ঢাকা বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

গোপনে দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বিক্রি

শাহীনুর ইসলাম শানু
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৫, ১২:৩৯ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ডরিন পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড সিস্টেমস লিমিটেড আওয়ামী লীগ পরিবারের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী ও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত একটি কোম্পানি। যার নেতৃত্বে যশোরের নূরে আলম সিদ্দিকীর পরিবার।

প্রতিষ্ঠানের ৬৬ মেঘাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার ৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র কাগজে থাকলেও এখন উৎপাদনে নেই। 

উৎপাদন না থাকায় গোপনে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে টাঙ্গাইল ও ফেনীর ৪৪ মেঘাওয়াটের দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সব যন্ত্রাংশ ২০ কোটি ১০ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে।

একই সঙ্গে মানিকগঞ্জের নদীর তীরে অবস্থিত তৃতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রটিও জমিসহ বিক্রির পাঁয়তারা চলছে।

দুটি কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি রূপসী বাংলাদেশ গ্রুপ ও ট্রাস্ট মেরিন সার্ভিসেস নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করা হয়েছে।

কেন্দ্রগুলোর সব যন্ত্রাংশ বিক্রির আগে তৃতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্ভাব্য মূল্য যাচাই করা হয়নি।

একইসঙ্গে উন্মুক্ত দর আহ্বান না করে, আদালতের প্রক্রিয়া অসম্পন্ন রেখে এবং বিনিয়োগকারীদের অনুমোদন ছাড়াই তড়িঘড়ি করে বিক্রি করা হয়েছে।

তবে ডরিন কোম্পানির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিধিসম্মতভাবেই কোম্পানি আইনের বলেই সব যন্ত্রাংশ বিক্রি করা হয় এবং রেগুলেটরি বডি এ বিষয়ে অবগত রয়েছে।

একইসঙ্গে ডরিন পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড সিস্টেমস লিমিটেডের ২২৫ মেগাওয়াটের আরও তিনটি সহযোগী বিদ্যুৎকেন্দ্র সচল রয়েছে।

সেগুলো হচ্ছে-নবাবগঞ্জে অবস্থিত ঢাকা সাউদার্ন পাওয়ার জেনারেশন, মানিকগঞ্জে অবস্থিত ঢাকার নর্দার্ন পাওয়ার জেনারেশন ও চাঁদপুর পাওয়ার জেনারেশন। সহযোগী তিনটির চুক্তির মেয়াদ ২০৩০ সালের পর শেষ হবে।

মানিকগঞ্জ পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেড জমিসহ যন্ত্রাংশ বিক্রিসহ আরও তথ্য জানতে চাইলে কোম্পানি সচিব মো. আমজাদ শাকিল (এফসিএ) রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ যা ভালো মনে করেছে, তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

তবে রেগুলেটরি বডি এ বিষয়ে অবগত আছে। তাই এ বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই’।

তবে তৃতীয় পক্ষের দ্বারা সম্ভাব্য মূল্য যাচাই ও বিনিয়োগকারীদের অনুমতি ছাড়া ২০ কোটিতে দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সব যন্ত্রাংশ বিক্রি করা বিধিসম্মত হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিধিসম্মতভাবেই হয়েছে। 

আরও প্রশ্ন থাকলে আপনি লিখে ই-মেইলে আমাকে পাঠান, উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব’ বলেন আমজাদ শাকিল।

ডরিন পাওয়ারের আরও এক কর্মকর্তা অফিস পরিদর্শন ও সাক্ষাতের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘এসব যন্ত্রাংশ মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে, যার কারণে স্ক্রাব আকারে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া এসবের ব্যয় বহন করাও কোম্পানির পক্ষে সম্ভব নয়’ বলে তিনি জানান।

তবে ‘মেয়াদোত্তীর্ণ যন্ত্রাংশ দিয়ে দ্বিতীয়বার বিদ্যুৎ উৎপাদনের আবেদন’ করার পদ্ধতি কতটা সঙ্গতিপূর্ণ জানতে চাইলে তিনি মহাখালী ডিওএইচএস অফিসে আসার আহ্বান জানান।

২০১৬ সালে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ডরিন পাওয়ার কোম্পানি।

তার আগে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরই বিদ্যুৎ ব্যবসায় নামেন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ঝিনাইদহ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাহজীব আলম সিদ্দিকী। 

তার বাবা নূরে আলম সিদ্দিকী ছিলেন আওয়ামী পরিবারের শীর্ষ নেতা ও যশোরের সংসদ সদস্য। কোম্পানির চেয়ারম্যান হলেন তাহজীব আলম সিদ্দিকীর স্ত্রী আনজাবিন আলম সিদ্দিকী।

শীর্ষ নেতা নূরে আলম সিদ্দিকীর হাত ধরেই ২০০৯ সালে ১৫ বছরের জন্য বিদ্যুৎ বিক্রয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়।

এরপরে আওয়ামী লীগ আমলেই ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৬৬ মেঘাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার ৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হয়।

