কারিকুলাম বাস্তবায়নের নামে ফের লুটপাটের আয়োজন

সেলিম আহমেদ

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৫, ০৯:১৯ এএম

কারিকুলাম বাস্তবায়নের নামে  ফের লুটপাটের আয়োজন

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন শিক্ষা কারিকুলাম বাস্তবায়নে ২০২২ সালের ১ হাজার ৮৫৫ কোটি ৮২ লাখ টাকার একটি স্কিম হাতে নিয়েছিল মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। ‘ডিসেমিনেশন অব নিউ কারিকুলাম’ নামের এই স্কিমের মাধ্যমে শিক্ষা কারিকুলামটি বাস্তবায়নের জন্য ব্যয় করা হয়েছিল ৮২৮ কোটি টাকা। যদিও এই টাকার বেশির ভাগই প্রশিক্ষণের নামে লুটপাট হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সেই কারিকুলামটি বাতিল করে পুরোনো অর্থাৎ সৃজনশীল কারিকুলামে ফেরত যায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এবার সেই সৃজনশীল কারিকুলামটি বাস্তবায়নে শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের জন্য আবারও ১ হাজার ৮৩৭ কোটি ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দের জন্য স্কিম প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। তবে পুরোনো কারিকুলাম বাস্তবায়নের জন্য এই বরাদ্দের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। 


সম্প্রতি মাউশির মহাপরিচালকের কাছে নতুন এই স্কিমটি পর্যালোচনা করার জন্য পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়াও ‘ডিসেমিনেশন অব নিউ কারিকুলাম’ নামটি পাল্টে স্কিমটির নতুন নাম নির্ধারণ করা হয়েছে ‘ডিসেমিনেশন অব ন্যাশনাল কারিকুলাম স্কিম’। 
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মাধ্যমিক শিক্ষার মনোন্নয়নের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (এসইডিপি) প্রোগ্রাম হাতে নেয়। প্রোগ্রামটির সিংহভাগ অর্থই ছিল বিশ্বব্যাংক থেকে লোন নেওয়া। এই প্রকল্পের মাধ্যমেই নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের জন্য ২০২২ সালে ‘ডিসেমিনেশন অব নিউ কারিকুলাম’ স্কিমটি হাতে নেয়। স্কিমটির মাধ্যমে কারিকুলাম বাস্তবায়নের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলার করার কথা।

পুরোনো কারিকুলাম বাস্তবায়নে কেন এত টাকা প্রয়োজন? বর্তমানে যে কারিকুলামের আলোকে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করানো হচ্ছে তাও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ আমলে করা। ২০১২ সালে শুরু হওয়া সৃশনশীল কারিকুলামের আলোকে প্রায় এক দশকের বেশি সময় শিক্ষার্থীদের পাঠদান করানো হয়েছে। 

২০২৩ সালে সেই কারিকুলাম বাতিল করে নতুন কারিকুলামের আলোকে পাঠদান শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকার। সেই নতুন কারিকুলামটি বাস্তবায়নের জন্য স্কিমটি ছিল ১ হাজার ৮৫৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা। কিন্তু এবার পুরোনো কারিকুলাম বাস্তবায়নের জন্য কেন আবারও ১ হাজার ৮৩৭ কোটি ১৫ লাখ টাকা লাগবে সেই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত এই টাকা হরিলুট করার আয়োজন চলছে। কারণ অধিকাংশ শিক্ষকই সৃজনশীল সম্পর্কে অবগত। তাদের সৃজনশীলের আলোকে পাঠদান করানোর জন্য ব্যাপকভাবে প্রশিক্ষিতও করা হয়েছিল। 

তারা বলেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে শুরু হওয়ায় ৫ বছরের ‘ডিসেমিনেশন অব নিউ কারিকুলাম’ স্কিমটি ২০২৬-২৭ অর্থবছরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নতুন কারিকুলাম বাতিলের পর আরও দুই অর্থবছর প্রকল্পের মেয়াদ থেকে যায়। এই স্কিমটির মেয়াদ শেষ করার জন্য মূলত প্রকল্পের নাম সংশোধন করে লুটপাটের এই আয়োজন চলছে। 


প্রকল্পের প্রস্তাবনা থেকে দেখা যায়, এই দুই বছরে ১১টি ক্যাটাগরিতে ৪ লাখ ২৫ হাজার ৭০৩ জন শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষনের পেছনে ব্যয় হবে ৭৮৩ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। আর ১৪টি ক্যাটাগরিতে বিভিন্ন কর্মশালার পেছনে ব্যয় হবে ৫ কোটি ৪৫৫ লাখ টাকা। বাকি টাকা ব্যয় হবে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, বাসাভাড়া, শিক্ষা ভাতাসহ অন্য ভাতা, সভাসমাবেশ আয়োজন, অফিস সরঞ্জাম, অফিস খরচ, যাতায়াত খরচসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাতে। 

