বার্ষিক লাইসেন্স ফি, রেভিনিউ শেয়ারিং, অপ্রদর্শিত ডাউনস্ট্রিম ব্যান্ডউইথ, সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল এবং মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বাবদ ৩০টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) অপারেটরের কাছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) বকেয়া অর্থের পরিমাণ ২২০ কোটি টাকারও বেশি।
এই বকেয়ার সিংহ ভাগই অপ্রদর্শিত ডাউনস্ট্রিম ব্যান্ডউইথ বিক্রির রেভিনিউ শেয়ারিংয়ের। তবে অপারটেরগুলোকে বকেয়া পরিশোধে চিঠি দেওয়া হলেও আদায় হয়েছে মাত্র ১৫ কোটি ১৭ লাখ, যার সামান্যই ব্যান্ডউইথ বাবদ। তদন্ত, রিভিউ এবং ডিমান্ড নোট ইস্যুর পর ব্যান্ডউইথের হিসাব সংশোধন করে পুনরায় চিঠি দেওয়ার নতুন আবেদন নিয়ে কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছে অপারেটরগুলো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিটিআরসির পাওনা আদায়কে অনিশ্চিত করতেই মীমাংসিত বিষয়ে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে। এদিকে বকেয়া পরিশোধের চিঠির কোনো জবাবই দেয়নি ছয়টি অপারেটর, যার মধ্যে দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান।
ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী (আইএসপি) প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া ব্যান্ডউইথ আইআইজির জন্য ডাউনস্ট্রিম ব্যান্ডউইথ। রেগুলেটরি অ্যান্ড লাইসেন্সিং গাইডলাইন অন আইআইজি সার্ভিসেসের অনুচ্ছেদ ১৬.০৩ (ডি) অনুযায়ী, এই ব্যান্ডউইথ বিক্রির আয় থেকে একটি অংশ রেভিনিউ শেয়ারিং বাবদ বিটিআরসিকে দিতে হয় আইআইজিদের।
কিন্তু দীর্ঘদিন যাবত ‘ব্যাকআপ ব্যান্ডউইথে’র নামে বিক্রি করা ব্যান্ডউইথের একটি বড় অংশ অবিক্রিত দেখিয়ে আসছিল আইআইজিগুলো। ২০২১ সালে বিটিআরসির সাবেক চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদারের সময় বিষয়টি প্রথম ধরা পড়ে। সে সময় অপ্রদর্শিত ডাউনস্ট্রিম ব্যান্ডউইথের রেভিনিউ শেয়ারিং বাবদ ১০৯ কোটি টাকারও বেশি বিটিআরসির পাওনা নির্ধারিত হয়।
তবে বিটিআরসির তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান ও পরবর্তীতে চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মহিউদ্দিন আহমেদের অসহযোগিতায় এই পাওনা আদায় করতে পারেনি কমিশন। পরবর্তীতে কয়েক দফা মূল্যায়নের পর পাওনা নির্ধারিত হয় ৬২ কোটি ৩০ লাখে। এর ওপর মূসক ৯ কোটি ৩৫ লাখ এবং বিলম্ব ফি ৩০ কোটি মিলিয়ে ডাউনস্ট্রিম ব্যান্ডউইথ বাবদ আইআইজিগুলোর কাছে বিটিআরসির পাওনা ১০১ কোটি ৬৫ লাখ।
কয়েক দফা তদন্ত এবং রিভিউয়ের পর আইআইজি অপারেটরগুলোকে বিটিআরসির বকেয়া পরিশোধে ‘ডিমান্ড নোট’ও ইস্যু করা হয়। ডাউনস্ট্রিম ব্যান্ডউইথ বাবদ তিনটি প্রতিষ্ঠান ‘আমরা টেকনোলজিস’, ফাইবার অ্যাট হোম গ্লোবাল এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি (বিএসসিসিএল) নিজেদের বকেয়া পরিশোধ করেছে।
