়েছে। আর দশম শ্রেণির ব্যবসা শাখার শিক্ষার্থীরা দুটি ছাড়া সব বই পেয়েছে।

অন্যদিকে কল্যাণপুর গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ সূত্র জানিয়েছে, প্রাথমিকের চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা অনেক বই পায়নি। তবে দশম শ্রেণির সব শিক্ষার্থীই সব বই পেয়েছে।

বই দেরিতে পাওয়ায় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সিলেবাস শেষ করা বা শিক্ষার্থীদের শিখনঘাটতির শঙ্কার বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মতিঝিলের সরকারি বালিকা বিদ্যালয়, কল্যাণপুর গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের একাধিক শিক্ষক।

বইয়ের অভাবে শিক্ষার্থীদের বড় ধরনের শিখনঘাটতি হবে না বলে কেউ কেউ মত প্রকাশ করলেও বিষয়টি নিয়ে ভিন্নমতও রয়েছে।

বই বিতরণের বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা কবে নাগাদ সব বই পেতে পারে, সে বিষয়ে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির (বিএমএসএস) সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সব বই শেষ করতে মার্চ মাসের পুরো সময়টাই লাগবে বলে মনে হচ্ছে।

ছাপা মেশিনের আসল সক্ষমতার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ সক্ষমতা দিয়ে এনসিটিবি টেন্ডার করায় বই ছাপার পরিস্থিতি জটিল হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, যেসব বইয়ের সংশোধন-পরিমার্জন প্রয়োজন ছিল না যেমনÑ কৃষি শিক্ষা, শারীরিক শিক্ষা, পদার্থবিজ্ঞানসহ ইত্যাদি বই আগে টেন্ডার করে ছাপা শুরু করা যেত।

এসব বই ছাপা হতে হতে সংশোধন-পরিমার্জনের কাজ শেষ করে বাকি বইগুলোও ছাপার প্রক্রিয়ায় চলে আসত। তাতে ছাপার কাজে চাপ পড়ত না।

চলতি শিক্ষাবর্ষের বই নিয়ে উদ্ভূত এই পরিস্থিতি তৈরির দায় কার, সে বিষয়ে তদন্ত করা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিএমএসএসের সাবেক সভাপতি।

তবে ফেব্রুয়ারির মধ্যেই সব বই ছাপা শেষ করে বিতরণ শেষ হবে বলে জানিয়েছেন এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান।

মাধ্যমিকের মোট ৩১ কোটি বইয়ের মধ্যে ইতিমধ্যে প্রায় ২২ কোটি বই ছাপা শেষ। ছাপা হওয়া এসব বইয়ের মধ্যে ৪ কোটি বই বাঁধাইয়ের জন্য প্রস্তুত।

যেসব বিষয়ের পরীক্ষা হয় না যেমন-চারু ও কারু সেসব বই পরে ছাপা হবে। এছাড়া অন্যান্য বই পাতলা সাইজের। এগুলো ছাপতে বেশি সময় লাগবে না।

চেয়ারম্যান বলেন, দযেসব প্রেস ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তাদের ছাপানো বা বাঁধাইয়ের কাজ শেষ করতে পারবে না, সেই প্রেসগুলোর কাজ যারা ইতিমধ্যে নিজেদের কাজ শেষ করে ফেলেছে তাদের দিয়ে করানো হবে। ভালোভাবে বইয়ের কাজ শেষ করার জন্য যা করা দরকার আমরা তা-ই করছি।’

আরবি/জেডআর

Link copied!