লুটপাটের আয়োজনে বিতর্কিত সেই কর্মকর্তা সৈয়দ মাহফুজ আলী: আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বিভিন্ন দপ্তর-উপদপ্তর থেকে আওয়ামী লীগপন্থি বিতর্কিত কর্মকর্তাদের সরানো হলেও থেকে গেছেন ডিসেমিনেশন অব নিউ কারিকুলামের স্কিম পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ মাহফুজ আলী। তার আমলে স্কিমটিতে প্রশিক্ষণের নামে ব্যাপক লুটপাট হয়েছিল। এবার তিনি স্কিমটির নাম পাল্টানোর প্রস্তাব এনে নতুন করে ১ হাজার ৮৩৭ কোটি ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দিয়েছেন। 


সূত্রমতে, অধ্যাপক সৈয়দ মাহফুজ আলী সব সরকারের আমলেই শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে কাজ করেছেন। সরকারি কলেজের শিক্ষক হলেও তিনি সবচেয়ে বেশি সময় চাকরি করেছেন এনসিটিবিতে। সেখান থেকে তাকে একটি কলেজে বদলি করা হলেও তিনি আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রভাবশালী এক নেতার মাধ্যমে তদবির করে ২ হাজার কোটি টাকার এ স্কিমের পরিচালকের পদ বাগিয়ে নেন।
সংশ্লিষ্টরা জানা, ডিসেমিনেশন অব নিউ কারিকুলাম স্কিমটির ৮২৮ কোটি টাকা সৈয়দ মাহফুজ আলী নিজের খেলালখুশিমতো ঘনিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে মিলেমিশে খরচ করেছেন। এর মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রশিক্ষণের নামে খরচ করা হয়েছে ২৫৪ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছর খরচ করা হয়েছে ৫৭৪ কোটি। শিক্ষার্থীদের নামমাত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে এই টাকা খরচ করা হয়। আবার প্রশিক্ষণ দেওয়া বছরের শেষার্ধে এসে। অভিযোগ রয়েছে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমেই স্কিমটির তালিকা তৈরি করতেন সৈয়দ মাহফুজ আলী। 


ডিসেমিনেশন অব নিউ কারিকুলামেও চলে লুটপাট: সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মাধ্যমিক শিক্ষার মনোন্নয়নের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (এসইডিপি) হাতে নেয়। প্রোগ্রামটির সিংহভাগ অর্থই ছিল বিশ্বব্যাংক থেকে লোন নেওয়া। এই প্রকল্পের মাধ্যমেই নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের জন্য ২০২২ সালে ‘ডিসেমিনেশন অব নিউ কারিকুলাম’ স্কিমটি হাতে নেয়। 

স্কিমটির মাধ্যমে কারিকুলাম বাস্তবায়নের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলার করার কথা ছিল। কিন্তু ঘটেছে উল্টোটি। শিক্ষকদের নামমাত্র প্রশিক্ষণ ও সম্মানি দিয়ে সিংহভাগ সম্মানি হিসেবে নিয়েছেন প্রশিক্ষক, শিক্ষা অফিসার, পরিদর্শকসহ স্কিমসংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়াও তারকা মানের হোটেলে অংশীজনের সঙ্গে বৈঠক করার নামে লুটপাট করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা। 


ডিসেমিনেশন অব নিউ কারিকুলামের অধীনে প্রশিক্ষণ দেওয়া বেশ কয়েকজন শিক্ষক বলেন, ওই সময় যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল তা নামমাত্র। প্রশিক্ষকরা নতুন কারিকুলাম সম্পর্কে তাদের সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারেননি। ফলে তারা কারিকুলামের আলোকে শিক্ষার্থীদের ঠিকমতো পাঠদান করাতে পারেনি। এর প্রভাব পড়ে নতুন কারিকুলামটির ওপর। ফলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আন্দোলনের মুখে সেই কারিকুলামটি বাতিল করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। 

সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন: স্কিমটির পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ মাহফুজ আলী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, চলতি বছর সৃশনশীল কারিকুলামের আলোকে পাঠদান চলবে। এ ছাড়াও আগামী বছর থেকে নতুন আরেকটি কারিকুলাম তৈরি কথা রয়েছে। আমরা মূলত এই স্কিমের মাধ্যমে যখন যে কারিকুলাম চলমান তাহলে সেই কারিকুলামের আলোকে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার চেষ্টা করব। 


পুরোনো কারিকুলামের আলোকে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য এত বরাদ্দের প্রয়োজন আছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, সৃজনশীলের জন্য সব শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। এবার এই সময়ে অনেকে নতুন করে শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছেন আবার অনেকে অবসরে গেছেন। সুতরাং প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে। আর শিক্ষকদের ঠিকমতো প্রশিক্ষণ না দিলে মানসম্পত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। 
জানতে চাইলে মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. মো. এহতেসাম উল হক বলেন, প্রকল্পের প্রস্তাব এসেছে। আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখব

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!