ব্যান্ডউইথসহ অন্যান্য খাতের বকেয়া বাবদ পাওনা আদায় না হওয়ায় গত ডিসেম্বরে অপারেটরগুলোকে চিঠি দেয় বিটিআরসি। এ বিষয়ে গত ৩০ ডিসেম্বর এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে রূপালী বাংলাদেশ। গত ১৭ জানুয়ারির মধ্যে বকেয়া অর্থ পরিশোধ করতে বলা হয় চিঠিতে। তবে এই চিঠির কোনো জবাবই দেয়নি ছয়টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান দুটি হলোÑ বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) এবং বিএসসিসিএল।
প্রাইভেট খাতের বাকি চারটি আইআইজি হলো- নভোকম, রেগো, ওয়ান এশিয়া এবং প্ল্যানেট। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর কেউই অপ্রদর্শিত ব্যান্ডউইথের বকেয়া পরিশোধ করেনি। উপরন্তু, বকেয়া পরিশোধে কালক্ষেপণ করতে কমিশনে হরেকরকম আবদার করে চিঠি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
যেমন, কমিশনের ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশন্স (ইঅ্যান্ডও) বিভাগের দেওয়া চিঠির জবাবে হিসাব সংশোধন করে পুনরায় চিঠি দিতে কমিশনে নোট প্রদান করে সাতটি প্রতিষ্ঠান- আর্থ টেলিকম, গ্লোবাল ফেয়ার, বিডি লিঙ্ক, লেভেল-৩, উইন্ডস্ট্রিম এবং স্কাইটেল। নোটের প্রেক্ষিতে হিসাব সংশোধন করে অপারেটরগুলোকে চিঠি দিয়েছে কমিশন।
চিঠিতে গত ৩১ জানুয়ারির মধ্যে বকেয়া পরিশোধের কথা থাকলেও, সর্বশেষ তথ্যমতে, এখনো বকেয়া পরিশোধ করেনি অপারেটরগুলো। গাইডলাইনে না থাকা এবং হিসাব ত্রুটিপূর্ণ মনে হওয়ার অজুহাতে সংশোধনের আবেদন করেছে ছয়টি অপারেটর- ডেল্টা, ম্যাক্সহাব, স্টারট্রেক, এক্সাবাইট, সাইবারগেট এবং এডিএন টেলিকম।
বিলম্ব ফি’র ৬৬ লাখ টাকা মওকুফ করে অপ্রদর্শিত ব্যান্ডউইথ বকেয়ার ৪৯ লাখ টাকা ছয়টি মাসিক কিস্তিতে পরিশোধের আবেদন করেছে বিডিহাব। চলতি ফেব্রুয়ারির মধ্যে অর্ধেক এবং বাকি বকেয়া এপ্রিলের মধ্যে পরিশোধের আবেদন করেছে ভার্গো কমিউনিকেশন। ৩০ লাখ বকেয়া ৩০টি মাসিক কিস্তিতে পরিশোধের আবেদন করেছে গ্লোবাল ফেয়ার কমিউনিকেশন।
এ ছাড়াও ব্যান্ডউইথসহ সব ধরনের বকেয়া পরিশোধে ইন্ট্রাগ্লোব এক মাস, ম্যাক্সনেট অনলাইন তিন মাস এবং ভেলোসিটি নেটওয়ার্ক কোনো সময়সীমা ছাড়াই ‘পর্যায়ক্রমে’ পরিশোধের আবেদন করেছে। বকেয়া পরিশোধে বিটিআরসির চিঠির প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতে রিট করেছে আরেক আইআইজি অপারেটর পিয়ারেক্স নেটওয়ার্ক। রিটের প্রেক্ষিতে বিটিআরসির চিঠির ওপর তিন মাসের স্থগিতাদেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত।
অপ্রদর্শিত ব্যান্ডউইথ পাওনা আদায়ের সব ধাপ শেষে বকেয়া পরিশোধের বদলে হিসাব সংশোধনে আইআইজি অপারেটরদের আবেদনকে কালক্ষেপণের পরিকল্পনা হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিটিআরসির সাবেক কমিশনার (অর্থ ও বাণিজ্য) ড. মুশফিক মান্নান চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ২০২১ সালে সাবেক চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর শিকদারের আমলে যখন বিষয়টি ধরা পড়ে, তখন থেকেই আইআইজিগুলো বকেয়া পরিশোধে কালক্ষেপণ করছিল।
২০২৩ সালের (এপ্রিলে) গণমাধ্যমে আসলে বিষয়টি কমিশন সভায় ওঠে। অপ্রদর্শিত ব্যান্ডউইথের বিষয়ে তদন্ত হয়েছে, ইঅ্যান্ডও উইংয়ের মহাপরিচালক এর রিভিউ করেছেন, আইআইজিদের সঙ্গে কমিশনের আলোচনা হয়েছে। রিভিউ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কমিশন অনুমোদন দিল যে, এই অর্থ সংগ্রহ করা হবে। এখন যখন পাওনা আদায়ে বিটিআরসি তৎপর হয়েছে, তখন নতুন একটি প্রেক্ষাপট তৈরি করা হচ্ছে।