সে সময়ে আওয়ামী সরকারের পক্ষ থেকে নতুন করে চুক্তির কার্যক্রম এগিয়ে গেলেও আগস্টের পরে তা ভেস্তে যায়। যার কারণে জুলাই বিপ্লবে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরে তড়িঘড়ি করে মাত্র ২০ কোটি ১০ লাখ টাকায় গোপনে বিক্রি করেন মালিকপক্ষ।

তৃতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র ‘মানিকগঞ্জ পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেড’ মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলায় অবস্থিত। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রবল ক্ষমতার উৎসে থাকায় ধলেশ্বরী নদীর প্রবাহ বিঘ্নিত করে বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে।

গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে এটিরও উৎপাদনের মেয়াদ শেষ হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে জমিসহ এখন সেই তৃতীয় কেন্দ্রের যন্ত্রাংশ গোপনে বিক্রির চেষ্টা করছে কর্তৃপক্ষ।

তবে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জেলহাজতে থাকায় বিক্রির কার্যক্রমে ব্যাহত হচ্ছে।

এদিকে, যন্ত্রাংশ বিক্রি ও উৎপাদনে না থাকায় কোম্পানির মুনাফা কমায় হতাশায় ভুগছেন বিনিয়োগকারীরা। যার কারণে সরকার পতনের পরে যন্ত্রাংশ বিক্রি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা।

বিক্রির পদ্ধতি সম্পর্কে দেশের শীর্ষ একটি মার্চেন্ট ব্যাংক কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধে প্রতিবেদককে বলেন, ‘তৃতীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মূল্য যাচাই শেষে উন্মুক্ত দর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিক্রি পদ্ধতির প্রয়োজন ছিল।

অন্যদিকে, বিনিয়োগকারীদের অনুমতিরও বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।’

বিক্রির প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মতিন পাটোয়ারি বলেন, ‘কোম্পানি আইনে তারা কোন প্রক্রিয়ায় বিক্রি করেছে, তা আমি অজ্ঞাত।

তবে আদালতের মাধ্যমে বিক্রি করা হলে অভিযোগ এড়ানো যেত। এখানে সম্ভাব্য মূল্য যাচাই প্রক্রিয়ায় তৃতীয় প্রতিষ্ঠান থাকাও যৌক্তিকতা রাখে’ বলেন তিনি।

আরও তথ্য জানতে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে ফোন দিলে তাকে পাওয়া যায়নি। 

‘কোম্পানির মালিক শেয়ারহোন্ডার। তাই ইজিএমের মাধ্যমে শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদনের প্রয়োজন ছিল।

এর বাইরে কোনো ব্যত্যয় হলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে’ বলেন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম।

কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের সংরক্ষণে ৬৬.৬১ শতাংশ শেয়ারের থাকলেও ডিএসইতে দর কমে ২২.৭০ টাকায় নেমেছে। আওয়ামী সরকারের আমলে গত ফেব্রুয়ারিতে দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়।

দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ নতুন করে আর বাড়বে না, এমন আশঙ্কায় যন্ত্রপাতি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে বলে তথ্য প্রকাশ করেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)।

তবে আইপিওকালীন আয়ের উৎস হিসেবে দেখানো কোম্পানির সম্পদ এজিএম বা ইজিএম ছাড়াই বিক্রি করে দেওয়ায় অভিযোগ করেন কয়েকজন বিনিয়োগকারী।

ডিএসইর তথ্যানুসারে ফেনীর ২২ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং টাঙ্গাইলের ২২ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটির যন্ত্রপাতি সরকার পতনের পরে বিক্রি করা হয়েছে। 

২০০৯ সালে সরকার গঠনের পরে ব্যবসায় তৎপর হয়ে ওঠেন তাহজীব আলম সিদ্দিকী। সরকার পতনের পরে ৭ নভেম্বর রাতে ঢাকার সাভারে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ঝিনাইদহে জামায়াতে ইসলামির কর্মী আবদুস সালামকে হত্যার ১১ বছর পরে মামলার প্রধান আসামি করা হয় তাকে। ঝিনাইদহ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ছিলেন তিনি।

২০১৪ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। এরপরে ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত ছিলেন তিনি।

তার বাবা নূরে আলম সিদ্দিকী বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ছিলেন। তার পৈতৃক বাড়ি ঝিনাইদহ জেলার ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কাঞ্চনপুরের উত্তরপাড়ায়।

তিনি যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোক প্রশাসনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

ডরিন পাওয়ারের তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ ফেব্রুয়ারি মাসেই শেষ হয়েছে।

বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো হলো-টাঙ্গাইল, ফেনী ও নরসিংদী পাওয়ার প্ল্যান্ট। প্রতিটির উৎপাদনক্ষমতা ২২ মেগাওয়াট করে মোট ৬৬ মেগাওয়াট। ২০০৯ সালে আওয়ামী সরকার গঠনের পরে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) সঙ্গে ডরিন পাওয়ার ১৫ বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়।

আওয়ামী সরকারের আমলের ফেব্রুয়ারিতে তিনটির চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। সরকার পতনের পরে তা ব্যর্থ হলে যন্ত্রাংশ বিক্রি করে দেন।

এখন গোপনে জমিসহ তৃতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র বিক্রির পাঁয়তারা চলছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।