মীমাংসিতা বিষয়ে আবার সংশোধনের আবেদন কালক্ষেপণেরই অংশ। আর এমনটা হলে, ক্ষেত্রবিশেষে পাওনা আদায় অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে। যেমন কোনো প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যেতে পারে, কারো লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হতে পারে, সে হয়তো আর নবায়ন করবে না। এমনটা হলে বিটিআরসির পাওনা আদায় অনিশ্চিত হয়ে যাবে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিটিআরসির সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মহিউদ্দিন আহমেদ দীর্ঘদিন আইআইজিদের পাওনা আদায় প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করছিলেন। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের পতন হলে, বিটিআরসির চেয়ারম্যান পদ হারাতে হয় একসময় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ শাখার সাবেক সভাপতি থাকা প্রকৌশলী মহিউদ্দিন আহমেদকে।
তবে অপারেটরদের সঙ্গে পৃথকভাবে বসতে চাওয়ার বিটিআরসির সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছে আইআইজি অপারেটরগুলো। অপারেটরগুলোর সংগঠন আইআইজিএবির সভাপতি আমিনুল হাকিম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এমন একটা বিষয় যার হিসাব আগে হয়েছে, অপারেটরগুলো রেভিনিউ শেয়ারিং দিয়েছে, ভ্যাট দিয়েছে; সে রকম বিষয়ে হঠাৎ করে একটা সিদ্ধান্ত কেউ দিতে পারে না।
যা আগে থেকে অবৈধ ছিল না, সেটিকে নতুন করে বেআইনি বলা যাবে না। একইরকম ঘটনা ঘটেছে আইআইজিদের সঙ্গে ডাউনস্ট্রিম ব্যান্ডউইথ নিয়ে। কেউ কেউ হয়তো ব্যান্ডউইথে কিছুটা হেরফের করেছে, তবে সেটা ৫ থেকে ১০ শতাংশের বেশি না। আর সেটিও করতে হয়েছে গ্রাহক ধরে রাখতে।
যেমন- ১০০ জিবিপিএস (গিগাবিট প্রতি সেকেন্ড) ব্যান্ডউইথ নেওয়া গ্রাহককে উন্নত সেবা দিতে সঙ্গে ২০ জিবিপিএস বেশি ব্যান্ডউইথ দেওয়া হয়েছে, ক্যাশ সার্ভারের জন্য। কোনো গ্রাহক হয়তো ব্যান্ডউইথ নিয়েছে আমাদের থেকে, কিন্তু বিল পরিশোধ না করেই ব্যাবসায়িক কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে।
তাহলে এই ব্যান্ডউইথের বিপরীতে কী রেভিনিউ (রাজস) পেলাম? যদি রেভিনিউ নাই-ই পাই, তাহলে বিটিআরসির সঙ্গে শেয়ার করব কী? এ ধরনের একেক ঘটনা আছে একেক প্রতিষ্ঠানের। বিটিআরসি অপারেটরগুলোর সঙ্গে পৃথক করে বসলে এসব কেস স্টাডি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে।
এ বিষয়ে বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আগামী সপ্তাহের (চলতি সপ্তাহে) কমিশন সভায় বিষয়টি উঠবে এবং সেখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে। ক্যাশ সার্ভারের জন্য কতটুকু ব্যান্ডউইথ আলাদা থাকবে (আইআইজিদের বক্তব্য অনুযায়ী), সে বিষয়টি আগে নির্ধারিত ছিল না। কাজেই সেটিকে হালনাগাদ করে হিসাব সংশোধন করা হয়েছে। কারো ওপর কোনোকিছু চাপিয়ে দেওয়া হবে না। অযৌক্তিক কিছু থাকলে সেটিকে যৌক্তিক করা হবে। কাজেই বিটিআরসির পাওনা আদায়ে কোনো অনিশ্চয়তা দেখা দেবে না।
আপনার মতামত লিখুন :